আলোর পথে দ্যুতি ছড়াচ্ছে সৈকতের পথশিশুরা
১৩ বছরের শিশু রাফি (ছদ্মনাম)। বাবা-মা নেই, জন্ম কোথায় জানে না। রাত পার করে কক্সবাজারের কলাতলী সমুদ্র সৈকতের পাশের একটি খাবার হোটেলে। এক বছর আগেও রাফি এদিক-ওদিক ঘুরে ভিক্ষা করত। কয়েকটা টাকার জন্য মানুষের কাছে হাত পাতত। কেউ দুই টাকা, পাঁচ টাকা দিত। কেউ ‘দূর-দূর’ করে তাড়িয়ে দিত। ক্ষুধার তাড়নায় আবারও মানুষের কাছে হাত পাততে বাধ্য হতো।
এভাবে প্রায় ১৮০০ টাকা সঞ্চয় করে রাফি। সেই টাকা দিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে পাইকারি দোকান থেকে কয়েকটা প্লাস্টিকের ফুটবল, বেলুন, ঘুড়ি ও প্লাস্টিকের খেলনা কিনে হাতে হাতে সমুদ্রপাড়ে বিক্রি শুরু করে। প্রতিটি পণ্যে ২০-৩০ টাকা লাভ হতো। লাভের টাকা জমিয়ে আজ সে একটি ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়েছে। যদিও ছোট, তারপরও প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা বিক্রি হয়। আগে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। এখন সে তিন হাজার টাকায় একটি মেসে থাকে।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ লাখ পথশিশু রয়েছে। ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, পথশিশুদের মধ্যে ৩০.১ শতাংশ শিশু রাস্তাঘাট, স্টেশন, টার্মিনাল, মাঠ বা পার্কের মতো খোলা জায়গায় ঘুমায়। তাদের ৭১.৮ শতাংশ পড়তে বা লিখতে পারে না। তবে, ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে কক্সবাজারে। এখানকার শিশুরা প্রশাসনের সহযোগিতা এবং নিজ উদ্দীপনায় নিজেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে
এক সময় রাফির মতো হাত পেতে চলত কক্সবাজারের সমুদ্রপাড়ের পথশিশুরা। এখন তারা নিজেরাই নিজেদের আলোর পথে নিয়ে এসেছে। সেই আলোর পথ ধরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন বুনছে।
আরও পড়ুন
রাফি জানায়, বিচে ঘুরতে ঘুরতে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। কেউ বিড়ি খায়, কেউ ড্যান্ডি খায়। এখন অনেকেই বদলে গেছে। ছোটখাটো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এটা আমাদের জন্য কষ্টের কিছু না। বরং আনন্দের। মানুষ অন্তত আগের মতো খারাপ আচরণ করে না।
কথা হয় সায়মন (ছদ্মনাম) নামের অপর এক পথশিশুর সঙ্গে। রাফির মতো সেও অন্যের কাছে হাত পেতে চলত। এখন কক্সবাজারের লাবণী বিচ পয়েন্টে ঘোড়া চালায়। ছোট-বড় সবাইকে ১০ মিনিট ঘোড়ায় চড়িয়ে ২০০ টাকা নেয়। আর ৫০ টাকায় ঘোড়ায় বসে ছবি তোলার সুযোগ দেয়। আজাদ নামের এক বন্ধুকে দেখে মাদক থেকে আলোর পথে ফিরে এসেছে সেও।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্টকে সায়মন বলে, আমরা ভিক্ষা করতাম। ভিক্ষার টাকায় নেশা করতাম। সারা দিন সমুদ্রপাড়ে থাকতাম, এখানেই ঘুমাতাম। ছয় মাস আগে দুই বন্ধু মিলে একটা ঘোড়া ভাড়া নেই। সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এ সময় বিচে থাকি। আজাদ (বন্ধু) চার ঘণ্টা চালায়, আমি চার ঘণ্টা। ভালো টাকা ইনকাম হয়। এখন আমরা দুজনই খুব ভালো আছি।
সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা-ইউনিসেফের ‘দ্য কোয়ালিটি স্টাডি অন চিলড্রেন লিভিং ইন স্ট্রিট সিচুয়েশন ইন বাংলাদেশ- ২০২৪’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ লাখ পথশিশু রয়েছে। ২০২৩ সালে ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা গেছে, পথশিশুদের মধ্যে ৩০.১ শতাংশ শিশু রাস্তাঘাট, স্টেশন, টার্মিনাল, মাঠ বা পার্কের মতো খোলা জায়গায় ঘুমায়। তাদের ৭১.৮ শতাংশ পড়তে বা লিখতে পারে না।
তবে, ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে কক্সবাজারে। এখানকার শিশুরা প্রশাসনের সহযোগিতা এবং নিজ উদ্দীপনায় নিজেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছে।
কক্সবাজারের পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য ২০১২ সালে কক্সবাজারের দক্ষিণ রুমালিয়ার ছড়ায় ‘সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র’ (আগের নাম শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র) খোলা হয়েছিল। সেখানে একসঙ্গে ১০০ ছেলে ও ১০০ মেয়েশিশুকে রেখে পুনর্বাসন করা হয়।
আরও পড়ুন
পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, এখানে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের আচার-আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আবেগীয় ও মানসিক চাপে টিকে থাকা, কার্যকর যোগাযোগ ও সমঝোতা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হয়। ১৪ বছরের ঊর্ধ্বের শিশুদের আগ্রহ ও সক্ষমতার ভিত্তিতে বিউটিফিকেশন, টেইলারিং, ব্লক-বাটিক, পেইন্ট/আর্ট (ব্যানার/সাইনবোর্ড), জুতা বানানো, অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক্যাল ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সমাজের মূল ধারার সঙ্গে একীভূত করার লক্ষ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে ঝুঁকিবিহীন কাজে নিয়োজিত করা হয়। মূলত বছরব্যাপী এসব কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা অপকর্মে জড়াতে পারে না। এমন উদ্যোগে ইতিবাচক পরিবর্তনের দেখা মিলেছে কক্সবাজারে।
পথশিশুদের আলোর পথে আনতে বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগের ওপর জোর দিতে বলেছেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের সেকশন চিফ (চাইল্ড প্রোটেকশন) নাটালি ম্যাক্কলি। তিনি বলেন, ‘পথশিশুদের জন্য সরকারি আরও প্রকল্প হাতে নিতে হবে। শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষ যেন তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, সেজন্য সচেতনতা প্রয়োজন।’
শিশুরাই যখন শিশুদের আদর্শ
একদিকে যেমন পথশিশুরা মাদক ছেড়ে আলোর পথে আসছে, অন্যদিকে কক্সবাজারের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরাও বিভিন্ন উপায়ে সমুদ্রকেন্দ্রিক স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদেরই একজন রামুর কচ্ছপিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মায়াবতী। সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যায়। পৌনে ১২টায় বাসায় ফিরে বিশ্রাম নেয়। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া সেরে বন্ধুদের নিয়ে রওনা হয় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দিকে। কখনও বাসে, কখনও পর্যটকদের চান্দের গাড়ি থামিয়ে ১৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন আসে কলাতলি বিচে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে সময় কাটিয়ে আবারও ফিরে যায় রামুর বাসায়।
সুগন্ধা বিচে কথা হয় মায়াবতীর সঙ্গে। হাসিমুখে সে বলে, আমরা চার ভাই-বোন। বাবা ভ্যানচালক, মা কিছুই করেন না। স্কুল শেষে বাসায় ফিরি, কাজ থাকে না। তাই পরিবারকে সহযোগিতার জন্য চলে আসি বিচে। এখানে পর্যটকদের গান শোনাই, তারা আনন্দ পায়; আমারও ভালো লাগে। কেউ কেউ খুশি হয়ে ২০-৫০ টাকা দেয়। ৫০০-১০০০ টাকাও কেউ কেউ দেয়।
আরও পড়ুন
এ কাজ করতে পরিবার বাধ্য করে কি না— জানতে চাইলে সে বলে, ‘না, বাধ্য করে না। আমি নিজেই এটি করি। সময়টা উপভোগ করি। পরিবারকেও সহযোগিতা করা হয়।’
কথা হয় চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র লোকমানের সঙ্গে। একটি স্মার্টফোনের কভার ও রাবার দিয়ে জাদু দেখায় সে। হাতের তালুতে একসঙ্গে দুটি রাবার পেঁচানো থাকে। তালুর ওপর থেকে মোবাইলের কভার। হঠাৎ একটা তালি দিলেই রাবার মোবাইলে পেঁচিয়ে যায়। হাতের এমন কৌশল দেখিয়ে টাকা উপার্জন করে শিশুটি। প্রতিদিন ৩০০-৫০০ টাকা আয় হয়। সেই টাকা তুলে দেয় মার হাতে। এ ছাড়া পাঁচ বছরের ছোট ভাই বাবুলকে অ, আ, ক, খ শেখায় সে।
খুদে জাদুকর লোকমান বলে, আমার বাসা চকরিয়ায়। সপ্তাহে ৩-৪ দিন বিচে আসা হয়। পর্যটকদের রাবার দিয়ে জাদু দেখাই। তারা মজা পায়, আমিও আনন্দ পাই। অনেকে রাবারের জাদুর কৌশল শিখতে চায়, তাদের শেখাই। আমার পরিবারে ছয় সদস্য। বাড়তি এই ইনকামে ভালোই চলছে গোটা পরিবার।
মায়াবতী ও লোকমানের মতো প্রতিদিন কক্সবাজারের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী বিচ পয়েন্টে শত শত শিশু নিজেদের প্রতিভা দেখিয়ে বাড়তি টাকা উপার্জন করছে। সেই টাকা তারা তুলে দিচ্ছে বাবা-মার হাতে। ফলে পরিবারে ফিরছে সচ্ছলতা, সেই সঙ্গে শিশুরা অন্ধকার জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। এমন আট শিশুর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানায়, কারও পরিবারই তাদেরকে উপার্জনের পথে আসতে বাধ্য করেনি। বরং নিজ থেকে তারা এ পথে এসেছে। বাড়তি ইনকাম হওয়ায় তারাও বেশ খুশি।
আলাপ হয় শিশু জান্নাতের সঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ পরিচিত মুখ সে। ‘আমার মন বসে না শহরে, ইট-পাথরের নগরে, তাই তো আইলাম সাগরে, তাই তো আইলাম সাগরে’— কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সবার মুখে মুখে গানটি। মূলত শিশু জান্নাতের গাওয়া গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এখন সে পরিচিত মুখ। সাবই তার গান শুনতে চায়। গান গেয়েই বর্তমানে সে মামা-বাবা আর তিন ভাই-বোনের সংসার চালায়।
জান্নাত জানায়, শহরতলীর ঘোনারপাড়া কাদেরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। স্কুল ছুটির পর অবসর সময়ে শিক্ষক ও সহপাঠীদের গান শোনায়। গানের প্রতিভার পাশাপাশি পড়াশোনায়ও ভালো করছে সে। এ কারণে সবাই তাকে আদর করে।
‘আমি তো গানের মাধ্যমে সবাইকে বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করি। গান শুনে সবাই খুশি হয়। খুশি হয়ে যে যা দেয় তা-ই নিই। পরে টাকাগুলো মার হাতে তুলে দিই।’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কক্সবাজারের বাসিন্দা জারিফ জানান, গান গেয়ে সারা দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে জান্নাত। তাকে এখন সবাই চেনে। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষ তাকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছে। এখন তাকে দেখে অনেকে নিজের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে উপার্জনের চেষ্টা করছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জান্নাতকে দেখে কক্সবাজারের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের মধ্যে উপার্জনের আগ্রহ দেখা দিয়েছে। ছোটবেলা থেকে এমন আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে শিশুরা জানায়, তাদের প্রত্যেকের রয়েছে তিন/চারজন ভাই-বোন। বাবারা স্থায়ী কোনো চাকরি করেন না। কেউ দিনমজুর, কেউ ঝালমুড়ি বিক্রেতা, কেউ ভ্যান কেউ-বা রিকশাচালক। মায়েরা গৃহিণী, কেউ আবার অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। সারা বছর অভাব-অনটনে সংসার চলে। আর প্রথম চাপটা পড়ে তাদের পড়াশোনার ওপর। পড়াশোনা চালিয়ে যেতেই তারা বাড়তি টাকা উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে।
কথা হয় কক্সবাজারের কলাতলী বিচের ঝালমুড়ি বিক্রেতা জাহাঙ্গীরের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। সে বলে, আমরা পাঁচ ভাই-বোন। বাবা-মার উপার্জনে ঠিক মতো সংসার চলে না। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ারও একটা খরচ আছে। এ কারণে অল্প অল্প টাকা সঞ্চয় করে ঝালমুড়ির ব্যবসা শুরু করি। সারা দিন যা আয় হয় তা দিয়ে এখন ভালোই চলছে সংসার, পাশাপাশি চলছে আমার পড়াশোনার খরচ। আমার মতো অনেকেই এখন সৈকতে এসে কিছু একটা করে পরিবারকে সহযোগিতা করছে।
পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়ে কথা হয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু ও সমন্বয় উইং) তানিয়া খানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শিশুদের নিয়ে আমাদের বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে পথশিশুও আছে। তাদের কল্যাণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।’
এআর/এমএআর/