হতাশা-নির্যাতন-বঞ্চনায় বিঘ্নিত রোহিঙ্গা শিশুর ‘মানসিক স্বাস্থ্য’
তিন বছর বয়সে মুখে কথার খই ফুটত শিশু আলেয়ার (ছদ্মনাম)। সাড়ে চার বছর বয়স হতেই হঠাৎ কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ বা ১৬ বছর বয়সী ছেলেশিশুদের দেখলেই ভয় পেত, আঁতকে উঠত; কান্না করত আলেয়া। এভাবে কেটে যায় আরও ছয় মাস। উদ্বিগ্ন হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আলেয়াকে নিয়ে মা যান কক্সবাজার সদর হাসপাতালে।
কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই শিশুকে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণ আর কাউন্সেলিং করা হয়। অবশেষে মুখে কথা ফোটে আলেয়ার। উঠে আসে ভয়াবহ এক গোপন নির্যাতনের কথা। কথা বন্ধ করার কারণ, গুরুতর ট্রমায় ভুগছিল শিশুটি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যেটি ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) বা মানসিক আঘাত-পরবর্তী পীড়নমূলক মনোবিকৃতি’ হিসেবে পরিচিত। শ্রমজীবী বাবা ও দোকানি মায়ের অনুপস্থিতিতে প্রতিবেশীর হাতে একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছিল শিশুটি।
আলেয়াকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। মাকেও কাউন্সেলিং করেন ওসিসির মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট (এমএইচপিএসএস) কাউন্সিলর। গত জুন-জুলাইয়ে টানা কয়েকটি পর্বের কাউন্সেলিংয়ে শুধু মা নন, আলেয়ার মুখেও ফোটে হাসি। যে হাসি মিইয়ে গিয়েছিল গোপন নির্যাতন আর পরিবারের অবহেলায়।
ওসিসি সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেক শিশু এখানে আসছে। যাদের বেশির ভাগ নির্যাতন, ধর্ষণ, সহিংসতার শিকার হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য হলো এমন এক অবস্থা যা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতাকে বোঝায়। একজন ব্যক্তি শারীরিকভাবে সুস্থ হলেই সম্পূর্ণ সুস্থ নয়, তার মন-মানসিকতা যেমন সুস্থ হতে হবে, তেমনি সুস্থ সামাজিক অবস্থাও জরুরি।
আরও পড়ুন
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শারীরিক স্বাস্থ্যের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিক স্বাস্থ্য। শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো ধরা পড়ে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য ব্যতিক্রম। উপসর্গ বা কারণগুলো বাইরে থেকে দেখা যায় না, বুঝতে হয়। এক্ষেত্রে সহজে ও সহসা সমস্যাগুলো ধরতে না পারা মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও বেশি বাধাগ্রস্ত করে। শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাধাগুলো চিহ্নিত এবং তা থেকে শিশুদের মুক্ত রাখাও জরুরি।
কোমলমতি শিশুদের স্বপ্নগুলো না বুঝে নিরাপত্তার অজুহাতে বয়ঃসন্ধিকালে কন্যাশিশুদের ঘরবন্দি করে রাখা, ছেলেশিশুদের জীবিকার সন্ধানে পাঠানো ছাড়াও অপহরণ, নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। অথচ এসবের সঙ্গে যে কোনো শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে যে জড়িত, সে ধারণা নেই মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা অধিকাংশ রোহিঙ্গা অভিভাবকের। অথচ ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ একটি সর্বজনীন মানবাধিকার।
কর্তব্যরত চিকিৎসক ওই শিশুকে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণ আর কাউন্সেলিং করা হয়। অবশেষে মুখে কথা ফোটে আলেয়ার। উঠে আসে ভয়াবহ এক গোপন নির্যাতনের কথা। কথা বন্ধ করার কারণ, গুরুতর ট্রমায় ভুগছিল শিশুটি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যেটি ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) বা মানসিক আঘাত-পরবর্তী পীড়নমূলক মনোবিকৃতি’ হিসেবে পরিচিত। শ্রমজীবী বাবা ও দোকানি মায়ের অনুপস্থিতিতে প্রতিবেশীর হাতে একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছিল শিশুটি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডলসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য একটি সর্বজনীন মানবাধিকার। স্বাস্থ্য বলতে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং সবার জন্য তা প্রযোজ্য। অথচ আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিই না। বিশেষ করে যারা বিপর্যস্ত ও দলিত জনগোষ্ঠী। এক্ষেত্রে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বেশি উপেক্ষিত, বিশেষ করে তাদের নারী ও শিশুরা।
‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তো নিজ দেশ, বাড়ি-ঘর, ভাষা, সংস্কৃতি, নিজস্ব মতামত ও স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে এখানে (বাংলাদেশ) এসেছে। অনেক নৃশংসতা তারা দেখেছে। এ কারণে তাদের নারী ও শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। তাদের মধ্যে স্ট্রেস, বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা বেশি। যা শিশুদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে বড় বাধা। এজন্য যেমন চিকিৎসা দরকার, পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যাতে বিপর্যয় না ঘটে সেজন্য তাদের কোমল মনেরও যত্ন দরকার। তাদের প্যারেন্টিং কেমন হবে, খেলাধুলার পরিবেশ এবং হোস্ট কমিউনিটির আচরণ কেমন হবে, তা বিবেচনায় যত্নশীল হলে মানসিক রোগ থেকে অনেকখানি মুক্ত রাখা সম্ভব। যারা মানসিক সমস্যায় ভুগছে তাদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।’
অথচ ঘরে ও বাইরে শ্লীলতাহানি, ইভটিজিংসহ ধর্ষণের মতো ভয়াবহ নির্যাতন, পারিবারিক অভাব-অবহেলা, শিখন-পাঠনে বঞ্চনা, হতাশা, রোহিঙ্গা কমিউনিটির নিরাপত্তা অজুহাত ও সাংস্কৃতিক ট্যাবুতে চরম মাত্রায় বিঘ্নিত রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য। কোমল প্রাণের স্বপ্নগুলো না বুঝে নিরাপত্তা অজুহাতে বয়ঃসন্ধিকালে কন্যাশিশুদের ঘরবন্দি করে রাখা, ছেলেশিশুদের কাজে পাঠানো ছাড়াও অপহরণ, নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এসবের সঙ্গে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য যে জড়িত, সে ধারণাই নেই অধিকাংশ রোহিঙ্গা অভিভাবকের।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সম্প্রতি নতুন করে আসা ৫০ হাজার রোহিঙ্গাসহ সবমিলিয়ে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু। এসব শিশুর মধ্যে অনেকের জন্ম হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। এসব শরণার্থী শিবিরে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করে। দাতা সংস্থাগুলোর অনুদান কমে যাওয়া, নানা ধরনের নতুন সমস্যা ও অনিশ্চিত প্রত্যাবাসনের মতো জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। যার বড় প্রভাব ফেলছে শিশুদের ওপর।
প্রতি ১০ শিশুর একজন নির্যাতিত, ৮ শতাংশ শিশুশ্রমে
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের শিশুদের ওপর সহিংসতার বিষয়টি লোকচক্ষুর বাইরে রাখা হলেও সেখানে এটি খুবই সাধারণ ঘটনা। ক্যাম্পের কেস ওয়ার্কারদের তথ্য বিশ্লেষণ করে ইউনিসেফ বলছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা শিশু বাড়িতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। প্রায় আট শতাংশ রোহিঙ্গা শিশুকে শিশুশ্রমে বাধ্য করা হয়। এসব শিশু ভারি বোঝা বহন থেকে শুরু করে মাঠের কাজ করে থাকে, যা নির্যাতনমূলক।
জাতিসংঘের এ বিশেষ সংস্থা বলছে, কক্সবাজারে বসবাসরত রোহিঙ্গা শিশুদের একটি বড় অংশ উদ্বেগ, হতাশা, অস্বস্তি ও অন্যান্য মানসিক চাপজনিত সমস্যায় ভুগছে। যে শিশুরা সহিংসতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য মানবিক সংকটের সম্মুখীন হয়, তারা মানসিক ও সামাজিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শরণার্থী শিবিরের জটিল পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত পরিষেবার জন্য রোহিঙ্গা শিশুরা নানারকম নির্যাতনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে মানবপাচার, শিশুবিয়ে, শিশুশ্রম ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা যা তাদের মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক বিকাশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে।
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী এলাকার ১২নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অ্যাকশন এইড পরিচালিত উইমেন ফ্রেন্ডলি স্পেস (ডব্লিওএফএস) সেন্টার সূত্রে জানা যায়, এ ক্যাম্পে ৩০ হাজার ১২০ জন বাসিন্দার মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। সেখানে ১৫ হাজার ৭৫৩ শিশুর বসবাস।
সেখানকার ডব্লিওএফএস-এর কেস ম্যানেজার ঝুমা প্রিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা আসেন নানা সমস্যা নিয়ে। আমরা শুনি, কোনো কোনো সমস্যায় পরামর্শ দিই। বেশির ভাগ সমস্যা মূলত জেন্ডার বেইজ ভায়োলেন্স (জিবিভি)। নারীদের সঙ্গে অনেক মেয়ে শিশু আসে। পাঁচ বছর বয়সী ছেলে শিশুও আসে। যারা নানা সময়ে নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, অপহরণের মতো ঘটনার শিকার। অভিভাবক মায়েদের অনেকে শিশুর কেসগুলো শেয়ার করেন। দুঃখজনক হলো, তারা শুধু বলতেই আসেন, কিন্তু সমাধান চান না। কারণ, নিরাপত্তার অজুহাত। আবার যেসব রোহিঙ্গা নারী (মা) সন্তানের ধর্ষণ, ইভটিজিংসহ শারীরিক নির্যাতনের কেস (ঘটনা) নিয়ে আসেন তারা বিষয়গুলো গোপন রাখতে চান। ধর্ষণের মতো ঘটনাতেও তারা আইনি সহায়তা নিতে আগ্রহী হন না। কেউ আইনি সহায়তা চাইলে আমরা ব্লাস্টের সঙ্গে ট্যাগ করে দিই।
বয়ঃসন্ধিতে কন্যাশিশুদের ওপর পারিবারিক ‘লকডাউন’
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে ঝুমা প্রিয়া বলেন, এখানে দল বেঁধে অনেক মেয়েশিশু আসে। আসলে ওদের ভালো লাগে। এখানে প্লে-কর্নার, গল্পের বই, আড্ডায় আড্ডায় হাতের কাজ, সেলাইয়ের কাজ শেখানো হয়। কিন্তু বয়স ১২ হতেই অর্থাৎ বয়ঃসন্ধির সময় ওরা আসা বন্ধ করে দেয়। প্রথমে দু-তিনজন, এরপর পুরো গ্রুপ। কারণ, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ করে কন্যাশিশুদের বয়ঃসন্ধিকাল হলো চরম ভয়ের। যেটা মূলত ভ্রান্ত ধারণা। নিরাপত্তার অজুহাতে এক্ষেত্রে বিয়েতেই সমাধানের পথ খোঁজেন তারা। বিয়ের আগ পর্যন্ত ঘরবন্দি রাখা হয় কন্যাশিশুদের।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১১ ও ১২-এ খোঁজ নিয়ে ঝুমা প্রিয়ার অভিজ্ঞতা ও তথ্যের প্রমাণও মেলে। ঘরবন্দি এক শিশুর সঙ্গে কথা হয় চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেস সেন্টারে। রাশিদা মেহের (ছদ্মনাম) নামে এক কন্যাশিশু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডব্লিওএফএস-এ আসতে আমার ভাল লাগত। এখন আসি না। কারণ, বাবা। বাবা বলেছে, এখন আমার ঘরের বাইরে যেতে মানা। লার্নিং সেন্টারেও যাওয়া বন্ধ।
রাশিদার ঘরবন্দি বোবাকান্না ও মানসিক পীড়ন
রাশিদা মেহের বলেন, ‘শেখা-জানা, খেলা ও পড়ার জন্য দুটোই (ডব্লিওএফএস ও লার্নিং সেন্টার) আমার ভীষণ ভালো লাগার জায়গা। কিন্তু আমি আর যেতে পারি না। যেতে চাইলে মা বকে, মারে। খুবই মন খারাপ হয়, কান্না পায়। কতক্ষণ ঘরে বন্দি থাকা যায়। জানালায় ভর করে বাইরে তাকিয়ে থাকি। আমার মতো দল বেঁধে অন্য বন্ধুরা যারা যেত, ওদের ভাগ্যেও তা-ই জুটেছে।’
আরও পড়ুন
পরিবারের সবার ছোট এ কন্যাশিশু জানায়, তার বড় তিন বোন ও দুই ভাই। দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের আগে ডব্লিওএফএস ও লার্নিং সেন্টারে তাদের যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। করা হয় ঘরবন্দি। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালেই তাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা হয়। আগে বড় বোন আসত ডব্লিওএফএস-এ। তার হাত ধরে আসত আরেক কন্যাশিশু শাপলা (ছদ্মনাম)। এখন দুই বছর ধরে ১১ বছরের শাপলা আসে ছোট ভাইকে নিয়ে।
শাপলা জানায়, আমি কাজ শিখি, খেলি। বন্ধুরা আসে, মিশি ও গল্প করি। খুব ভালো লাগে। হাতের কাজ শিখেছি। দুটা ব্যাগ, চারটা বালিশের কাভার বানিয়েছি। ওয়ালমেট বানানোও শিখেছি ডব্লিওএফএস-এ। তবুও ভয় পাই, মন খারাপ হয়, এই বুঝি আমারও এখানে আসা বন্ধ হয়ে যায়।
ধর্মীয় আর কুসংস্কারে ‘বিয়েতে’ই সমাধান দেখে পরিবার
রোহিঙ্গা অভিভাবক, ইউএনএইচসিআর, স্থানীয় প্রশাসন ও রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধর্মীয় ভুল ধারণা, মিয়ানমারের সংস্কৃতি, সামাজিক সম্মানহানি ও নিরাপত্তা অজুহাতকে অনেক বড় করে দেখেন বেশির ভাগ অভিভাবক। ঘরে-বাইরে নিরাপত্তার উদ্বেগ, শিশুশ্রম, নির্যাতন, কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, লিঙ্গ-সহিংসতা ও যৌন নির্যাতন যে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি, সেই ধারণাই যেন নেই অভিভাবকদের।
তেমনই একজন অভিভাবক শামসুল আলম। ক্যাম্পে তিনি আরবির শিক্ষক। পাঁচ কন্যার কারোরই বিয়ে দেননি। বয়ঃসন্ধির কারণে ১৬ বছর বয়সী বড় মেয়েসহ তিন কন্যাশিশুকে তিনি রেখেছেন ঘরবন্দি। সমাজ কল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) পরিচালিত লার্নিং সেন্টারে যাওয়াও বন্ধ।
জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এত পড়ে কী হবে? আমি তো পড়াচ্ছি। আমিই ওদের আরবি পড়াই। কত খারাপ ঘটনা ঘটে ক্যাম্পে, মান-সম্মানের প্রশ্ন! বিয়ে দিতে পারলে লেটা চুকে যায়।’
এভাবেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘরবন্দি জীবন, বিয়ে কিংবা মানসিক নির্যাতন যে শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা মানতেই নারাজ শামসুল আলম। বলেন, ‘শরীরের যত্নই নেওয়া হয় না সেখানে মন…। এটা-ই হয়ে আসছে। আমার বংশে মেয়েদের এভাবে বিয়ে হয়ে যায়।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত শিশুদের নিরাপত্তা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে সেফ দ্য চিলড্রেন। সেখানকার রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার তথ্য তুলে ধরে এক নারীশিশু সুরক্ষাকর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসে আসা শিশুদের বিষণ্নতা, মন খারাপের বিষয়গুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করি। বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্বেগ, কষ্ট, নির্যাতন ও গোপন নিপীড়নের কোনো ঘটনা থাকলে তারা তা প্রকাশ করে। প্রতি মাসেই দু-একটি ধর্ষণের ঘটনা শুনতে হয়। পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা তো প্রায়ই শুনতে হয়, মাঝেমধ্যে আসে নির্মম হত্যার ঘটনাও। তবে, গত বছর থেকে বাবা-মায়ের মধ্যে পারিবারিক বিচ্ছেদ এবং কোমলমতি শিশুদের সামনেই সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। যেটার সঙ্গে সরাসরি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য জড়িত।
গার্লস ফ্রেন্ডলি স্পেসে আসা অনেক শিশুকে মারাত্মক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেখেছেন ওই সুরক্ষাকর্মী। বলেন, গার্লস ফ্রেন্ডলি স্পেসে বড় শিশুরা আসে। চাইল্ড ফ্রেন্ডলি স্পেসে সব শিশুরই আসার সুযোগ আছে। কিন্তু রোহিঙ্গা কমিউনিটির মধ্যে আমরা এখনও তাদের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা ভাঙতে পারিনি। যে কারণে একটা বয়সে এসে ফ্রেন্ডলি স্পেসগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা ভলান্টিয়ার পাঠাই, খোঁজ নিই, ডাকি; কিন্তু অধিকাংশ শিশুকে আসতে বাধা দেয় পরিবার।
রোহিঙ্গা শিশুর মানসিক বিকাশে বড় বাধা শিক্ষায় সীমিত সুযোগ
রোহিঙ্গা শিশুসুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সেখানকার ৩৩টি ক্যাম্পেই রয়েছে তাদের কার্যক্রম। রোহিঙ্গা শিশুসুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় শিশুর কেস ম্যানেজমেন্ট, সমাজভিত্তিক শিশুসুরক্ষা কমিটির কার্যক্রম (সিবিসিপিসি), প্যারেন্টিং অ্যাওয়ারনেস, কমিউনিটি অ্যাওয়ারনেস ও রেফারেল সার্ভিস কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া, নির্যাতিত, পাচারের শিকার শিশুকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া, ফস্টার কেয়ার গিভার-এর কাছে হস্তান্তর এবং পুনর্বাসনের কাজও করে সরকারি সংস্থাটির কর্মীরা।
১২নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন শিশুসুরক্ষাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ডোর টু ডোর শিক্ষার সুযোগ এখানে খুবই কম। কমিউনিটি বেইজড লার্নিং সেন্টার (সিবিএলএস) গত বছর থেকে চালু হয়েছে। যা সব ক্যাম্পে নেই। আবার যে কয়টা ক্যাম্পে আছে তাও পুরোপুরি নয়। সংগত কারণে এটা বড় সমস্যা। ফলে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেশিশুরা যাচ্ছে শিশুশ্রমে, কন্যাশিশুদের করা হচ্ছে ঘরবন্দি।
‘প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ঘরে ও বাইরে নানাভাবে নির্যাতন, নিপীড়নের কারণে মানসিক সমস্যার কথা জানিয়েছে ১৫ শতাংশের বেশি শিশু। নিরাপত্তাহীনতা এড়াতে কন্যাশিশুদের বাল্যবিয়েতে অভিভাবকরা খুঁজছেন সমাধান। শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে কুসংস্কার আর নিরাপত্তার অজুহাতের বাধা ভাঙা যেত’— যোগ করেন তিনি।
শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার নাম বাল্যবিবাহ-শিশুশ্রম
সমাজভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটি কার্যক্রম (সিবিসিপিসি) ও শিশুর কেস ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রমে জড়িত এক কর্মী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ২০১৯ সাল থেকে কাজ করছি। ঘরে-বাইরে শিশু নির্যাতন, অবহেলা, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক পীড়নসহ নানা ধরনের মনোসামাজিক যন্ত্রণায় কাতর রোহিঙ্গা শিশুরা। এর মধ্যে ১১ বা ১২ বছরের পর ছেলেশিশুদের জন্য শিশুশ্রম এবং কন্যাশিশুদের বাল্যবিবাহ যেন অনিবার্য। যা তাদের সরাসরি মনোবিকাশে আঘাত করে। যেখান থেকে চাইলেও শিশুরা বের হতে পারে না, পারিবারিক ও ধর্মীয় ভ্রান্ত ধারণার কারণে।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘সহিংসতার মুখে পড়া অনেক শিশু নিরাপত্তাহীনতার কারণে আইনগত ব্যবস্থা নিতে চায়, কিন্তু পারে না। কারণ, অভিভাবকদের অনীহা এবং পরিস্থিতিতে পড়ে পাচার হবার ভয়ে। যা প্রকারান্তরে সশস্ত্র অপকর্মে জোরপূর্বক নিয়োগ এবং অপহরণের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দিকে নিয়ে যায়।’ সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যার ভালো সমাধান হলো, শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের জন্য সব ক্যাম্পে বা ক্যাম্পজুড়ে শিক্ষার কার্যক্রম চালু করা। যেটা গত সাত বছরেও সম্ভব হয়নি। আগুনে পুড়ে যাওয়া কমিউনিটি বেইজড লার্নিং সেন্টারগুলো (সিবিএলএস) বরং বন্ধ হয়ে গেছে, যা আর চালু হয়নি। বিস্তৃত পরিসরে সিবিএলএস না থাকাটা শিশুদের নিরাপত্তা ও মঙ্গলের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
সশস্ত্র সংগঠনের উদ্বেগজনক তৎপরতায় শিশুদের ব্যবহার
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কক্সবাজারে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা ও সহিংসতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ, মানবপাচার ও মুক্তিপণ আদায়ের মতো অবৈধ কার্যকলাপ ঘিরে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)সহ ক্যাম্পকেন্দ্রিক ইসলাম মাহাদ, মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন গ্রুপসহ অন্যান্য সশস্ত্র গ্রুপের কারণে ক্রমশ উদ্বেগ বাড়ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে। ক্যাম্পে ক্যাম্পে অপরাধী চক্রের কর্মকাণ্ড ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান শিশুদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে অপহরণ ও সশস্ত্র কাজে তাদের নিয়োগ ও ব্যবহার উদ্বেগজনক। ফলে শিশুহত্যা, জখমের ঘটনাও ঘটছে। যা অন্যান্য শিশুর মনে গুরুতর প্রভাব ফেলার পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তুলছে।
আরও পড়ুন
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের পাশাপাশি ৯, ১০, ১১, ১৮ ও ১৯ নম্বর ক্যাম্প থেকে শিশু, কিশোর-বালকদের ভয় দেখানো, কারসাজি ও প্রলুব্ধ করে সশস্ত্র গ্রুপে যোগ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এজন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা অথবা দৈনিক ৮০০ টাকা রোজগারের প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে।
‘শিশুসুরক্ষা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ প্রতিবেদন যা বলছে
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ‘শিশুসুরক্ষা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ সংক্রান্ত শিশুসুরক্ষা পরিস্থিতি মনিটরিং (সিপিএসএম) অক্টোবর-২০২৪ এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি অতি-ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিকরা। বিশেষ করে শিশুরা, যেখানে মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ শিশু। দারিদ্র্যের উচ্চহার, সীমিত মৌলিক পরিষেবা এবং জনাকীর্ণ জীবনযাত্রা ও বদ্ধমূল কুসংস্কারের কারণে সব ধরনের সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণ, শ্রম, বাল্যবিবাহ, অবহেলা ও মানসিক যন্ত্রণার মতো শিশুসুরক্ষাবিরোধী সমস্যাগুলো বাড়ছে।
প্রতিটি ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক ও কমিউনিটি নেতাদের হুমকি ও হয়রানি করা হচ্ছে। চাইল্ড প্রটেকশন সাব-সিস্টেম (সিপিএসএস)-এর স্বেচ্ছাসেবকদের সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা হয়রানির তথ্য উঠে এসেছে। তাদের ভয়ে ১৪ শতাংশ কর্মীর অনুপস্থিতির তথ্য উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে।
তিন মাসে ৩২ রোহিঙ্গা শিশু অপহরণ
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রমাণভিত্তিক শিশুসুরক্ষা পরিস্থিতির বিস্তৃত বিশ্লেষণ উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সেখানে শিশুর মানসিক বিকাশের নেপথ্যের কারণ ও সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি ভুক্তভোগী শিশুদের বক্তব্য, আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে পরামর্শও তুলে ধরা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে শিশুসুরক্ষায় উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরা বলা হয়েছে, শুধু এ বছরের সর্বশেষ তিন মাসে নয়াপাড়া ও কুতুপালং এলাকার কয়েকটি ক্যাম্প থেকে ৩২ শিশুকে অপহরণ করা হয়েছে। যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
বেঁচে ফিরলেও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অপহৃত শিশুরা
অপহরণের চার মাস পর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা এক শিশুর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। সে নিজের ছবি ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টের কাছে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে। কুতুপালং এলাকার একটি ক্যাম্পে বসবাসকারী ওই শিশু চলতি বছর প্রলোভনে পড়ে প্রথমে অপহরণ এবং পরে পাচারের শিকার হয়। তাকে পাচার করে মিয়ানমারে পাঠানো হয়। সেখানে জান্তা সরকারের পক্ষে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় ওই শিশুকে।
১৬ বছর বয়সী ওই শিশু [জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু] বলে, ২০১৭ সালে আট বছর বয়সে এখানে আসি। আসার আগে মিয়ানমারে চাচা ও দাদাকে চোখের সামনে মরতে দেখেছি। এখানে আসার পর নির্যাতনের বিষয়টি তাই স্বাভাবিক মনে হতো। মানিয়েও নিয়েছিলাম। আমি স্কুলেও যাওয়া শুরু করেছিলাম। তিন বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের বাকি সদস্যদের চিন্তায় নিজেকে কাজে জড়িয়ে ফেলি। কখনও গ্যাস সিলিন্ডার দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতাম। কখনও দোকানে কাজ করতাম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাসিক বেতনের প্রতিশ্রুতিতে আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যায় একটা দালাল চক্র। তারা জোরপূর্বক আমাকে মিয়ানমারে নিয়ে যায়। বুঝতে পারি আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। কয়েকদিন ট্রেনিংয়ের পর আমাকে রাখাইনে পাঠানো হয়। সেখানে মৃত্যু আর জখম মানুষের কান্নায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
‘ভাবিনি বেঁচে ফিরতে পারব। তবে, কল্পনাতীত হলেও সেটাই হয়েছে। কোনো রকমে জানে বেঁচে পালিয়ে ফের এখানে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না, সবকিছু অনিশ্চিত! পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। ওরা (সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা) মাকে হুমকি দিয়েছে, ছোট ভাইকে নির্যাতন করে বলেছে, আমাকে আবার ফিরতে হবে। তা না হলে জানে মেরে ফেলবে। ভয়ে মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি, পরিবারকে অন্য ক্যাম্পে সরিয়ে নিয়েছি। নিজে রাতে থাকি আরেকটি ক্যাম্পে। অনিশ্চিত জীবন। জানি না কতক্ষণ….।’
বয়ঃসন্ধিকাল যেন অভিশাপ
কক্সবাজারের স্থানীয় ও রোহিঙ্গা কমিউনিটিভিত্তিক সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা (সিআইএমএইচপিএসএস) প্রকল্পের আওতায় ইউএনএফপিএ কর্তৃক ২০২৩ সালে পরিচালিত জরিপ বলছে, দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতায় উদ্বেগজনক প্রভাব পড়ছে। এ জরিপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা তাদের বয়ঃসন্ধিকালকে অভিশাপ হিসেবে তুলে ধরেছে।
জরিপে অংশ নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে প্রতি পাঁচজনের দুজন রোহিঙ্গা শিশু (৪২ শতাংশ) বলছে, তারা দৈনন্দিন জীবনে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। আট শতাংশ মনে করে, তারা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জ্ঞান সম্পর্কে রোহিঙ্গা শিশুরা মনে করে, শিক্ষার পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জ্ঞানও বাড়ে। তবে, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞান পরিবারের আয়ের ওপরও নির্ভর করে বলে মনে করে তারা।
শুধু অভিভাবক নয়, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা শিশুদেরও
জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ রোহিঙ্গা শিশু ও কিশোর-কিশোরী বিশ্বাস করে, মানসিক অসুস্থতা হয় মাদকের অপব্যবহারে। ৭০ শতাংশ মনে করে বাহ্যিক চাপের কারণে এবং ২১ শতাংশ মনে করে জেনেটিক (উত্তরাধিকার) কারণে। বাহ্যিক চাপের মধ্যে স্থানচ্যুতি, বেকারত্ব, ক্যাম্পের অবস্থা ও নির্যাতনকে দায়ী করে তারা। ৫৭ শতাংশ বিশ্বাস করে, মানসিক অসুস্থতা হলো ব্যক্তিগত দুর্বলতা। প্রতি পাঁচজনের একজন বিশ্বাস করে, মানসিক অসুস্থতা মানে সৃষ্টিকর্তার শাস্তি। প্রতি পাঁচজনের একজন বিশ্বাস করে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ‘পাগল’।
প্রতিকারে খেলাধুলায় গুরুত্ব, আছে ভ্রান্ত ধারণাও
প্রতি পাঁচজনের চারজন (৮৩ শতাংশ) মনে করে, সেবায় মানসিক অসুস্থতা নিরাময় সম্ভব। জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশই (৯৬ শতাংশ) বিশ্বাস করে, খেলাধুলা মানসিক রোগ নিরাময় বা উপশম করতে পারে। ৩৬ শতাংশ মনে করে, বিয়ে মানসিক রোগের নিরাময় ঘটায়।
নির্যাতিত ৩৭ শতাংশ শিশু-কিশোর গুরুতর সিপিএসএসে ভোগে
জরিপের মূল অনুসন্ধানে উঠে আসে, শিশু ও কিশোর-কিশোরী যাদের নির্যাতন বা আঘাতমূলক ঘটনার অভিজ্ঞতা আছে তাদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৭ শতাংশ) মাঝারি থেকে খুব গুরুতর পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার উপসর্গে (সিপিএসএস) ভোগে।
রোহিঙ্গা শিশুসুরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত সুলেমান নামে এক কিশোর ঢাকা পোস্টকে বলে, ‘বৈষম্য, নির্যাতনমূলক আচরণ রোহিঙ্গা শিশুদের চিন্তা ও অনুভূতিকে আলোড়িত করে। মানসিকভাবে দুর্বল করে, উদ্বেগ-বিষণ্নতায় ভোগায়। কারণ, তারা মিয়ানমারে ফেরা বা এখানে থাকার স্বাধীনতা বা নিরাপত্তার আশা দেখে না। শুধু বাঁচার জন্য আশ্রয়ের মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত ও আচরণগুলো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে। যেখান থেকে মুক্তির আশার আলো সহসা নেই।’
পরিবারের রেশন কার্ড বাতিলেও বিয়ে থামেনি শিশু আসমার
বাল্যবিবাহ ও লিঙ্গবৈষম্যের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আসমা তারা (ছদ্মনাম) নামে এক ১৫ বছরের শিশু ঢাকা পোস্টকে বলে, পারিবারিক চাপ উপেক্ষা করেছিলাম। এনজিওকে জানিয়েছিলাম বিয়ে ঠেকানোর জন্য। বিয়ে প্রথমে আটকেও যায়। প্রশাসন থেকে রেশন কার্ড বাতিলের নোটিশও করে। যাতে বিয়ে না দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে থেমে থাকেনি। শুধু ধর্মীয় ও সামাজিক অজুহাতে আমাকে তুলে নিয়ে অন্য ক্যাম্পে গোপনে বিয়ে দেওয়া হয়।
আসমা বলে, ‘বিয়ের বিষয়টা মানতে না পারলেও এটাই এখন বাস্তবতা। যদিও আমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা অন্য কোনো কিশোরীর ক্ষেত্রে ঘটুক, তা চাই না।’
আরও পড়ুন
বিয়ে-নির্যাতন ঠেকানোর অদম্য নাম ফাতেমা
শিশুসুরক্ষার কর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাল্যবিবাহ প্রায়শই ঘটে যখন পরিবারগুলো তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারে। তাদের আর্থিক বোঝা হিসেবে দেখে। সঙ্গে আছে নিরাপত্তার অজুহাত এবং ধর্মীয় অন্ধ বাধ্যবাধকতা। সেখানে কুতুপালংয়ের ৯নং ক্যাম্পের ফাতেমা দেখিয়েছে অনন্য দৃষ্টান্ত।
সে বলে, ‘কখনও কখনও আমরা আমাদের বয়সী মেয়েদের বিয়ের কথা শুনি। এটা ঘটে কারণ, আমাদের বাবা-মা বিবেচনা করে যে মেয়েরা পরিবারে বোঝা হয়ে থাকে বা যখন ইভটিজিং বা কোনো ধরনের নির্যাতন বা সহিংসতার ঘটনা ঘটে। তখন আমাদের বয়স (বয়ঃসন্ধিকাল) হলে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। এটা ভীষণ যন্ত্রণার, কষ্টের। যেটা ছেলেদের কম। আবার এই একই সময়ে কিশোর-কিশোরীদের ভিন্ন ভিন্ন চোখে দেখা হয়। লিঙ্গবৈষম্যের এই অনুভূতি বেশি পীড়াদায়ক, মানসিক যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দেয়। এর সমাধান হলো বিয়ে না করা এবং স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করা।’
‘বাবা-মাকে বুঝিয়েছি। প্রথমে শোনেনি, মারধর করত। তবে, হাল ছাড়িনি। পরে সোশ্যাল কাউন্সিলর এসে মাকে বুঝিয়েছেন, মা বাবাকে। বিয়ের বিষয়টি বাদ গেছে, স্কুলের পথটিও খুলে গেছে।’
ফাতেমার দাবি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে অবহেলা, উপেক্ষা করা বা সব ধরনের নির্যাতন বা দুর্ব্যবহার না করার অনুশীলন জরুরি। এটা সম্ভব হলে নিমিষেই বদলে যাবে চিত্র।
দীর্ঘ সময় ধরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকো সোশ্যাল সাপোর্ট (এমএইচপিএসএস) কাউন্সিলর হিসেব কাজ করছেন নাজনীন আক্তার। নানা কারণে মারাত্মকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশু ও তার পরিবারকে কাউন্সেলিং করেছেন তিনি।
নাজনীন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শিশুরা ডিপ্রেশন অ্যান্ড অ্যাংজাইটিতে ভোগে দুটি কারণে। একটি সামাজিক, অপরটি সাধারণ কারণে। সামাজিক কারণ বলতে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, বয়ঃসন্ধিতে ভয়— এসব বোঝায়। সাধারণ কারণগুলো বেশি মারাত্মক। মূলত নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা, পারিবারিক বিচ্ছেদ— এগুলো সাধারণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
‘শিশুরা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে ভালোটা বন্ধ করে দেয়, পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে, মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। এর মধ্যে পারিবারিক চাপ কিংবা ঘরের নিরাপত্তার অভাব রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও বেশি নাজুক করে তোলে।’
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘প্যারেন্টিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক রোহিঙ্গা অভিভাবক জানেনই না জেন্ডার বেইজ সহিংসতা কী? শিশুর প্রতি আমাদের আচরণ কেমন প্রভাব ফেলতে পারে? আসলে শিশুসন্তানরা কী চায়, কী বলতে চাচ্ছে— এগুলো আমাদের শুনতে হবে, জানতে হবে। অ্যাকটিভ লিসেনিং শিশুদের স্বাভাবিক রাখে। একই সঙ্গে শিশুদের বিরুদ্ধে ব্লেম গেম বন্ধ করতে হবে। তা না হলে শিশুদের মধ্যে সেলফ ব্লেমিং প্রবণতা তৈরি করে।
সর্বোপরি রোহিঙ্গা অভিভাবকদের অন্তত কর্ম ও জীবিকার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে, শিশুদের শিক্ষার বিস্তৃত সুযোগ ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে যে মারাত্মক মানসিক স্বাস্থ্য-জটিলতা দেখা দিচ্ছে তা নিরসন বা কমিয়ে আনা সম্ভব— মনে করেন এমএইচপিএসএস কাউন্সিলর।
অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার মতো সুরক্ষাকর্মী খুবই কম। দাতা সংস্থাগুলোর উচিত শিক্ষার পাশাপাশি মেন্টাল হেলথকে গুরুত্ব দিয়ে ফান্ডিং বাড়ানো। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে শিশুরা ট্রমায় ভুগছে। সেগুলো শনাক্ত করে মানসিক স্বাস্থ্যও যে সমান গুরুত্বপূর্ণ তা রোহিঙ্গা কমিউনিটিকে বোঝাতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর পরিবার গুরুত্ব দিলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। যারা শুধু শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করবেন তাদের প্রশিক্ষিত করা জরুরি। সেদিকে দাতা সংস্থাগুলোর নজর দেওয়া উচিত।
জেইউ/এমএআর/