৪ একর জমি কিনে ৮ একর দখলে নিল ফায়ার সার্ভিস!
‘পৈত্রিক সম্পত্তি, ৪০ বছর ধরে এখানে চাষাবাদ করছি। হঠাৎ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রাতের আঁধারে এসে জায়গা দখলে নিল। আদালত-প্রশাসনের দ্বারস্থ হইছি, আদালত নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। কিন্তু দখলমুক্ত করা যায়নি। নিজস্ব জমি হলেও চাষাবাদ করতে পারছি না। জমিতে যাওয়ায় বড় ভাইকে মারধর করেছে। রাতেও ওরা পাহারায় থাকে। নিজেরা থাকতে পারছি না, বেচতেও পারছি না। বেচলে ফায়ার সার্ভিসকেই দিতে হবে। ন্যায্য মূল্য না, পানির দামে’— এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন পৈত্রিক সূত্রে জমির মালিক হাজি সৈয়দ হোসেন।
ক্রয়সূত্রে চার একর জমির মালিক, অথচ আরও চার একর জমি দখলে নিয়ে বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলেছে ফায়ার সার্ভিস। দিনের ন্যায় রাতেও নিয়ন্ত্রণ রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে নিজস্ব কর্মীবাহিনী। শুধু হাজি সৈয়দ হোসেন নয়, আরও অনেকের জমি দখলে নিয়েছে জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি।
স্থানীয়রা ফায়ার সার্ভিসের কথা জানলেও কক্সবাজারের ইনানীর মতো জায়গায় আদতে কারা দখলে নিচ্ছে জমি; সরেজমিনে খোঁজ নিতে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, সেখানে চার একর জমি কিনেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কিন্তু দখল হয়েছে প্রায় আট একর জমি। স্বৈরাচারী কায়দায় জমি দখলে নিলেও ক্ষান্ত দেয়নি নাগরিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। ইতোমধ্যে নাগরিক অধিকার হরণের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়েছে তারা। নেপথ্যে রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের দুর্নীতিবাজ কর্তা, স্থানীয় দালাল ও আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা।
ক্রয়সূত্রে চার একর জমির মালিক, অথচ আরও চার একর জমি দখলে নিয়ে বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলেছে ফায়ার সার্ভিস। দিনের ন্যায় রাতেও নিয়ন্ত্রণ রাখতে মোতায়েন করা হয়েছে নিজস্ব কর্মীবাহিনী। শুধু হাজি সৈয়দ হোসেন নয়, আরও অনেকের জমি দখলে নিয়েছে জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি জমির প্রয়োজনই হয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিস জমি অধিগ্রহণ করবে। কিন্তু অধিগ্রহণ না করে প্রশাসনের পাশাপাশি পেশিশক্তি দিয়ে জমি দখলের সুযোগ নেই। যদিও সেটিই করছে ফায়ার সার্ভিস। অধিগ্রহণ না করে কেন তারা দালালের সহায়তায় জমি ক্রয় করছে— এ প্রশ্ন এখন কক্সবাজারের সচেতন মহলে।
ভুক্তভোগী জমির মালিক ও স্থানীয়রা বলছেন, জোরপূর্বক ও নিয়মবহির্ভূতভাবে সীমানার প্রাচীর দেওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে স্থানীয়দের যাতায়াত। বিঘ্নিত হচ্ছে চাষাবাদ। ভয়ভীতি প্রদর্শন, শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। অনার্সপড়ুয়া ছাত্রী যেমন রেহাই পাননি, তেমনি জমিতে রোপণ করা ধানের চারাও তুলে ফেলেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। খোদ জমির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজিম মৃধা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার চাইলে জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্তত দ্বিগুণ দাম দিতে হয় জমির মালিককে। তবে, মালিক না দিলে সরকার চাইলেই জোর করে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে না। তার উদাহরণও আছে। সম্পত্তি মালিক ভোগদখল করবে, এটি সংবিধান স্বীকৃত। সেখানে কারসাজি, জবরদখল বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখল বা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া বেআইনি। ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য হলে তা হবে গুরুতর অপরাধ। কারণ, পোশাক পরে ফায়ার সার্ভিসের নামে জমি দখল এবং স্থানীয়দের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের নজরে আনলে নিশ্চয়ই মালিকরা ন্যায় বিচার পাবেন।’
তবে, অনিয়ম আর কারসাজির পরও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বিষয়টি ‘নিয়মের মধ্যেই হচ্ছে’ বলে দাবি করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সংস্থাটির ক্রয় কমিটির সভাপতি ও সহকারী পরিচালক ইকবাল বাহার বুলবুল জোরপূর্বক প্রাচীর নির্মাণের বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জমি তো কক্সবাজারের ইনানীতেই রয়েছে। জমি তো এমন নয় যে আমরা প্লেনে করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তাতে সমস্যা কী? আমরা শুধু আমাদের ডিমারকেশন বসাচ্ছি। এতে মহল্লার লোকজন বুঝতে পারবেন যে, এতটুকু জমি ফায়ার সার্ভিস নিচ্ছে। তখন তাদের মধ্যে যারা ভেতরে পড়বেন, তারা আসবেন, কাগজ দেখাবেন। আমার কাগজ এই, আমারটা নিয়ে নেন।’
গত ২১ ও ২২ নভেম্বর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কক্সবাজারের ইনানী বিচের কাছাকাছি মেরিন ড্রাইভ সড়কের কোলঘেঁষে (বাঁয়ে) আট একর এলাকার তিনদিকে ইট দিয়ে উঁচু প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। বাকি একটি অংশ টিন দিয়ে নির্মিত প্রাচীরে আবদ্ধ। আর মূল ফটক নির্মাণেও চলছে কর্মযজ্ঞ। ঝুলানো হয়েছে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, ‘ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স’। এসব কাজ দেখভালে নিয়োজিত রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
আরও পড়ুন
অথচ প্রাচীরের ভেতরে ঘরবাড়ি, বসতভিটা, জমিতে লাগানো ধান চোখে পড়ে। সেখানকার বাসিন্দাদের নিজ জমিতে যাবার পথটুকুও আটকে দেওয়া হয়েছে।
নির্মাণযজ্ঞ চলা মূল ফটক ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পিছু নেয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভেতরে ঢুকে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা খালেদা বেগমের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঘর আছে, জমি আছে। চাষাবাদও আছে। কিন্তু আমাদের জিম্মি করে ফেলা হয়েছে। নিজের মন মতো ঢুকতে বা বের হতে পারি না। বন্যায় পানিবন্দি ছিলাম।’
‘চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ করেছিলাম। রাস্তা দিতে বলেছিল। চেয়ারম্যানের কথা রাখেনি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। প্রতিবাদ করলেই চলে হামলা, মামলা আর নির্যাতন।’
সাতবার হামলার শিকার হয়েছেন— দাবি করে ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘এখানে আমার কলেজপড়ুয়া মেয়ে থাকত। এক দিন ঝামেলা লাগে, ওরা মেয়ের গায়েও হাত দেয়, নির্যাতন করে। থানায় মামলা বা অভিযোগ দিতে গেলেও নেয়নি। অনেক দেনদরবার করেছি, প্রতিকার পাইনি। উল্টো মেয়ের বাবাকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। বাধ্য হয়ে আর মেয়েকে এখানে রাখি না।’
পৈত্রিক সূত্রে ৬০ শতক জমির মালিক আবুল হোসাইন। এ ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, “আমার ৬০ শতকের সঙ্গে বড় ভাইয়ের কেনা ১০ শতক জমি আছে এখানে। মোট ৭০ শতক জমি চাষাবাদ করি, এ বছরও করেছিলাম। এখন ফায়ার সার্ভিস বাঁধা দিচ্ছে, তারা দেয়াল দিয়েছে। এসিল্যান্ডের কাছে নালিশ করেছি, লিখিত অভিযোগ করেছি; কাজ হয়নি। উল্টো আমাদের কারণে নাকি তারা প্রেশারে আছেন। বলেন, ‘চাপ আছে, আমরা পারছি না, আদালতে যান’। পরে আমরা কোর্টে মামলা করেছি।”
ফায়ার সার্ভিসের করা বাউন্ডারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শহীদুল্লাহ। তার বক্তব্য, উখিয়া থানাধীন ইনানীর এ এলাকায় তাদের বসবাস ১৯৮৪ সাল থেকে। কম-বেশি সব এলাকায় দাগে দাগে তাদের জমি আছে। ‘আমার তিন একরসহ আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে প্রায় চার একর ৮৮ শতাংশ জমি এখানে। অথচ আমাদের কাছ থেকে এক শতাংশ জমি না কিনেও ফায়ার সার্ভিস কথা না বলে প্রাচীর নির্মাণ করেছে। প্রচার করছে যে, এখানে নাকি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ করা হবে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্যাতন ও হামলা চালিয়ে জমির দখল নেয়। স্থানীয় প্রশাসন, থানা ও পুলিশ সবাই যেন তাদের খাদেম।’
‘সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন হলে সরকারই জমি অধিগ্রহণ করবে। এভাবে দখল বা দালাল ডেকে কেন করা হবে? সাইনবোর্ডে ফায়ার সার্ভিসের নাম থাকলেও জমি কেনা হচ্ছে কল্যাণ তহবিলের নামে। পোশাক পরিহিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের এমন অনৈতিক কার্যক্রমে জড়ানোর সুযোগ নেই। এটা তো প্রতারণা!’
তিনি আরও বলেন, ‘দুদক, ভূমি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গায় অভিযোগ করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয়, ডিসি অফিস, উপজেলা প্রশাসন, এসিল্যান্ডসহ সব জায়গায় অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি। আদালতেও গেছি। ভেবেছিলাম একটু নিষ্কৃতি পাব, কিন্তু মেলেনি। ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে দখলের কাজ করে যাচ্ছে। দলিল আমাদের, খতিয়ান আমাদের, খাজনাও আমরা দিচ্ছি। অথচ চৌহদ্দি দিয়ে জমি দখলে রাখছে ফায়ার সার্ভিস।’
আরও পড়ুন
শহীদুল্লাহ বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। ভেবেছিলাম, আগের সিন্ডিকেট ভাঙবে। নতুন প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস আগের ধারাবাহিকতায় আর কিছু করবে না। কিন্তু সেটা হয়নি। দখলে মরিয়া কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে ফায়ার সার্ভিস। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এ সরকারের কাছে আমাদের আর্জি, আমরা ন্যায্যতা চাই। স্থানীয় ও জমির মালিক হিসেবে নাগরিক অধিকার চাই। ফায়ার সার্ভিসের জবরদখল কার্যক্রমের দ্রুত নিষ্পত্তি চাই।
১৯৪৩ সাল থেকে পৈত্রিকভাবে বসবাসকারী জমির মালিক আবদুল মাজেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দাদার দুই একর জমি ছিল। সেখান থেকে বাবা ভাগ পান ৪০ শতক। ক্রয়সূত্রে তিনি আরও ৭৬ শতক জমির মালিক। মোট ১১৬ শতকের মধ্যে ১৬ শতকে বাড়ি। বাকিটুকুতে আবাদ করে খাই। গত বছর থেকে লড়াই করে চাষ করছি। চারদিক থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জায়গা ছাড়তে প্রায়ই হুমকি আসছে। ট্রেনিংয়ের নামে লোকজন এনে মারধর করা হচ্ছে।’
‘ফায়ার সার্ভিস বলছে, জমি বেচলে তাদের কাছেই করতে হবে, তা না হলে দখল। আবার মিডিয়ার (দালাল) মাধ্যমে জমি নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। আমরা রাজি না। সরকার জমি অধিগ্রহণ করলেও ভালো রেট (দাম) পাব। দালাল তো পানির দামে নিয়ে কোটি টাকায় বেচে দেবে।’
উখিয়া ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ফায়ার সার্ভিসের দাবি করা পুরো জমির পরিমাণ চার একর। অথচ জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে আট একর জমি। জোরপূর্বক দখল করা জমির মধ্যে ফজলুল হকের (পাওয়ারে মনিরা বেগম) ১০৬ শতক, হাজি আবুল হোসেনের ৪০ শতক, শহীদুল্লাহর ১২০ শতক, আব্দুর রশিদের ৪০ শতক, আবুল হোসাইন গংদের ৭০ শতক, মৌলভী মাহবুব গংদের ৪০ শতক, আব্দুল মাজেদের ৪০ শতক, গোলাম নবীর ৩২ শতক জমি রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ‘কর্মকর্তা ও কর্মচারী কল্যাণ তহবিল’ নামে ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল ৭৯৮, ৭৯৯ ও ৮০০নং দলিল মূলে তিন একর ১৯ শতক জমি কেনে ফায়ার সার্ভিস। এটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক।
খতিয়ান রেকর্ডের তথ্য যা বলছে
সরকারি রেকর্ড, সৃজিত খতিয়ান, দলিল ও খাজনা-খারিজের তথ্য মোতাবেক আগে বেচা জমি পরে কিনে দখলে নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। কেনা জমির বেশ কয়েকজন দাতা একই জমি যথাক্রমে ১৪ বছর ও ছয় মাস আগে বিক্রি করেছেন। বাবার হেবা করা জমি আগে একজনের কাছে বিক্রির পর আবার ওয়ারিশ সূত্র দেখিয়ে একই জমির মালিক বলে ফায়ার সার্ভিসকে খতিয়ান করে দলিল দিয়েছে। ডাহা অনিয়মে দলিল করা ওই জমির জমাখারিজের সুযোগ না থাকলেও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) চাপ দিয়ে খতিয়ান (যার নম্বর ৯০৫৪) নিজের নামে করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদুত্তর দিতে পারেননি উখিয়ার বর্তমান সহকারী কমিশনার (ভূমি) যারীন তাসনিম তাসিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সব নথি ঘেঁটে দেখেছি। মালিকানা নেই বা আগেই বিক্রি করা জমিও কিনেছে ফায়ার সার্ভিস। তাদের নামে নামজারি খতিয়ানটিও নিয়ম মাফিক হয়নি। বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। এটি আমার আগের অফিসারের সময়ে হয়েছে। আমি নতুন, বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।’
দুদকের শুনানিতেও প্রতিকার মেলেনি
প্রতিকার পেতে দুদকের শুনানিতে অংশ নিয়ে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী জমির মালিকগণ। দুদকের তৎকালীন কমিশনার জহুরুল হক উপস্থিত থেকে সবপক্ষকে নিয়ে শুনানি শেষে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনাও দেন। পরে আর সেটির বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি কোনো অগ্রগতিও পাওয়া যায়নি।
ট্রেনিং সেন্টার না, কল্যাণ তহবিলের নামে জমি কেনে ফায়ার সার্ভিস
দুদকের সেই শুনানিতে অংশ নিয়ে কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের কক্সবাজার অফিসের তৎকালীন প্রধান অতিষ চাকমা। তিনি বলেন, “কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডুবুরি সেবা দেওয়ার জন্য ডিজি মহোদয় একটা জমির ব্যবস্থা করতে বলেন। আমি ইনানীতে জমি দেখে প্রস্তাবনা দিই। সেটি একনেকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সে সময় জমির অধিগ্রহণ বাতিল হয়ে যায়। পরে স্বরাষ্ট্র সচিব নিজেই জমি পরিদর্শনে যান। তিনি সেখান থেকে ‘কল্যাণ তহবিল’-এর নামে ক্রয় করতে বলেন। আমরা জমি যাচাই-বাছাই করে ছয় একর কেনার প্রক্রিয়া শুরু করি।’
অথচ ফায়ার সার্ভিসের গত ১৮ জানুয়ারির একটি সভার কার্যবিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের অর্থ হতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কল্যাণার্থে কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার ইনানী মৌজায় ইতোমধ্যে ৪.৭৪ একর জমি ক্রয় করা হয়েছে। ওই সভায় অবশিষ্ট জমি ক্রয় করতে নয় দফা নির্দেশনা দিলেও সেটি প্রতিপালন করা হয়নি।
নেপথ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক, উপসচিব ও ফায়ার ডিজি মাইন উদ্দিন
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কল্যাণ তহবিলের নামে জমি কিনতে এবং বাড়তি জমি দখলে নিতে বাহিনীর সাইনবোর্ড ব্যবহার করে সরাসরি জড়িত ফায়ার সার্ভিসের ফিল্ড অফিসার মামুন ও সংস্থাটির ক্রয় কমিটির সভাপতি ইকবাল বাহার বুলবুল। এ ছাড়া জড়িত জালিয়া পালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তাহের ও তার ছেলে ইউসুফ নূর এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও মানবপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কালো জমির, দালাল মোস্তাক ও জসিম মাস্তান। ফায়ার সার্ভিসের নামে ভয়ভীতি, মারধরসহ নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে কম মূল্যে (ন্যায্য দামেরও অর্ধেক) গ্রাহক থেকে জমি কিনে চড়া মূল্যে (দ্বিগুণ-তিনগুণ) ফায়ার সার্ভিসের কাছে বিক্রি করেছে চক্রটি।
অভিযোগ পেয়েও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি ফায়ার সার্ভিস তৎকালীন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন। বরং সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকের প্রভাবে সায় দিয়ে সহযোগিতা করে গেছেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের তৎকালীন এক উপসচিব, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার জেলা ভূমি কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ফায়ার সার্ভিসের কক্সবাজার অঞ্চলের প্রধান অতিশ চাকমা।
ইনানী প্রজেক্টের তত্ত্বাবধায়ক ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সাফায়েত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যাচাই করেই জমি কেনা হয়েছে। এ কারণে বাউন্ডারি দিয়েছি। মাঝখানে কিছু জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন মালিক আছেন। কিন্তু তাদের অনেকে দেশের বাইরে আছেন। যারা দেশে তারা তো চাষাবাদ করছেন। আমরা বলেছি, কাগজপত্র নিয়ে আসেন, ফায়ার সার্ভিস উপযুক্ত দাম দিয়ে কিনে নেবে।’
কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের নবনিযুক্ত উপ-সহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জমি কিনতে দালাল তো লাগেই। আমি এসে যতটুকু জেনেছি, জমি কেনার বিষয়ে একজনের সঙ্গে ক্রয় কমিটির চুক্তি হয়েছে। তিনি কত দিয়ে নেবেন, সেটা তার ব্যাপার। তিনি জমি ফায়ারকে দেবেন। সেভাবেই জমি কিনে দিয়েছেন। তবে, কিছু লোকের জমি কেনা যাচ্ছে না কারণ, মালিকানা ও কাগজে সমস্যা আছে।’
এ বিষয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের নামে না, কল্যাণ তহবিলের নামে জমি কেনা হচ্ছে। আমরা চার একরের বেশি জায়গা ক্রয় করেছি। আরও কেনার চেষ্টা চলছে। যদি কারও জায়গা নিয়ে সমস্যা থাকে, অভিযোগ থাকে, সেটি আমরা দেখব। আমরা সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমরা সব পক্ষকে নিয়ে বসব। বসলেই সমাধান হয়ে যাবে। আমি চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোক। আমি চাই না এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, ফায়ার সার্ভিসও ক্ষতিগ্রস্ত হোক।’
ফায়ার সার্ভিসের নাম ব্যবহার করে কল্যাণ তহবিলের নামে জমি কেনা যুক্তিযুক্ত কি না, আর চার একর কেনা হলে আট একর জমির ওপর প্রাচীর দেওয়া আইনসম্মত কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের নামে জমি কেনার সুযোগ নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের জন্য জমি কেনা হচ্ছে। এখানে আট একর জমি আমরা ক্রয় করিনি, ঘেরাও করিনি। যতটুকু কেনা হয়েছে, ততটুকুই ঘেরাও করা হয়েছে।’
কী পরিকল্পনা থেকে জমি কেনা— উত্তরে তিনি বলেন, এখনও সেটি ঠিক করিনি। সেখানে ট্রেনিং সেন্টার হবে না। ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করা হবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। আপাতত সেটির সুরক্ষার জন্যই প্রাচীর দেওয়া হয়েছে।
জেইউ/এমএআর/