কর্মচারীদের মালিক সাজিয়ে ৩৩০০ কোটি টাকা লুট করে এস আলম গ্রুপ
মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স ও সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের নামে ধাপে ধাপে পাঁচ বছরে ৩৩০০ কোটি টাকার ঋণ দেখিয়ে লুটপাট করে এস আলম গ্রুপ। গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের (আইবিবিএল) সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমের নেতৃত্বে দূর-সম্পর্কের খালাতো ভাই বা আত্মীয়দের নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে রপ্তানির কথা বলে ওই টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। মূলত তারা ছিলেন এস আলম গ্রুপের বেতনভুক্ত কর্মচারী।
মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী গোলাম সারওয়ার চৌধুরী ও ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মালিক গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী আপন দুই ভাই। অন্যদিকে, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের কর্ণধার আরিফুল ইসলাম চৌধুরী আহসানুল আলমের আত্মীয় হিসেবে সবাই জানেন। অথচ তারা সবাই এস আলম গ্রুপ থেকে মাসিক বেতন গ্রহণ করতেন। ব্যবসার সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হতো এস আলম গ্রুপ থেকে। তাদের কাজ ছিল কেবল জাল নথিপত্রে সই করা।
অবৈধ এ কৌশলের সঙ্গে ব্যাংকটির ইসি কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. সেলিম উদ্দিন ও আইবিবিএলের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর ড. আবদুস সালামের সম্পৃক্ততা এবং একই সঙ্গে তাদের দায়িত্ব অবহেলার সরাসরি প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল সোমবার চারজনসহ মোট ছয় কর্মকর্তা অনুসন্ধান টিমের মুখোমুখি হয়েছেন। এর মধ্যে সেলিম ও আবদুস সালাম সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন। লুটপাটের অধিকাংশ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তারা। পরবর্তীতে লিখিতভাবে প্রশ্নের জবাব দেবেন— এমন আশ্বাস দিয়েছেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদের তারা নার্ভাস ছিলেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গতকাল এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমকে তলব করা হলেও তিনি হাজির হননি। এ বিষয়ে তার পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগও করেননি। যত দূর জানি তিনি ইতোমধ্যে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এ ছাড়া আইবিবিএলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. তানভীর আহমদেরও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গতকাল সোমবার যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তারা হলেন- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. সিরাজুল করিম, খুরশীদ-উল-আলম, ইসি সদস্য নাজমুল হাসান এবং ইসি কমিটির সদস্য ও স্বতন্ত্র পরিচালক ড. মো. ফসিউল আলম। অন্যদিকে, গত রোববার ইসলামী ব্যাংকের ইসি কমিটির সদস্য ও পরিচালক সৈয়দ আবু আসাদ, মো. কামরুল হাসান, মোহাম্মদ সালেহ জহুর, সাইদ মোহাম্মদ কাশেম, জামাল মোস্তফা চৌধুরী, পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও স্বতন্ত্র পরিচালক মোহাম্মদ সোলাইমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ব্যাংকটি বর্তমান এমডি মনিরুল মাওলা ও সাবেক এমডি মাহবুব আলম, পরিচালক প্রফেসর (ড.) কাজী শহীদুল আলম সময় চেয়ে আবেদন করেছেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের চাকতাই, জুবলী রোড ও খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ধাপে ধাপে ৩৩০০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হয়। এর মধ্যে মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ১০৫৪ কোটি, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের নামে ১০৮৪ কোটি এবং সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টসের নামে ১১১৯ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। স্থানীয় মার্কেট থেকে কাঁচামাল ক্রয় করে রপ্তানি করার শর্তে ওই ঋণ ছাড় করা হয়।
ঋণের টাকা আত্মসাতে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তরে বিভিন্ন জাল নথি তৈরি করা হয়। এটি করতে মানিলন্ডারিং আইনের পুরাতন কৌশল ব্যবহার করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের ব্যাংক হিসাবে পৌঁছে ওই টাকা হাওয়া হয়ে যায়।
ইসলামী ব্যাংকের ৩৩০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয় গত বছরের প্রথমদিকে। তখন অভিযোগটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক সিরাজুল হককে। তিনি কয়েক দফা চিঠি দিয়ে নথিপত্র চেয়ে পাঠালেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে অভিযোগটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদকের উপপরিচালক ইয়াছির আরাফাতের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান দলকে। এ দলের অপর দুই সদস্য হলেন- উপপরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও সহকারী পরিচালক রণজিৎ কুমার কর্মকার।
অভিযোগ অনুসন্ধানে আগামী ৮ ও ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৭ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তলব করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে তাদের হাজির হওয়ার পাশাপাশি পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া চিঠিতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের চাক্তাই শাখার গ্রাহক মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ, জুবিলী রোড শাখার গ্রাহক ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স ও খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস নামীয় ঋণ পরিদর্শন ও মনিটরিং সংক্রান্ত কর্মকর্তার ভূমিকার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও নথিসহ হাজির হতে বলা হয়েছে।
৮ ডিসেম্বর যাদের তলব করা হয়েছে তারা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক মো. জুবাইর হোসেন, যুগ্ম পরিচালক সুনির্বাণ বড়ুয়া, বেলাল হোসেন, উপপরিচালক খোরশেদুল আলম, দেবাশীষ বিশ্বাস, মুহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বাবুল, রুবেল চৌধুরী, যুগ্ম পরিচালক অনিক তালুকদার ও অতিরিক্ত পরিচালক ছলিমা বেগম।
৯ ডিসেম্বর তলব করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সৈয়দ মু. আরিফ-উন-নবী, অতিরিক্ত পরিচালক শংকর কান্তি ঘোষ, মো. আব্দুর রউফ, মো. মঞ্জুর হোসেন খান, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, মো. শোয়াইব চৌধুরী, উপপরিচালক লেনিন আজাদ পলাশ ও পরিচালক মো. সরোয়ার হোসাইনকে।
জানা যায়, এসব কর্মকর্তার মধ্যে ১৩ জনকে ২০ ও ২১ নভেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছিল। তারা কেউই হাজির হননি। ফলে আবারও তাদের তলব করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদিও সরোয়ার হোসাইন রোববার তার লিখিত বক্তব্য দাখিল করেছেন।
আরএম/