নথিতে এত গোপন কী ছিল?
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘রাষ্ট্রীয় গোপন নথি সরানো’র যে অভিযোগ তুলেছে মন্ত্রণালয়, সেই নথিতে কী এমন গোপন বিষয় আছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসক নেতারা। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত কোনো গোপন নথি ওই মন্ত্রণালয়ে থাকার কথা নয় বলেও মনে করছেন তারা।
চিকিৎসক নেতাদের প্রশ্ন, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। রাষ্ট্রের মালিকানা যদি নাগরিকদের হয়, তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য তারা জানতে পারবেন না কেন? সেখানে কী এমন গোপনীয় বিষয় আছে!
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় যে মামলা দায়ের করেছেন তাতে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ ও ‘রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার’ অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলাতে গ্রেফতার হয়ে তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন; যার প্রতিবাদে মুখর দেশের সাংবাদিক সমাজ।
রোজিনা ইসলাম যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সেই প্রতিষ্ঠান ‘প্রথম আলো’ বলছে, গত কিছুদিন ধরে যেহেতু কোভিডের কারণে স্বাস্থ্য খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেহেতু তিনি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেছেন। তার রিপোর্টে স্বাস্থ্য খাতের অনেক অনিয়ম উঠে এসেছে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগের অনিয়মসহ তার বেশকিছু রিপোর্ট আলোচিত হয়েছে। আমাদের শক্ত ধারণা, এসব রিপোর্টের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের আক্রোশের শিকার রোজিনা ইসলাম।
রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন সিনিয়র সাংবাদিককে এভাবে হেনস্তার নেতিবাচক প্রভাব তো অবশ্যই আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ওপর পড়বে। বিশেষ করে গণমাধ্যমের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে একটা বৈরি সম্পর্ক, এতদিন যেটি নিয়ন্ত্রণে ছিল এখন সেটি নিয়ন্ত্রণহীন করে দেওয়া হলো। এখানে আসলে কোনোভাবেই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।’
তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা অবশ্যই বিতর্কের অবকাশ রাখে। আমরা জানি, এর আগে রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করেছেন। এর কারণে তার ওপর একটা ক্ষোভ থাকতে পারে। সেই ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে রোজিনাকে তারা শায়েস্তা করতে এ ঘটনা ঘটাতে পারে।
একই ধরনের মত দেন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিজের (এফডিএসআর) উপদেষ্টা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। রাষ্ট্রের মালিকানা যদি নাগরিকদের হয় তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য তারা জানতে পারবে না কেন? সেখানে কী এমন গোপনীয় বিষয় আছে?
তিনি বলেন, রোজিনা ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রণালয়ে ও সচিবালয়ে রিপোর্ট করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, রোজিনাকে তারা চেনেন না। তাই চিঠিতে জনৈক রোজিনা লিখেছেন। এটা অস্বাভাবিক। কারণ, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে অসংখ্য রিপোর্ট করেছেন এবং সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে তাদের মধ্যে একটা উদ্দেশ্যমূলক চিন্তাভাবনা আছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেমনটি বলেছে, রোজিনা ইসলাম একজন সচিবের অনুপস্থিতিতে তার রুমে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্রের ছবি তুলেছেন। আমি জানি না বিষয়টি সত্যি কি না। যদি এমনটি হয়ে থাকে তাহলে এটা ভালো হয়নি। আর যদি এটা ভুল বা অসত্য হয়, তাহলে তো সাংবাদিক হিসেবে তিনি নিউজ করতেই পারেন। এটা নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। আমি আজ মন্ত্রণালয়ে যাব, বিষয়টি ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে তারপর আপনার সঙ্গে কথা বলব।
তিনি বলেন, আমরা সবসময় অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছি। বিষয়গুলো নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হোক, আমরাও চাই। কিন্তু যে ফাইলটা আপনি-আমি দেখতে পারব না, রাষ্ট্রীয় গোপনীয় কোনো জিনিস, সেটা কি দেখা বা তার ছবি তোলা উচিত?
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের এমন বক্তব্যের সঙ্গে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করেন ইকবাল আর্সলান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে সেখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় দলিল ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেশের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ দলিল থাকার কথা না, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি এমন কোনো দলিল থেকেই থাকে, তাহলে তো সেটি খোলামেলাভাবে টেবিলের ওপর থাকার কথা না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন কোনো নথি তো অবশ্যই তালাবদ্ধ কোনো ড্রয়ার বা নিরাপদ কোনো জায়গায় থাকার কথা।
আর্সলান আরও বলেন, যদি এরকম কোনো নথি এভাবে থেকেই থাকে, আর তিনি সেগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেও থাকেন, তাহলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন যারা আছেন, তারা আলোচনা করে বা অন্যভাবে বিষয়টাকে সমাধান করতে পারতেন। থানা-পুলিশ পর্যন্ত যাওয়া একদমই ঠিক হয়নি।
স্বাচিপ সভাপতি আর্সলান আরও বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, রোজিনা ইসলামের আগের সংবাদগুলোর কারণেই তাকে এরকম হেনস্তা করা হয়েছে। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ কোনো নথি যেখানে-সেখানে বা টেবিলে পড়ে থাকার কথা নয়। একজন ব্যক্তি তার রুমে গিয়ে রাষ্ট্রীয় এমন গুরুত্বপূর্ণ নথি এভাবে পেয়ে যাবে, এরকম হওয়ার কথাও নয়। আমরা বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছি না।’
নথিতে এত গোপনীয় কী তথ্য ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আব্দুন নূর তুষারও। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় বলছে সচিবের রুমে ‘স্টেট সিক্রেট’ ছিল। কিন্তু সেখানে কী ধরনের স্টেট সিক্রেট থাকতে পারে? বাংলাদেশে কী এমন মহাজীবাণুর গবেষণা চলছে বা পারমাণবিক করোনা চুল্লি বানাচ্ছে যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্টেট সিক্রেট থাকবে? গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়েছিল, এমন একটা স্টেট সিক্রেটের উদাহরণ কেউ দিতে পারবে?'
জনপ্রিয় এ গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব আরও প্রশ্ন রাখেন, রোজিনাকে আটকের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বা তার কর্মস্থলে অবহিত করা হয়েছিল কি? তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখার অধিকার কোন আইনবলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পেয়েছেন? আর তাকে আটকের পর রিমান্ড আবেদনের কারণ কী? এটা কী এমন গুরুতর অপরাধ যে তাকে রিমান্ডে নেওয়া লাগবে?
রোজিনা ইসলামের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনা অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফও। অন্যদিকে রোজিনা ইসলাম ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলব, এ রকম একটি ঘটনায় সরকার ও সাংবাদিকদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হোক—এ রকম কোনো সন্দেহ যদি থাকে, তাহলে সরকার সেটি দূর করার চেষ্টা করবে।’
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ওই সাংবাদিক (রোজিনা ইসলাম) টিকা আমদানি সংক্রান্ত এমন কিছু নথি সরিয়েছিলেন, যেগুলো প্রকাশ হলে দেশের ক্ষতি হতে পারত।
তাকে আটকে রেখে কোনো ধরনের নির্যাতন বা আঘাত করা হয়নি দাবি করে তিনি আরও বলেন, তার কাছে থাকা ফাইলগুলো ফেরত নেওয়ার জন্য তাকে বড়জোর আধাঘণ্টা আটক রাখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এরপর পুলিশ উপস্থিত হয়ে ঘটনার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
গত সোমবার (১৭ মে) পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় তাকে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত ৯টার দিকে তাকে সচিবালয় থেকে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়। ওই রাতেই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। পরদিন সকালে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে আদালতে তোলা হয়। আদালত রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান।
সোমবার রোজিনার সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরা কথা বলতে না পারলেও মঙ্গলবার আদালত থেকে বের হওয়ার সময় রোজিনা ইসলাম বলেন, ‘আমার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে, আমার সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে রিপোর্ট করায় আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।’
টিআই/এনএফ/এমএআর/