সময় বেঁধে দিয়ে নির্বাচন নয়, তবে অংশ নেবে আ. লীগ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা রকম আলোচনা শুরু হয়েছে। কত দিনের ভেতরে নির্বাচন হবে, সেটিও জানতে চাচ্ছেন অনেকে। বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ চাইলেও নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। তবে, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ বলছেন, আগে নির্বাচন পরে সংস্কার। কেউ বলছেন, সংস্কার আগে পরে নির্বাচন।
কেউ কেউ আবার বলছেন, এ সরকারের দায়িত্ব সংস্কার করা নয়, নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। নির্বাচিত সরকারই সব সংস্কার করবে। এদিকে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল মুখ খুললেও এখনও নিশ্চুপ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ। অন্যান্য দলের মতো বর্তমান সরকারকে নির্বাচনের সময় বেঁধে দিতে না চাইলেও ভেতরে ভেতরে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। ছন্নছাড়া দলটিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করতে এবং মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে নির্বাচনকে ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে দেখছেন তারা। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে এমন তথ্য দিয়েছেন।
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল মুখ খুললেও এখনও নিশ্চুপ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ। অন্যান্য দলের মতো বর্তমান সরকারকে নির্বাচনের সময় বেঁধে দিতে না চাইলেও ভেতরে ভেতরে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। ছন্নছাড়া দলটিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করতে এবং মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে নির্বাচনকে ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে দেখছেন তারা
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া। এটি এখন সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলোরও প্রত্যাশা।
‘তবে, নির্বাচনের কোনো রূপরেখা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনে সব প্রগতিশীল দল অংশ নেবে, জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগও অংশ নেবে।’
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ হলো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দলকে পরিচালনা করছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ।
এদিকে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। দেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে আট সদস্যের ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারকে।
কমিশনে সদস্য হিসেবে আরও রয়েছেন- শিক্ষাবিদ, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ডা. জাহেদ উর রহমান, শাসন প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ মীর নাদিয়া নিভিন, ইলেকট্রনিক ভোটিং ও ব্লকচেইন বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ সাদেক ফেরদৌস এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যে তৃতীয় দফায় বৈঠক করেছেন। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজত, বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং বাম গণতন্ত্র মঞ্চ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), এ বি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের দুটি গ্রুপ বৈঠকে অংশ নিয়েছে। সংলাপ শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
বৈঠকে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে কথা হয়েছে— উল্লেখ করে মাহফুজ আলম বলেন, ‘সবগুলো বিষয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে। কমিশনগুলোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে কীভাবে রাষ্ট্রের সংস্কার ঢেলে সাজানো হবে এবং সেটার সমান্তরালে কীভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম বা প্রস্তুতি চলমান থাকবে, সেসব নিয়েই আলোচনা হয়েছে।’
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংলাপে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে বলেছি। মাস, দিনকাল নিয়ে আমরা কথা বলিনি। ওনারা বলছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তারা সবকিছু দেখছেন।’
অন্যদিকে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোয় সংস্কার এনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, “সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য কিছু মৌলিক সংস্কার করতেই হবে। সেই সংস্কারের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময় দরকার অন্তর্বর্তী সরকারের। দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মাণের জন্য তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) এসেছেন। তাদের কাজ হচ্ছে, জাতির সামনে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। এজন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের সংস্কার করতেই হবে। সংস্কার সফল হলে নির্বাচনও সফল হবে।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ দেশে যেভাবেই হোক দুটি দলের প্রতি মানুষের সমর্থন আছে। দল দুটি ছাড়া অতীতেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন করলে গ্রহণযোগ্য হবে না। সংস্কার করবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। এরা (অন্তর্বর্তী সরকার) কী নির্বাচিত প্রতিনিধি? স্বাধীনতার নামে অরাজকতা তৈরি করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে একটি জাতি চলতে পারে না।’
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করা হয়েছে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল, তারাও কিন্তু ইনডেমনিটি দিয়েছিল। তাদের কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আজ যারা এ দেশে শত শত পুলিশকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, সরকারি সম্পত্তি দখল এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করে ইনডেমনিটি দিয়ে নিজেদের রক্ষার স্বপ্ন দেখছে, তাদের ১৫ আগস্টের পর ইনডেমনিটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা নিই না।’
‘আপনারা তো আত্মগোপনে রয়েছেন। কীভাবে রাজপথে ফিরবেন’— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ও বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা পরাজিত হয়েছি। আমরা হেরে গেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবদিকে আক্রমণ করা হচ্ছে। দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আজ ৫০০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ খেতে হচ্ছে। থানা থেকে অনেক অস্ত্র লুট হয়েছে। এ অস্ত্র কারা ব্যবহার করেছে? সেই অস্ত্র দিয়ে আমাদের দলের নেতাকর্মী ও তাদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেতাকর্মীদের আর যেন ক্ষতি না হয় সেই কারণে আমরা কিছুটা সময় নিচ্ছি। কিছুদিনের মধ্যে আমরা আবার রাজপথে ফিরে আসব।’
দলীয় সূত্র মতে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। সব নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন। কেউ কেউ আত্মগোপনে যেতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। কাউকে নেওয়া হয়েছে রিমান্ডে। তবে, অনেকেই গ্রেপ্তার থেকে বাঁচতে লুকিয়ে রয়েছেন। অন্তত পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এভাবেই আত্মগোপনে থাকবেন দলটির শীর্ষনেতারা। তাদের মতে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার একটা সুযোগ আসবে। তখন নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে সক্রিয় হওয়া যাবে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো আইনিভাবে মোকাবিলা করা যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা বলেন, দলের আজকের দুর্দিনের জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের যা করার উচিত ছিল না, তা-ই করেছিলাম। এখন তার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হচ্ছে। এটা থেকে আগামীতে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দলকে গোছাতে হবে। তবে, আগামীর নির্বাচন আমাদের জন্য কষ্টকর হলেও মাঠে থাকতে হবে। দল গোছাতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুতের সংকট, মব জাস্টিসসহ দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, সেসব বিষয় বিশ্বপরিমণ্ডলে তুলে ধরতে হবে।
বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশন সংস্কার করছে। সেটা যেন আবার দলীয়করণ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক দলই চাচ্ছে তাদের লোক নতুন কমিশনে আসীন হোক। সেটা হলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে— মনে করেন ওই নেতা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বর্তমানে মানুষের কথা বলার অধিকার নাই। নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জয় ও পুতুল থেকে শুরু করে সব নেতার বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছে। এত কিছুর পরও আমরা চাই দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরে আসুক।
আরও পড়ুন
‘এখন মানবাধিকার বা মানুষের অধিকার বলতে কিছু নাই। অতীতের ন্যায় আগামীতেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের ভোটের রায়ের ওপর আস্থা রাখে আওয়ামী লীগ। অনতিবিলম্বে দেশে নির্বাচন হওয়া দরকার।’
এ বিষয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এ বি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে যে সব মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, সেগুলো করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়ার কথা আমরা বলেছি।’
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার ফাঁকে জাপানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনএইচকে-তে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। সরকারের মূল লক্ষ্য সংস্কারকাজ। এটি শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার উদ্দেশ্য নেই আমাদের। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
এমএসআই/এমএআর/