সিসার ‘অভিশাপ’ চক্রে শিশুর ‘জীবন’
নোয়াখালীর চাটখিলের বাসিন্দা আফরোজা বেগম এক সন্তানের জননী। তার ছেলে তাকরীমের বয়স দেড় বছরের কিছুটা বেশি। আফরোজার স্বামী দেশের বাইরে থাকায় ছেলের দেখাশোনা মাকেই সামলাতে হয়। কাজের সময় ছেলেকে বাজার থেকে কেনা বিভিন্ন ধরনের খেলনা দিয়ে খেলতে দেওয়া হয়।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে মুঠোফোন আলাপে আফরোজা জানান, ছেলের বাবা বিদেশ থাকে। দাদা-দাদি বয়স্ক। কাজের সময় ছেলেকে সঙ্গে রাখতে পারি না। তখন বিভিন্ন খেলনা সামনে দিয়ে রাখলে খেলে। তবে, বাচ্চাদের যে স্বভাব কিছু পেলে মুখে দেয়, এটা নিয়ে মাঝে মাঝে ভয় হয়।
প্লাস্টিক রিসাইকেল (পুনঃপ্রক্রিয়াজাত) করে তৈরি শিশুদের খেলনা সামগ্রীতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক হলো সিসা। সিসা হলো একজাতীয় বিষাক্ত ধাতু। মানবদেহের জন্য সিসা একটি বিষ। এটি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। সিসা চকচকে, নীলচে-ছাই রঙের; খুবই নরম তাই আগুনে সহজে গলে যায়।
সিসা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উপর বিশেষভাবে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। রক্তে সিসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। অল্প পরিমাণে সিসা শরীরে প্রবেশ করলেও, তা বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কমে যাওয়া, আচরণগত সমস্যা ও শিখনে অসুবিধার কারণ হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন পরিবেশে ভারি ধাতুর দূষণ বাড়িয়েছে। এর ফলে বাতাস, পানি, মাটি, খাবার, খেলনা, রং ও রান্নার সামগ্রীর মাধ্যমে শিশুদের বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেড়েছে। এর ফলে স্থায়ীভাবে তারা স্নায়বিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে।
সিসা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ, যাদের মধ্যে সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় ক্ষতিকর এ ভারি ধাতুর উপস্থিতি থাকার তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বব্যাপী ৮০ কোটি শিশু, ৩ জনের মধ্যে ১ জন সীসার বিষক্রিয়ায় ভোগে, যা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কেড়ে নেয় এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জমান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের নগর অঞ্চলগুলোতে অন্যতম প্রধান সমস্যার একটি হলো বায়ু দূষণ। বায়ু দূষণের অন্যতম একটি উপাদান সিসা দূষণ। ভয়ের বিষয় হলো সিসা বায়ু ছাড়াও মাটি এবং পানিকে দূষিত করছে। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ ভাগ শিশুর শরীরে তাদের যে অনুমোদিত মাত্রা রয়েছে তার চেয়ে বেশি মাত্রার সীসার উপস্থিতিতি পাওয়া গেছে। শুধু বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটির বেশি শিশু সীসা দূষণে আক্রান্ত। দূষণ বা আক্রান্ত যতটুকু আছে এই সংখ্যাটা নিয়ে কথা কম হচ্ছে এবং প্রচার কম হচ্ছে এবং গবেষণাও কম হচ্ছে। আগামী দিনে যারা আমাদের দেশের নেতৃত্ব দেবে তারা যদি সিসা দূষণে আক্রান্ত হয় তাহলে অবস্থাটা কি হবে এখনই ভাবতে হবে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, আগামী দিনে যারা আমাদের দেশের নেতৃত্বে যাবে তারা যদি সীসা দূষণে আক্রান্ত হয় শিশু হয়ে থাকে; যাদের মতিস্ক বিকাশ ও বৃদ্ধি কম হয় তাহলে আগামী দিনের আইকিউ কম থাকা বা মস্তিষ্ক কম বিকাশ হওয়া শিশুদেরকে নিয়ে আমরা কি করতে পারব? সেজন্য সিসার উৎস চিহ্নিত করে একটা একটা ধরে ধ্বংস করতে হবে। ব্যাটারি থেকে সবচেয়ে বেশি সিসা নির্গত হচ্ছে। আমাদের যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ব্যাটারিচালিত যানবাহনের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোবাইল ফোনের অব্যবহৃত ব্যাটারি থেকেও সিসা দূষণ হয়। পুরাতন সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির অপরিকল্পিত রিসাইক্লিং বন্ধ করে সিসা দূষণের হাত থেকে শিশুদেরকে রক্ষা করতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি ব্যাটারি কারখানায় কাজ করেন ১৩ বছর বয়সী মুহাম্মদ আনাস। সম্প্রতি আনাসের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পুরাতন সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির অপরিকল্পিত রিসাইক্লিং করা কোম্পানিতে কাজ করে সে। সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি জার জীবনে কত বড় ক্ষতি বয়ে আনতে পারে, এ নিয়ে কোনো ধারণা পর্যন্ত নেই তার।
আনাস বলেন, কাম কইরা পরিবার চালানো লাগে। মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাডান লাগে। গরিবের লাভ-ক্ষতির হিসাব কইরা কি লাভ? একজনে কাম দিছে, এইখানে কাম করি।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ফেরদৌস বলেন, বায়ু দূষণের দিক দিয়ে আমাদের ঢাকা শহরের অবস্থান ভালো নয়। বায়ুমান যেটা এটাতো খুব অস্বাস্থ্যকর। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিগুলো বা আমরা ব্যর্থতার বলয় থেকে বের হতে পারছি না। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সীসা ব্যবহার এটা কিন্তু যানবাহনের ধুলা থেকেও আছে। সিসার ব্যবহার বন্ধে বেশ কিছু উদ্যোগ আছে কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে সফলতার পরিমাণটা তত বেশি না। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কন্ট্রোল নাই। শিশুদের ইমিউনিটি লেভেল বড়দের মতো নয়, বাতাসে সিসা বা তাদের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, খেলনা- এ জিনিসগুলো স্বার্থ ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিশুদের শরীরে সিসা গেলে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে বা সম্ভবনা থাকে।
সিসার উৎস কী?
সিসাযুক্ত জ্বালানি (যানবাহন নির্গমন) রং, ও পানি সরবরাহের পাইপ থেকে সিসা দূষণ ঘটতে পারে। ধনে, হলুদ, মরিচ—এ ধরনের মসলার মধ্যে সিসার উপাদান পাওয়া গেছে। কম দামের কিছু গয়না, কসমেটিক্স-লিপস্টিক, নেইল পালিশ, চোখের সুরমা ও কাজল) সিঁদুর, সিসা দূষিত মাটিতে চাষ করা সবজি সিসাযুক্ত দেয়াল রং, রঞ্জক পদার্থ, খেলনা, অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের বাসনপত্র, আয়ুর্বেদিক ওষুধ ও তাবিজ ইত্যাদিতেও সিসা পাওয়া যাচ্ছে।
পুরোনো ব্যাটারির সিসা বের করে পুনরায় ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। দেশে ব্যাটারি পুনঃচক্রায়ন সিসার একটি বড় উৎস।
খেলার ছলে শিশুর হাতে যাচ্ছে সিসা
শিশুদের খেলার মাঠ নেই। আবার মাঠ থাকলে সেগুলো এখন সাধারণ শিশুদের নাগালের বাহিরে চলে গেছে। খেলার মাঠ না পেয়ে শিশুদের প্রধান বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠছে বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী। ব্যবসার উদ্দেশে দেশে সস্তায় শিশুদের জন্য বাহারি ধরনের আকর্ষণীয় খেলনা সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমদানি করা শিশুদের খেলনা তথা-গাড়ি, পুতুল, পানির পাত্রসহ বিভিন্ন প্রকারের খেলনায় বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এক কথায় শিশুদের খেলনায় সিসা বিষ পাওয়া যাচ্ছে। আর সেই বিষ শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
গত বছর (২০২৩) এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) ও ফিলিপাইনভিত্তিক সংস্থা ‘ব্যান টক্সিকস’ একটি যৌথ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। চলতি বছরের অক্টোবরে গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিশুর খেলনায় সহনীয় মাত্রা বিষাক্ত উপাদানের ন্যূনতম সীমা হচ্ছে-সিসা ৯০ পিপিএম, পারদ বা ৬০ পিপিএম মার্কারি, ৭৫ পিপিএম ক্যাডমিয়াম, ২৫ পিপিএম আর্সেনিক ও ২৫০ পিপিএম পর্যন্ত ব্রোমিয়াম। পিপিএম একক হলো ‘পার্টস পার মিলিয়ন’ অর্থাৎ অতিলঘু দ্রবণের ঘনমাত্রা প্রকাশের প্রচলিত ও কার্যকরী পদ্ধতি। কিন্তু এসব সামগ্রীতে ৩২০ পিপিএম পরিমাণ সিসা, ১৩৯০ পিপিএম ক্রোমিয়াম, ১২৮০ পিপিএম ব্রোমিয়াম ও ২৪৭ পিপিএম আর্সেনিক পাওয়া গেছে।
বিশেষ করে শিশুর খেলনা পুতুল, বর্ণমালা, খেলনা গাড়ি, ব্যাঙ, মগ, ফিডার, প্যাসিফায়ারসহ (শিশুর চুষনি) নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীতে ক্ষতিকর উপাদানগুলো মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। রাজধানীর চকবাজার, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, অর্কিড প্লাজাসহ বেশ কিছু জায়গা থেকে ১৬০টি খেলনার নমুনা সংগ্রহ শেষে সেগুলো পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে। সংবাদ সম্মেলনে কিছু পণ্য পরীক্ষা করে ক্ষতিকর মাত্রাগুলো দেখানো হয়।
গবেষণার ফলাফল বলছে, গবেষণায় শিশুদের ব্যবহৃত সাধারণ পানির কাপে ১৩৮০ পিপিএম সিসা, ২৪৭ পিপিএম আর্সেনিক ও ১৩৯০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। শিশুদের ব্যবহৃত স্টেশনারি ব্যাগে ৫৮০ পিপিএম সিসা, ১২৮০ পিপিএম ব্যারিয়াম, ৮৮ পিপিএম পারদ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের ব্যাগই শিশুর জন্য বিপজ্জনক। পুতুল সেটে ১৬০ পিপিএম সিসা ও ১৫০০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে।
শিশুদের পানি খাওয়ার মগে ২২০ পিপিএম সিসা, ৩১৫ পিপিএম ক্যাডমিয়াম ও ১৬৮০ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। একটি সুপরিচিত খেলনা দোকান থেকে কেনা পুতুল সেটে প্রায় ৫০০ পিপিএম সিসা পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে, বড় দোকানগুলোও এই ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থমুক্ত নয়।
এ ছাড়া, শিশুদের শেখার জন্য তৈরি বর্ণমালা সেটের একটি অক্ষরে ৬৬০ পিপিএম সীসা পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি বায়তুল মোকারম, গুলিস্তানসহ পুরান ঢাকার খেলনার দোকানির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বেশিরভাগ দোকানি খেলনা তৈরির উপাদান সম্পর্কে অবগত নয়। তবে কোনো কোনো দোকানির দাবি তাদের বিক্রি খেলনা ফাইবার দিয়ে তৈরি, খেলনায় সিসার ব্যবহার করা হয় না। চায়না থেকে আমদানি করা খেলনায়ও শুধু ফাইবার বলে দাবি তাদের।
বায়তুল মোকারম মার্কেটের সুপার রহমান ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক ইমতিয়াজ খান বলেন, আমাদের সব খেলনা চীন থেকে আসে। এসব খেলনায় ফাইবার, কোনো সিসা। খেলনায় সিসা নাই সেটা কীভাবে নিশ্চিত হলেন এমন প্রশ্নে ইতমিয়াজ বলেন, সিসা নাই সেটা আমরা কেমনে বলব?
ইমতিয়াজের দোকানের সামনে ফুটপাতে খেলনা বিক্রি করছেন সাহাবুদ্দিন। তিনি জানান, জিঞ্জিরার একটি কারখানা থেকে তিনি খেলনা নিয়ে আসেন। তবে খেলনা তৈরির উপাদান সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
বিষ নিয়ে ঘুরছে শিশু
শিশুরা খেলতে পছন্দ করে। ঢাকাসহ সারা দেশে আধুনিকায়নের ফলে দিনকে দিন খেলার মাঠ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ স্কুলে এখন আর সেই অর্থে খেলার মাঠ মেলে না। যা কারণে শিশুরা বিকল্প হিসেবে তৈরি খেলনা সামগ্রীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। শিশুদের ব্যবহৃত স্টেশনারি ব্যাগে ৫৮০ পিপিএম সিসা পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। অথচ শিশুরা এই ব্যাগ স্কুলে বহন করে নিয়ে যায়। আবার সেই ব্যাগে করে অনেক শিশুরা সিসার তৈরি খেলনা নিয়ে ঘুরছে। শুধু তাই নয়, কোথাও বেড়াতে গেলেও খেলনা সঙ্গী হচ্ছে।
ত্বন্নী আনোয়ারের দুই মেয়ে। একজন পঞ্চম এবং আরেকজন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মা ত্বন্নী জানান, আমার মেয়েরা স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে দেরি খেলনা হাতে নিতে দেরি হয় না। কোথাও বেড়াতে গেলেও পারলে সব খেলনা নিয়ে যায়। এসব খেলনা দিয়ে স্কুলেও যায়। আসলে খেলার মতো জায়গা তো ওরা পাচ্ছে না, যার কারণে উপায়ও নাই খেলনা না দিয়ে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শৈশবে বেড়ে ওঠার জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে খেলার মাঠ। খেলার মাঠে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য গুরত্বপূর্ণ এবং বন্ধুত্ব ও সামাজিকীকরণে খেলার মাঠের বিকল্প হয় না। একটা সময়ে শহরে খেলার ব্যবস্থা ছিল। কালের আবর্তে খেলার মাঠ কমতে কমতে সেগুলো এখন নাই বললেই চলে। ঢাকায় প্রয়োজনের তুলনায় দশের ভাগের এক ভাগও খেলার মাঠও নাই। এটার বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন খেলার উপাদান আসছে, দূষণের কারণ হচ্ছে। আসলে রাষ্ট্রের উপলব্ধির জায়গায় খেলার মাঠটাকে এত গুরত্বপূর্ণ হিসেবে চিন্তা করে না। তার ফলাফলে দেখা যায় আমাদের শিশুরা কেমিক্যালের তৈরি খেলনা গ্রহণ করছে। আর এটা তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের শিশুরা বিকলাঙ্গ হচ্ছে, তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বিভিন্ন দূষণের শিকার হচ্ছে।
শখের বিপদ!
জন্মের পর থেকে প্রায় সাত বছর অবধি শিশুদের কাজল দেওয়ার প্রাচীন রীতি এখন দেশের অনেক জায়গায় বিদ্যমান। শুধু কি তাই, শিশুদের সুরমাও দিতে দেখা যায়। আর মেয়ে শিশুদের ছোট থেকে অনেক ক্ষেত্রে শখ করে লিপস্টিক, নেইল পালিশ দেওয়া হয়। কোনো বিশেষ দিন বা অনুষ্ঠানে যেতেও শিশুদের লিপস্টিক, নেইল পালিশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বী বিবাহিত নারীদের সিঁদুর দেওয়ার ধর্মীয় রীতি রয়েছে। বিবাহিত মেয়েরা যখন গর্ভবর্তী হয় তার প্রভাব পড়ে অনাগত সন্তানের ওপর। আর জন্মের পর তো শিশুরা মোটামুটি একটা বয়স পর্যন্ত মূলত মায়ের সান্নিধ্যে থাকে। ফলে সিসাযুক্ত সিঁদুর মায়েদের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদেরও ক্ষতি করে।
ঢাকার পূর্ব রাজা বাজারের বাসিন্দা শাম্মি আহমেদ তার পাঁচ বছরের মেয়েকে বিভিন্ন সময়ে শখের বসে লিপস্টিক ও নেইল পালিশ দেন। শাম্মি বলেন, মেয়েকে শখ করে লিপস্টিক ও নেইল পালিশ দেই। কিন্তু এগুলোতে যে সিসার উপাদান থাকে এটাতো বলতে পারব না। আর সিসা কীভাবে ক্ষতি করছে সেটা বোঝারও তো উপায় নাই।
নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডা সায়মা কবীর বলেন, সীসার অনেক উৎস। তার মধ্যে একটি হচ্ছে পেইন্টিং। সেটা খেলনা বা দেয়াল যে পেইন্ট করা হয় সেখানে থাকে। আরেকটা উৎস আমরা অবজ্ঞা করি বা আমরা জানি না, বাচ্চাদের আমরা যে কাজল দেই বা কাজলের টিপ দিয়ে রাখি এটাতে কিন্তু সিসা আছে। সুরমায় ও সিঁদুরে সিসার উপস্থিতি রয়েছে। এ জিনিসগুলো কিন্তু আমরা সরাসরি নিজেরাই শরীরে নিচ্ছি। খেলনার মধ্যে ইদানীং যেটা হয়, সস্তা ও আকর্ষণীয় করার জন্য সস্তা পেইন্ট ব্যবহার করে এগুলোতে সিসা থাকে। ব্যাটারি পুনঃচক্রায়ন সিসার একটি বড় উৎস। ব্যাটারি পুনঃচক্রায়ন থেকে সিসা বাতাসে চলে যায়। এ ছাড়া, আমরা শরীরে সরাসরি সিসা প্রয়োগ করছি কসমেটিকসের মাধ্যমে।
সিসার উপস্থিতি শিশুর শরীরে কী কী ক্ষতি বয়ে আনতে পারে?
সিসা একটি নিউরোটক্সিন, যা শিশুদের মস্তিষ্কের অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করে। এটি ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের উপর বিশেষভাবে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে, যা তাদের মধ্যে সাজীবনের জন্য স্নায়বিক, মানসিক এবং শারীরিক অক্ষমতা সৃষ্টি করে; মৃত্যুও ঘটাতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায়, শিশুরা ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি সিসার বিষক্রিয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
চিকিৎসকরা বলছেন, খেলনা, খাবার, মশলা, রং এবং আরও অনেক কিছুতে সিসার ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে, কারণ এটা সরাসরি শিশুদের মস্তিষ্কে ক্ষতি করে। সীসা_বিষাক্ততা এড়াতে শিশুদের নিয়মিত হাত ধোয়া এবং বোতল ও খেলনা পরিষ্কার রাখতে উৎসাহিত করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সিসা একটি ভারী ধাতব পদার্থ হিসেবে জানি। এটি মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি হয় শিশু-কিশোর এবং গর্ভবর্তী নারীদের। গর্ভবর্তী নারীদের ক্ষেত্রে তার গর্ভস্থ শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ব্যবহৃত হতে পারে এবং জন্মগত বিকলাঙ্গ বা অটিস্টিক শিশু জন্ম নিতে পারে। জন্মের পরে শিশু যদি সিসা দূষণের শিকার হয় তার নার্ভের বিকাশ ঠিকমতো হয় না, ব্রেনই বা মস্তিষ্ক তার বিকাশ ব্যবহৃত হয়। ফলে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি কমে যায়, অতি চঞ্চলতা অথবা মনোযোগহীনতা তার মধ্যে তৈরি হয় এবং অন্যদিকে তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-পতঙ্গগুলো যেমন-লিভার, কিডনি, পাকস্থলী এগুলোর জন্য সিসা ক্ষতিকর। সিসা ক্যানসার তৈরির একটি উপাদানও বটে। অন্যদিকে, শোনার ক্ষমতা সেটিও সিসার জন্য কিন্তু কমে যায়।
লেলিন চৌধুরী বলেন, সিসার কারণে মেরুদণ্ডের বিকৃতি নিয়ে ও মেরুমজ্জার বিকৃতি নিয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। এর বাহিরে ত্বকের সমস্যা এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের মতো সমস্যা সিসার কারণে হতে পারে। সিসার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার প্রধান বিষয় হচ্ছে, কি পরিমাণ সিসা ব্যবহার করা যাবে না এবং কোন মাত্রার বেশি ব্যবহার করলে মানব শরীরের জন্য সিসা ক্ষতিকর থাকবে সেটি একটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। আমাদের সেটি নির্ধারণ করা উচিত। যে পণ্যগুলোতে সিসার ব্যবহার বেশি হয় সেগুলোকে দৈব চয়নের মাধ্যমে পরীক্ষা করা দরকার। যেসব কোম্পানি বা কারখানার প্রস্তুতকৃত দ্রব্যে সিসার পরিমাণ বেশি পাওয়া যাবে সেটিও কিন্তু আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, অন্যদিকে, নানা ধরনের পল্টি ফিড, রাসায়নিক বীজ, প্রিজারভেটিভের মধ্যে সিসা ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেটিও বের করতে হবে। মোট কথা আইনি বিধিবিধান দিয়ে সিসার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং আইন প্রয়োগ হচ্ছে কি না মাঝে মাঝে দৈব চয়নের ভিত্তিতে দ্রব্যাদি পরীক্ষা করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত মত যদি এটা শুরু করা যায় তাহলে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সিসা পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে।
জানতে চাইলে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সায়মা কবীর বলেন, সিসার উৎস অনেক। সিসা শিশুদের খুব ক্ষতি করে। কারণ, শিশুদের ব্রেইন ডেভলপিং ব্রেইন, ওদের পাঁচ বছর পর্যন্ত ব্রেইন পরিপক্ব হয় না। ওই পরিপক্ব ব্রেইনে সিসা গিয়ে সরাসরি ক্ষতি করে। ব্রেইনের ডেভেলপমেন্ট হতে দেয় না। একটা শিশু যতটা বুদ্ধিমান, চটপটে বা যতটা আইকিউ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ডেভেলপিং ব্রেইনে গিয়ে সিসা আইকিউ লেভেল কমিয়ে দেয়, এতে করে ডেভেলপমেন্টাল উন্নয়নে দেরি হয়।
সায়মা কবীর বলেন, আবার শিশুদের মধ্যে যারা স্কুলে যাচ্ছে তাদের আমরা সিসার বিষক্রিয়া সহজে ধরতে পারি, দেখা যায় শিশুদের স্কুলে পারফরমেন্স কমে আসে। একটা শিশু আগে ভালো ছিল এখন ডাল হয়ে যাচ্ছে বা ডাম্প হয়ে যাচ্ছে, আমরা কিন্তু বলি ওরা পড়াশোনা করে না, আসলে কিন্তু তা না। প্রতিনিয়ত সিসার প্রতিক্রিয়ার কারণে শিশুদের এ ক্ষতি হয়। এটা যে সিসা কারণে হতে পারে এটা তো আমাদের মাথায় নাই। সিসার কারণে শিশুদের পেটে ব্যথা হয়, বমি হয়, খিঁচুনি হয়।
যেভাবে সিসা শরীরে প্রবেশ করে এবং সিসা মুক্ত হওয়ার উপায়
সিসা সাধারণত খাবারের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং শরীরের চামড়ার মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। আর মানুষের শরীরে সিসা প্রবেশ করলে তা সহজে অবমুক্ত হয় না। সাধারণত সিসা মানুষের হাড়ে এবং দাঁতে সংরক্ষিত থাকে এবং এটি এসব জায়গায় বছরের পর বছর থেকে যেতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, সিসা আক্রান্ত হলে চিকিৎসা কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি। অনেক সময় সীসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করতে অনেক সময় লেগে যায়। যদি দেখা যায় টিউবওয়েল পানিতে সিসার পরিমাণ বেশি সেটাকে নিষিদ্ধ করতে পারি, যেমন- আমরা আর্সেনিক নিষিদ্ধ করতে পেরেছি। সিসার সম্ভাব্য জায়গাগুলো কোথায় কোথায় আছে সেগুলো আগে পরীক্ষা হওয়া দরকার।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. সায়মা কবীর জানান, সিসা আক্রান্ত হয়েছে কিনা-এটার জন্য আমরা রক্ত পরীক্ষা করি। রক্ত পরীক্ষা করে ইউরিনে সিসার পরিমাণ দেখা হয়। এ ছাড়া, এক্সরে করলে দীর্ঘ হাড়গুলোতে সিসা লাইন দেখা যায়। এটা দেখে বোঝা যায় সিসা বিষক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে। রক্তে সিসার পরিমাণ দেখার বিষয়টি কিন্তু যথেষ্ট নয়। শিশুরা যেহেতু খেলনার স্পর্শে বেশি থাকে তাই বার বার হাত ধোঁয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
খেলনা কেনার ক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। একেবারে কমদামি খেলনা বেশি পরিমাণে না কিনে একটু বেশি দাম দিয়ে একটু দামি হলেও যেসব খেলনায় সিসার পরিমাণ কম সেটা দেওয়া যেতে পারি।
সিসা দূষণ রোধে সরকার কী করছে?
সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণ রোধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের সঙ্গে কাজ করতে চায়। সেই লক্ষ্যে মাস দুয়েক আগে অন্তর্বর্তী সরকার সিসা দূষণ কমাতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদকে আহ্বায়ক করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাটারি পুনঃচক্রায়নে পরিবেশের ক্ষতি করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা কারখানা বন্ধ এবং সিসা দূষণ মাটি সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের কিছু কিছু জায়গায় কার্যক্রম চলমান আছে।
এ ছাড়া সিসা দূষণ বন্ধে সরকার কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। যেখানে অংশীজন হিসেবে সঙ্গে থাকছে ইউনিসেফ, পিওর আর্থ ও বিশ্ব ব্যাংক। সিসা দূষণে এসব সংস্থা সহায়তা করবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, সিসা দূষণ বেড়েছে। সিসা দূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় নিয়ে পরিবেশ সবিচকে আহ্বায়ক করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি হয়েছে। ব্যাটারি থেকে যে দূষণ হয় সেটার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। অবৈধ উপায়ে যারা ব্যাটারি ভেঙে রিসাইক্লিং করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। লেড অ্যাসিড ব্যাটারি দেখা হচ্ছে কারণ এখান থেকে যখন ভেঙে সীসা বের করতে চায় ব্যাটারি থেকে তখনই দূষণটা হয়। ব্যাটারি ভেঙে যখন গলায় তখন দূষণ হয়। আমরা চেষ্টা করছি, দূষণটা কমানোর জন্য। অবৈধ কারখানা যেন না চলতে পারে তার দিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। এটা আমরা জোরদার করেছি। কিছু কিছু জায়গায় সীসা আছে, যেমন-পেইন্টে সীসা আছে, পেইন্টে যেন কোনো সীসা না থাকে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে উৎস দেখা হচ্ছে।
জিয়াউল হক বলেন, সিসা দূষণের কারণে যেসব জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেমন-মাটি চিহ্নিত করা হয়েছে। দুইশ;র উপর কারখানা পাওয়া গেছে যেখানে ব্যাটারি গলানো হতো সেখানে সিসাযুক্ত মাটি পাওয়া গেছে। গাজীপুর, সাভারের একটা জায়গার মাটি থেকে সিসা সরানো হয়েছে। এ রকম কিছু কিছু জায়গায় সিসাযুক্ত মাটি সরিয়ে সরিয়ে ভালো মাটি দেওয়া হয়েছে। পিওর আর্থ, ইউনিসেফ, বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা নিয়ে সামনে বেশ কিছু কাজ হবে। এককভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর সবকিছু করতে পারবে না। সিসা মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে সঙ্গে থাকতে হবে।
সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণ রোধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শে আসার প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করতে কাজ চলছে। সবাই মিলে কাজ করলে সিসা দূষণ কমানো সম্ভব বলে আমি মনে করি।
আইন আছে, শাস্তি হচ্ছে তবুও দূষণ
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০-এর সংজ্ঞায়ন অংশে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যের’ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যেকোনো বর্জ্য, যা নিজস্ব ভৌত বা রাসায়নিক গুণগত কারণে বা অন্য কোনো বর্জ্য বা পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে বিষক্রিয়া, জীবাণু সংক্রমণ, দহন, বিস্ফোরণ প্রক্রিয়া, তেজস্ক্রিয়া, ক্ষয়ক্রিয়া বা অন্য কোনো ক্ষতিকর ক্রিয়া দ্বারা পরিবেশের ক্ষতিসাধনে সক্ষম।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০-এর ৪ নং ধারার ৬ (গ) অংশে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, আমদানি, মজুদকরণ, বোঝাইকরণ, পরিবহনের ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘...পরিবেশের ক্ষতি রোধকল্পে সরকার অন্যান্য আইনের বিধান সাপেক্ষে বিধি দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ধারণ, মজুদকরণ, বোঝাইকরণ, সরবরাহ, পরিবহন, আমদানি, রফতানি, পরিত্যাগকরণ, ডাম্পিং ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
যদি কেউ এ ধারা লঙ্ঘন করে তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক দুই বছর বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন দুই বছর, অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ লাখ, অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড কার্যকর হবে।
এ ছাড়া, বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২; পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫; পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩; কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১; ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ২০২১ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযোগ হট লাইন ৩৩৩-৪; মতো বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ মাঝেমধ্যে হতে দেখা যায়, কিন্তু তার পরও কীভাবে বিপজ্জনক সিসার ব্যবহার বাড়ছে এবং সিসা দূষণযুক্ত কারখানা গড়ে ওঠে সেটাই বিস্ময়কর!
সুপ্রিম কোর্টের জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, আমাদের পরিবেশে বাতাসে যে সিসার পরিমাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশে কিছু কিছু সিসা বার আছে, যেখানে কিশোররা যায়। দুইটার ব্যাপারে আমরা কিন্তু লিগ্যাল অ্যাকশন নিয়েছি। সিসার বারগুলো বন্ধ করার জন্য হাইকোর্টে ইতোমধ্যে জাজমেন্ট আছে এবং সেই জাজমেন্ট প্রয়োগ করলে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। আর এ ব্যাপারে যেভাবে নির্দেশনা আছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশের ওপর। আর বায়ু দূষণ নিয়ে আমরা যে মামলাটা করেছি সেখানে একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা প্রতিবেদন দিয়েছে এবং সেটার ওপর ভিত্তি করে কোর্ট নয় দফা নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নয়টা পদক্ষেপ নিতে হবে; তবে এই পদক্ষেপ এখন বন্ধ আছে।
মনজিল মোরশেদ বলেন, হাইকোর্টের নয় দফা নির্দেশনার ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ প্রয়োগ করে তাহলে বায়ু দূষণের মাত্রাটা কমতে পারে। আর আমাদের ইন্ড্রাস্টিয়াল সেটআপগুলো আছে যে সমস্ত বর্জ্য আসবে সেটা আমার পানিতে বা বায়ুতে মিলে এই জায়গাগুলোতে প্রয়োগটা খুব গুরত্বপূর্ণ; তারা পরিবেশের ক্ষতি করে যেন কোনো কিছু না করে। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা তো বিনিয়োগ বেশি করতে চায়, যার ফলে তারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য মাটির নিচ দিয়ে নদীতে ফেলে দিচ্ছে। এসব বিষয় সরকারকে নজর দেওয়া দরকার। আসলে গভীরভাবে নজর না দিলে এগুলোর সমস্যার সমাধান হবে না।
সিসা দূষণ নিয়ন্ত্রণে ইউনিসেফের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা
বাংলাদেশে সিসা দূষণ বন্ধে ইউনিসেফের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে ইউনিসেফ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সঙ্গে সিসা দূষণ রোধে বিভিন্ন সহায়তায় যুক্ত হচ্ছে। গত ৫ নভেম্বর শিশুদের সিসা দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাত’ উপলক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় (এমওইএফসিসি) ইউনিসেফের সঙ্গে যৌথভাবে আজ একটি জাতীয় কর্মশালার আয়োজন করে। সিসাসহ শিশুদের ক্ষতিসাধন করে এমন ভারী ধাতুর উৎস সম্পর্কে ধারণা বাড়ানো এবং সিসার দূষণ কমানোর লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীজনদের সম্পৃক্ত করতে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
কর্মশালায় বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ারস বলেন, সাধারণত ভারী ধাতু বিশেষ করে সিসা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ওপর বেশি গুরুতর প্রভাব ফেলে, এই ক্ষতি চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। দুর্ভাগ্যবশত, শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বিকাশের সময়সীমা কমে যায় এবং প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদ্রোগ (কার্ডিওভাসকুলার) দেখা দেয় আর গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে তাদের অনাগত শিশুরা হয় ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সুস্পষ্ট আইন এবং বিশেষ করে বেসরকারি খাতের সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ দ্বারা এই দূষণ প্রতিরোধযোগ্য।
রানা ফ্লাওয়ারস বলেন, সিসা এই দূষণের ফলে ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের যে অতিরিক্ত খরচ ও ভোগান্তি হয়ে থাকে। পাশাপাশি সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে বাড়তি খরচ হয়ে থাকে, সেটাও অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব। ইউনিসেফ অংশীদারদের সঙ্গে একত্রে মিলে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেখানে প্রতিটি শিশু সিসা ও বিষাক্ত ধাতুমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে, খেলতে ও শিখতে পারবে।
সাড়ে ৩ কোটির বেশি শিশুর রক্তে সিসা: ইউনিসেফ
সিসা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ; যাদের মধ্যে সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় ক্ষতিকর এ ভারি ধাতুর উপস্থিতি থাকার তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। গত ৫ নভেম্বর ঢাকায় এক কর্মশালায় এ তথ্য জানানো হয়।
আইইডিসিআর- আইসিডিডিআর, বি এবং ইউনিসেফের সিসা শনাক্ত পরীক্ষা
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর, বি)-এর সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ খুলনা, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী ও সিলেট জেলায় ৯৮০ এবং ঢাকায় ৫০০ শিশুকে পরীক্ষা করে সবার রক্তে সিসার উপস্থিতি শনাক্ত করে। এসব নমুনার মধ্যে চার জেলায় ৪০ শতাংশ এবং ঢাকায় ৮০ শতাংশ নমুনায় প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসা পাওয়া যায়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত ন্যূনতম মাত্রার চেয়ে বেশি। অবশ্য শিশুদের রক্তে কোনো মাত্রায় সিসার উপস্থিতিই নিরাপদ নয়। তাই এই অংশীদারিত্বের (পার্টনারশিপ) মাধ্যমে সিসা শনাক্তকরণ ও সিসার সংস্পর্শে আসার উৎস ও উপায়গুলো রোধ করার উপর বিশেষ জোর দেয়া হবে।
বিবিএস- ইউনিসেফের উদ্যোগ
২০২৪ সালের জুন মাসে, ইউএসএআইডি এর আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফ ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস): রাউন্ড ৭ (২০২৪-২০২৫)’ শুরুর কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, যেখানে প্রথমবারের মতো রক্তে সিসা ও অন্যান্য বিষাক্ত ধাতুর মাত্রা সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহের মডেল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বড় পরিসরে এই নির্ভরযোগ্য ও জাতীয় পর্যায়ের উপাত্ত, নীতিমালা সংস্কারে জোরালো তথ্যপ্রমাণ জোগান দেবে। বাংলাদেশে সিসামুক্ত ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী আইন ও পদক্ষেপ গ্রহণেও সহায়ক হবে, যেখানে সব পণ্য হবে সিসামুক্ত এবং থাকবে নিরাপদ শিল্পায়ন ব্যবস্থা।
শিশুদের সিসার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচানোর ও সিসামুক্ত পৃথিবী গড়ার লক্ষ্য নিয়ে চালু হওয়া বৈশ্বিক উদ্যোগ ‘পার্টনারশিপ ফর এ লেড-ফ্রি ফিউচার’ (পিএলএফ)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণ রোধের মাধ্যমে শিশুদের ওপর সিসার বিষক্রিয়া নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। পিএলএফ এর একজন অংশীদার হিসেবে, ইউনিসেফের সহায়তায়, বাংলাদেশ সিসার সংস্পর্শে আসার উৎসসমূহ চিহ্নিত ও সিসা দূষণ প্রতিরোধ করতে প্রতিশ্রুতির কথা জানান দিয়েছে।
পিওর আর্থের প্রতিবেদন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা—পিওর আর্থ, ২০২৩ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর ‘র্যাপিড মার্কেট স্ক্রিনিং বা আরএমএস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যা গিভওয়েল—এর অর্থায়নে পরিচালিত হয়েছে। বিশ্বের ২৫টি দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া সাধারণ ভোক্তা পণ্যে সিসা শনাক্ত করার জন্য এই সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। পিওর আর্থ এর গবেষকরা বাংলাদেশের চারটি অন্যতম প্রধান জেলা — ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা এবং বরিশালে বাজার পরিদর্শন করেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত চলা এই সমীক্ষায় গবেষকরা নমুনা সংগ্রহ করেন এবং একটি এক্সআরএফ (এক্স—রে ফ্লুরোসেন্স) মেশিন দিয়ে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যে, ১৯৭টি সংগৃহীত নমুনা সামগ্রীর মধ্যে ২৪% নমুনা সিসার নিরাপদ মাত্রা বা রেফারেন্স ভ্যালু ছাড়িয়ে গেছে। দৈনন্দিন জীবনে নিত্যব্যবহার্য নানা পণ্যসামগ্রী যেমন অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন ধাতব রান্নার ও খাবারের বাসনপত্র (৫৯%), সিরামিকের খাবারের বাসনপত্র (৪৪%), দেয়াল ও বিভিন্ন ধরনের রং (৩৪%), ভাত/স্টার্চ (১৭%), এবং খেলনায় (১৩%) সর্বাধিক পরিমাণে সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
পিওর আর্থ বাংলাদেশের গবেষকরা ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত খুলনা জেলার মোট ৪৭টি বাড়িতে গৃহস্থালি পর্যায়ে সিসা দূষণ পর্যবেক্ষণ বা হোম বেসড অ্যাসেসমেন্ট গবেষণাটি পরিচালনা করেন, যেখানে ধাতব এবং সিরামিকের রান্নার পাত্র, খেলনা, তাবিজ, গহনা এবং আরও অনেক নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতি পায়। টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে সিসা অ্যাসিড ব্যাটারি কারখানা পরিষ্কার ও পরিশোধনের সময় আইসিডিডিআর,বি মোট ১৪৭টি পরিবারের পরিবেশগত নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। এতে হলুদের গুঁড়া এবং উঠানের মাটির নমুনায় উচ্চ মাত্রার সিসা পাওয়া যায়।
এনআই