১০ মিনিটের হানিফ ফ্লাইওভার পাড়ি দিতে লাগছে ২ ঘণ্টা
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৩০টি জেলার যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করে তোলার জন্য ২০১৩ সালের অক্টোবরে চালু হয় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের উড়ালসড়কটি শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান হয়ে চানখারপুল গিয়ে শেষ হয়েছে।
শুরুর দিকে কেবল চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলীয় জেলার মানুষ ফ্লাইওভারটি দিয়ে যাতায়াত করলেও পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর খুলনা-বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানুষ উড়ালসড়কটি ব্যবহার করে যাতায়াত শুরু করে। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইওভারে গাড়ির চাপও বাড়তে শুরু করে।
প্রতিদিন চারটি পয়েন্ট দিয়ে কয়েক হাজার ঢাকামুখী যানবাহন প্রবেশ করে এই ফ্লাইওভারে। এগুলো হলো- শনির আখড়া, ডেমরা, সায়েদাবাদ ও ধোলাইপাড়। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলার পরিবহন, ব্যক্তিগত গাড়ি শনির আখড়া পয়েন্ট দিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারে প্রবেশ করে। সিলেট ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলার পরিবহন ও যাত্রীরা ডেমরা টোল প্লাজা দিয়ে উড়ালসড়কে প্রবেশ করে। বরিশাল ও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ধোলাইপাড় পয়েন্ট দিয়ে ফ্লাইওভারে ওঠে। এ ছাড়া সায়েদাবাদ থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অঞ্চলের গাড়ি এই উড়ালসড়ক ব্যবহার করে ওঠা-নামা করছে
প্রতিদিন চারটি পয়েন্ট দিয়ে কয়েক হাজার ঢাকামুখী যানবাহন প্রবেশ করে এই ফ্লাইওভারে। এগুলো হলো- শনির আখড়া, ডেমরা, সায়েদাবাদ ও ধোলাইপাড়। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলার পরিবহন, ব্যক্তিগত গাড়ি শনির আখড়া পয়েন্ট দিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারে প্রবেশ করে। সিলেট ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলার পরিবহন ও যাত্রীরা ডেমরা টোল প্লাজা দিয়ে উড়ালসড়কে প্রবেশ করে। বরিশাল ও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ধোলাইপাড় পয়েন্ট দিয়ে ফ্লাইওভারে ওঠে। এ ছাড়া সায়েদাবাদ থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অঞ্চলের গাড়ি এই উড়ালসড়ক ব্যবহার করে ওঠা-নামা করছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, যে পরিমাণে যানবাহন হানিফ ফ্লাইওভারে প্রবেশ করছে সেগুলো বের হওয়ার চিত্র ভয়াবহ নাজুক! প্রতি মিনিটে এই ফ্লাইওভারে ১০০টির বেশি যানবাহন প্রবেশ করলেও বের হতে পারে না তার অর্ধেকও। ফলে ধীরে ধীরে তৈরি হয় তীব্র যানজট। যেটা এক সময় পুরো ফ্লাইওভারে ছড়িয়ে পড়ে। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেঁসে যেতে হয় সাধারণ যাত্রীদের।
যানজটের অন্যতম কারণ ‘এক্সিট পয়েন্টে জটলা’
হানিফ ফ্লাইওভারে সবসময় ঢাকামুখী অংশে যানজট লেগে থাকে। এর অন্যতম কারণ ফ্লাইওভার থেকে গাড়িগুলো বের হওয়ার প্রধান দুই পয়েন্ট- গুলিস্তান ও চানখারপুলের নাজুক চিত্র! মূলত এই দুটি টোল প্লাজা দিয়ে সাধারণ যাত্রীরা ঢাকায় প্রবেশ করেন।
আরও পড়ুন
মাত্র দুই লেনের গুলিস্তান ও এক লেনের চানখারপুলের প্রবেশদ্বারে সবসময়ই যানবাহনের ‘জটলা’ লেগে থাকে। যে কারণে টোল প্লাজার সামনে এসে কচ্ছপের গতিতে এগোতে থাকে পরিবহনগুলো।
হানিফ ফ্লাইওভারের গোলাপবাগ দিয়ে কমলাপুর, সায়েদাবাদ, মালিবাগ, রামপুরাগামী যানবাহন নামে। গোলাপবাগে নামতে গিয়েও প্রতিদিন যানজটে আটকে থাকতে হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, ফ্লাইওভার থেকে নামার আগেই বাসগুলো দাঁড় করিয়ে যাত্রী নামায়। ফলে পেছনে থাকা গাড়িগুলো আটকে যায়। এ ছাড়া ফ্লাইওভার থেকে দূরপাল্লার বাসগুলো নেমে সায়েদাবাদ কাউন্টারে যাত্রী নামায়। যাত্রী নামাতে সময় নেওয়ায় সেখানেও যানজট তৈরি হয়।
ফ্লাইওভার দিয়ে এক প্রকার ফ্রি-স্টাইলে চলাচল করে বাসগুলো। সন্ধ্যার পর থেকে সায়েদাবাদ অংশে ‘স্টপেজ’ বানিয়ে যাত্রী ওঠানোর কাজ করে দূরপাল্লার পরিবহনগুলো। অন্যদিকে, সারা দিন লোকাল বাসগুলো ফ্লাইওভারের রাজধানী মার্কেট, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী পয়েন্টে যাত্রী ওঠা-নামানোর কাজ করে
ফ্লাইওভারের গুলিস্তান টোল প্লাজার বহির্গমন অংশের মুখে লোকাল বাসের স্টপেজ। ফ্লাইওভার থেকে নেমে বাসগুলো ইউটার্ন নেয় টোল প্লাজার সামনে থেকে। ফলে এ অংশের ফ্লাইওভার থেকে নামতে যাত্রীদের দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়।
এ ছাড়া গুলিস্তানের মতো ব্যস্ত এলাকায় ফ্লাইওভার থেকে গাড়িগুলোকে নামতে বেশ বেগ পেতে হয়। সাধারণ মানুষ, ফুটপাত ও মার্কেটে আসা মানুষের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে সেখানে। রাস্তা সংকুচিত হয়ে এক লেনে চলাচল করতে হয় যানবাহনগুলোকে। কচ্ছপের গতিতে গাড়িগুলো চলায় একপর্যায়ে সেখানে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট।
ফ্লাইওভারের ঢাকা মেডিকেল প্রান্তের অবস্থা আরও করুণ। এখানে রাত-দিন দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। গুলিস্তান থেকে এই প্রান্তের উড়ালসড়ক এক লেনের হওয়ায় একটার পেছনে আরেকটা গাড়ি আটকে থাকে। পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার যানবাহন চানখারপুল দিয়ে চলাচল করায় ফ্লাইওভারের গাড়িগুলোকে দীর্ঘ সময় আটকে রাখতে হয় ট্র্যাফিক পুলিশকে। ফলে ফ্লাইওভারে যানজট বাড়তে থাকে।
ফ্লাইওভারে কোনো গাড়ি অচল হয়ে গেলেই ‘মহাবিপদ’
যেহেতু গুলিস্তান থেকে ঢাকা মেডিকেল প্রান্ত পর্যন্ত মাত্র একটি লেন দিয়ে ফ্লাইওভারে যানবাহন চলাচল করে, সেক্ষেত্রে কখনও কোনো পরিবহনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বা অচল হয়ে পড়লে পুরো ফ্লাইওভারেই ‘ভয়াবহ’ যানজট তৈরি হয়। মাত্র এক লেন হওয়ায় গাড়ি সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ারও উপায় থাকে না। যতক্ষণ না গাড়িটি সরানো যায় ততক্ষণ এক লেন দিয়েই দুই পাশের গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হয়।
আরও পড়ুন
এদিকে, ফ্লাইওভারে অচল হয়ে পড়া গাড়ির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতে। সরেজমিনে দেখা যায়, উড়ালসড়কে কোনো একটি গাড়ি নষ্ট হলে চানখারপুল, বঙ্গবাজার, ঢাকা মেডিকেল সড়ক, বকশি বাজার রোডে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। এ সময় কোনো গাড়ি ফ্লাইওভারে প্রবেশ করতে পারে না, বেরও হতে পারে না।
আরও বিভিন্ন কারণে যানজট
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টোল প্লাজায় ধীরগতিতে টোল আদায়ের কারণে যানবাহনের লম্বা লাইন তৈরি হয়। এমনও দেখা যায়, যানবাহনের একটি লাইন সায়েদাবাদ পর্যন্ত চলে গেছে। আবার টোল দেওয়ার পরও সামনে যেতে গুলিস্তান পয়েন্টে যানজটে আটকে যাচ্ছে গাড়িগুলো। ফলে পেছনের গাড়িগুলো উড়ালসড়ক থেকে বের হতে পারছে না।
এ ছাড়া ফ্লাইওভার দিয়ে এক প্রকার ফ্রি-স্টাইলে চলাচল করে বাসগুলো। সন্ধ্যার পর থেকে সায়েদাবাদ অংশে ‘স্টপেজ’ বানিয়ে যাত্রী ওঠানোর কাজ করে দূরপাল্লার পরিবহনগুলো। অন্যদিকে, সারা দিন লোকাল বাসগুলো ফ্লাইওভারের রাজধানী মার্কেট, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী পয়েন্টে যাত্রী ওঠা-নামানোর কাজ করে।
ফ্লাইওভারের শনির আখড়া অংশের প্রবেশপথেও যাত্রীদের যানজটে পড়তে হয়। এর অন্যতম কারণ গণপরিবহন ও দূরপাল্লার বাসগুলোর যাত্রী ওঠা-নামা করা। বিশেষ করে সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত এবং বিকেল ৪টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এই যানজট ছাড়িয়ে যায় তিন থেকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত। রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড ও সানারপাড় পর্যন্ত এটি বিস্তৃত হয়।
আরও পড়ুন
এদিকে, পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকে চাপ বেড়েছে ফ্লাইওভারের ধোলাইপাড় অংশে। প্রায় প্রতিদিন টোল প্লাজার এই অংশে পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা তীব্র যানজট দেখা যায়।
ফ্লাইওভারের যানজটে অসহায় যাত্রীরা
দেশের চার বিভাগের সাধারণ মানুষের ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। এ ছাড়া প্রতিদিন শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ি, মাতুয়াইল, রায়েরবাগ, সাইনবোর্ড, ধোলাইপাড়, জুরাইন ও নারায়ণগঞ্জের হাজারও মানুষ এই ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে অফিস করছেন। কিন্তু উড়ালসড়কে সৃষ্ট যানজট তাদের মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন খায়রুল ইসলাম রাজিব। মাতুয়াইল থেকে প্রতিদিন মিরপুর-১ এ গিয়ে অফিস করেন তিনি। এই প্রতিবেদককে রাজিব বলেন, ‘প্রায় ছয় বছর হতে চলল চাকরির বয়স। আমার বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান মাতুয়াইলে থাকেন। যে কারণে একটু দূরে হলেও দৈনিক মিরপুরে আসা-যাওয়া করে অফিস করি। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে আর সম্ভব নয়! দেখা যায়, সকাল ১১টায় অফিস থাকলে ৮টায় বের হতে হয়। মাঝেমধ্যে দুই ঘণ্টায়ও হানিফ ফ্লাইওভার পাড়ি দেওয়া যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে (যানজট) বসে থাকতে হয়। ফ্লাইওভারে গাড়ির জটলা লাগলে সেটি শনির আখড়া ছাড়িয়ে মাতুয়াইল-সাইনবোর্ড পর্যন্ত চলে যায়। প্রতিদিন দুই-তিন ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে অফিসে যাওয়া দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে এখন।’
নিউ মার্কেটের একটি দোকানে চাকরি করেন আহসান রুবেল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টায় দোকানে পৌঁছাতে হয়। আগে যাত্রাবাড়ি থেকে সকাল ৯টায় বাসে চড়লে এক ঘণ্টায় পৌঁছাতে পারতাম। এখন এক ঘণ্টায় ফ্লাইওভার পাড়ি দিতে পারি না। প্রতিদিন মালিক কথা শোনায়। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা শহরে আর চাকরি করতে পারুম না।’
চানখারপুলে যেখানে ফ্লাইওভার শেষ হয়েছে, সেখানে রয়েছে দেশের স্বনামধন্য কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার করে যাতায়াত করেন। কিন্তু উড়ালসড়কের ভয়াবহ জ্যামে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসেই কেটে যাচ্ছে তাদের।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা পোস্টকে এক শিক্ষার্থী বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে পৌঁছানোটাই যেন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন ফ্লাইওভারে উঠলে আতঙ্কে থাকি, কতক্ষণে এই জ্যাম শেষ হবে আর গাড়িগুলো নামবে। কখনও কখনও পরীক্ষার আগে হাতে বেশি সময় নিয়ে বের হয়েও ফ্লাইওভারের জ্যামে ফেঁসে যাই। সড়ক হলে তো কিছু না কিছু করার উপায় থাকে, কিন্তু ফ্লাইওভারে কিছুই করার থাকে না। এসব দেখার যেন কেউ নেই!’
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে বসে থাকেন রোগীরা
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে ছুটে আসেন রোগীরা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের মানুষ চিকিৎসার জন্য ঢাকামুখী হলে হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। সে ক্ষেত্রেও ভোগান্তির শিকার হন রোগীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হয় তাদের।
নোয়াখালীর চাটখিল থেকে চিকিৎসার জন্য আসা ঢাকার ধানমণ্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি এক রোগী বলেন, ‘কয়েকদিন আগেই বুকে ব্যথা অনুভব করলে চাটখিলের একটি স্থানীয় হাসপাতালে যাই। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, আমার মাইনর স্ট্রোক হয়েছে। তারা পরামর্শ দেন, দ্রুত ঢাকার কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে। এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। চাটখিল থেকে শনির আখড়া তিন ঘণ্টার মধ্যে চলে আসলেও শুধু ফ্লাইওভার পাড়ি দিতে সময় লেগেছে দুই ঘণ্টা। অবস্থা ক্রিটিক্যাল থাকলেও ফ্লাইওভারে জ্যামে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না।’
আরও পড়ুন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয় বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছেন আহসান হাবিব। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমরা অধিকাংশ সময়ই জরুরি মুহূর্তে রোগীর পরিবার থেকে ফোন কল পাই। একজন মুমূর্ষু রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকলেও ফ্লাইওভারের জ্যামে অসহায় হয়ে বসে থাকতে হয়। মাঝেমধ্যে নিজেকেও অসহায় লাগে, যখন রোগীর স্বজনেরা গাড়িতে বসে কান্নাকাটি করেন, কাকুতিমিনতি করে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। আসলে তখন কিছুই করার থাকে না। আগে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটে ফ্লাইওভারটি পার হতে পারলেও এখন এক ঘণ্টায়ও সেটি সম্ভব হয় না।’
ট্র্যাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে দেশের ট্র্যাফিক শৃঙ্খলা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সড়কের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও ভোগান্তি কমেনি।
যাত্রী ও বাসচালকরা মনে করছেন, ফ্লাইওভারে যানজটের পেছনে ট্র্যাফিক পুলিশেরও দায় রয়েছে। মৌমিতা পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘এখন তো দেশে কেউ কাউরে মানতেছে না। গাড়ি নিয়ে যে যেখানে খুশি ঢুকে যাইতেছে। ট্র্যাফিক পুলিশও দেখি নির্বিকার। কিছু কয় না। আগে এই ফ্লাইওভার পাড়ি দিতে ২০ মিনিট লাগত, এখন দেড় ঘণ্টাতেও পারি না। গুলিস্তান, গোলাপবাগে গাড়িগুলা নামার পর ইচ্ছামতো টার্নিং নেয়। অনেকে ফ্লাইওভারের গোড়ায় যাত্রী ওঠা-নামা করায়। পুলিশও কিছু কয় না। তারা যদি ফ্লাইওভার থেকে গাড়ি নামার সঠিক ব্যবস্থা কইরা দিত, এই জ্যাম লম্বা হইতো না।’
তিশা পরিবহনের এক যাত্রী বলেন, ‘কুমিল্লা থেকে তিন ঘণ্টায় শনির আখড়া চলে আসলেও এই ফ্লাইওভার পাড়ি দিতে সময় লেগেছে দুই ঘণ্টা। ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখ ও বের হওয়ার রাস্তায় যে যার মতো গাড়ি থামিয়ে রাখে, যাত্রী ওঠা-নামা করায়। পুলিশও কিছু বলে না। এভাবে চলতে থাকলে এই ফ্লাইওভার দিয়ে আর যাতায়াত করা সম্ভব হবে না।’
এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) তালেবুর রহমান বলেন, ‘টানা বৃষ্টির কারণে সড়কে যানজটের পরিমাণ একটু বেড়েছে। এটার প্রভাব পড়েছে ফ্লাইওভারে। এ ছাড়া বিগত কয়েকদিনে গাড়ির চাপও বেড়েছে। সবমিলিয়ে এই জ্যামের সৃষ্টি। ট্র্যাফিক পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না, এমনটা নয়। গুলিস্তান থেকে শুরু করে চানখারপুল, গোলাপবাগে আমাদের পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন যানজট নিরসন করতে।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হানিফ ফ্লাইওভারের গাড়িগুলো গুলিস্তানে নামার সময় সঠিক প্রবাহটা পাচ্ছে না। এর কারণ লোকাল সড়কগুলোর ধারণক্ষমতা কমে এসেছে। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ট্র্যাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে গুলিস্তানের বিভিন্ন সড়কে ফুটপাত দখল থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ যানবাহন যেমন- ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বেড়েছে। ফলে যে গাড়িগুলো ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসছে, সেগুলো লোকাল সড়ক দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যেতে পারছে না। যে কারণে ফ্লাইওভারে জ্যাম দীর্ঘ হচ্ছে।’
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই হানিফ ফ্লাইওভারে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘দুই নদীর পানি কিন্তু কখনও এক নদী দিয়ে প্রবাহ করা সম্ভব নয়। হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে প্রতিদিন দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করছেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই উড়ালসড়কে গাড়ির চাপ আরও বেড়েছে। তবে, যে পরিমাণ গাড়ি ঢুকছে, সেগুলো বের হওয়ার সঠিক কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। ফ্লাইওভারের সংযোগ সড়কে কোনো রিং রোডের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফ্লাইওভারের নিচের সড়কেও বেহাল অবস্থা।’
সেক্ষেত্রে সমাধান কী— এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুল হক বলেন, ‘প্রথমে ফ্লাইওভার থেকে বের হওয়ার আশপাশের সকল সড়কে অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। ফুটপাত দখলমুক্ত, নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং কিছু রিং রোডের ব্যবস্থা করতে হবে। যেন গাড়ির বের হওয়ার প্রবাহটা ঠিক থাকে। এ ছাড়া ট্র্যাফিক পুলিশ ও ফ্লাইওভার অপারেটরদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’
এদিকে, ফ্লাইওভারের ‘ডিজাইন’ পরিকল্পনায় ত্রুটি দেখছেন ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যে পরিমাণে গাড়ি এই ফ্লাইওভারে প্রবেশ করছে, সেগুলো বের হওয়ার সময় মাত্র এক লেন ব্যবহার করতে পারছে। মূলত এখানেই জ্যামটা তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি, ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে। কারণ, যে কোনো উড়ালসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে গাড়িগুলো কীভাবে নামবে এবং বের হবে, সেই ডিজাইন তৈরি করতে হয়। এখানে সেই পরিকল্পনাটা সঠিকভাবে নেওয়া হয়নি।’
এ ক্ষেত্রে এই বিশেষজ্ঞ বর্তমান যানজট নিরসনে নিচের সড়কে নজরদারি বাড়াতে বলেছেন। তার কথায়, ‘ফ্লাইওভারের ওপরে নতুন কিছু করার তেমন সুযোগ নেই। যানজট কমাতে চাইলে নিচের সড়কগুলোতে এখন বেশি নজর দিতে হবে। প্রথমেই ফ্লাইওভারের নিচের সড়কগুলো সংস্কার করতে হবে, যেন ফ্লাইওভারে গাড়ির চাপ কমে আসে। এরপর ট্র্যাফিক পুলিশের নজরদারি বাড়াতে হবে, যেন গাড়িগুলো ফ্লাইওভার থেকে নেমে খেয়ালখুশি মতো ইউটার্ন না নিতে পারে এবং যাত্রী তুলতে না পারে।’
এমএআর/