৬ লাখ টাকা বেতন নিয়েও ওয়াসাকে দুর্নীতিতে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তাকসিম
>> ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ ঢাকা ওয়াসার
>> ১৫ বছরে হাজার-হাজার কোটি টাকা লোপাট
>> তিন হাজার ৬৭০ কোটি খরচ হলেও পানি পায়নি নগরবাসী
>> যোগ্যতা না থাকলেও এমডি, হয়ে ওঠেন বেপরোয়া
>> তাকসিমের বিদায় তবু রয়ে গেছে দুর্নীতির বল
২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে প্রথমবারের মতো নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। এরপর থেকে টানা ১৫ বছর ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মোট ৭ বার তার পদের মেয়াদ বাড়িয়েছে সরকার।
ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিমের সর্বশেষ মাসিক বেতন ছিল ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির মধ্যে এক লাফে তার বেতন বাড়ানো হয় পৌনে দুই লাখ টাকা। দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা অভিযোগ থাকার পরও তাকসিম একই পদে দীর্ঘ সময় থেকে যান সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে। সরকার পতনের পর গত ১৫ আগস্ট তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসায় তাকসিম যুগের অবসান ঘটে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করা হয়।
সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে সপ্তমবারের মতো এই পদে নতুন করে তিন বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম। ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার পানির দাম ১৬ বার বাড়িয়েছেন আলোচিত-সমালোচিত এই এমডি। বর্তমানে তিনি দেশে আছেন নাকি বিদেশে চলে গেছেন, সেটি নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তাকসিম এ খান এবং তার স্ত্রী ও সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
ঢাকা ওয়াসার ঋণ ২৫ হাজার কোটি টাকা
বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে— পানির স্তর নেমে যাচ্ছে বলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনার অজুহাতে বড় বড় প্রকল্প নেন এমডি তাকসিম এ খান। এরপর বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন তিনি।
পানির চাহিদা মেটানোর কথা উল্লেখ করে ২০১৯ সালের জুনে ‘পদ্মা-জশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প’ উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের সময় জানানো হয়, এই পানি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাবে। খরচ করা হয় তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফলাফল না এলেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ঋণ করতে হয় ঢাকা ওয়াসাকে।
ঢাকা শহরের পয়ঃবর্জ্য পাইপ লাইনের মাধ্যমে শোধন করে বালু নদীতে ফেলার লক্ষ্যে আফতাবনগরে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা ওয়াসা। গত বছর দাশেরকান্দি পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়, তিন হাজার ৪৮২ কোটি টাকার এই প্রকল্পেরও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। ঢাকা শহরের পয়ঃবর্জ্যের কথা বলা হলেও বাস্তবে নেওয়া হচ্ছে ড্রেনেজের বর্জ্য। এখানেও বড় অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের জন্য অনেক টাকা ঋণ করতে হয় ঢাকা ওয়াসাকে। সবমিলিয়ে ঢাকা ওয়াসা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
যোগ্যতা না থাকলেও এমডি, ১৫ বছরে হাজার কোটি টাকা লোপাট
ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না তাকসিম এ খানের। তবু ২০০৯ সালে তৎকালীন ওয়াসা বোর্ড তাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়ে দেন অদৃশ্য কারণে। তিনি বসে পড়েন এমডি পদে। সেই থেকে ঢাকা ওয়াসায় তাকসিম হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।
ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্যপরিষদের নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের তিন হাজার ২২১ কোটি টাকা এবং ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তাকসিম চক্র।
প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প নির্মাণে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকা দুর্নীতি করা হয়েছে। শোধনাগারের প্ল্যান্ট চালু রাখতে হাতিরঝিলের ময়লা পানি সেখানে নিয়ে শোধন করা হচ্ছে। এতে ঢাকা ওয়াসার বছরে গচ্চা যাচ্ছে ৫১২ কোটি টাকা, ২০২৭ সালে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৮২৫ কোটি টাকা।
পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্পেও হয়েছে দুর্নীতি। মূল সঞ্চালন লাইন নির্মাণে নিম্নমানের পানি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা।
ঐক্যপরিষদের নেতাদের হিসাব মতে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা ওয়াসার ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা খোয়া গেছে। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে সংস্থার সিস্টেম লস ছিল ৩৪.৮২ শতাংশ এবং বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৮২ শতাংশ।
সমবায় আইন অমান্য করে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি থেকে ৬২১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এছাড়া সমিতির মালামাল বিক্রি করা হয়েছে। তার আনুমানিক মূল্যও প্রায় শতকোটি টাকা। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে ৩৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকা লোপাটের প্রতিবেদন এসেছে। প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি হওয়ায় তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি সেসময়। তার সময়কালে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় ঢাকা ওয়াসা থেকে।
তাকসিমের বিদায়, তবুও রয়ে গেছে দুর্নীতির বলয়
ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে কথা বললেই চাকরি খোয়াতে হয়েছে এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। গত বছর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ওয়াসার এমডির স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় নিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগের মূল বিষয় ছিল তাকসিম এ খানের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি। তাকসিম নিজের ইচ্ছেমতো ওয়াসা চালান এবং যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের তিনি বরখাস্ত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে তিনি সেখানে দুর্নীতির সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন। সেবার নামে মানহীন পানি সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ওয়াসা থেকে তাকসিম পদত্যাগ করলেও তার দুর্নীতির সুবিধাভোগী বলয় এখনও রয়ে গেছে। এসব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র অসন্তোষ। নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হতো তাকসিমের অনুসারী জুনিয়র অফিসারদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ওয়াসার একজন নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, যারা এমডির কথা শুনেছে, তার দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেছে তারা সবসময়ই ঢাকা ওয়াসায় সুবিধা পেয়ে এসেছে, জুনিয়র হয়েও পুরস্কৃত হয়েছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনও তাদের পদে থেকে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। স্বচ্ছ ওয়াসা গঠনে তাদেরও অপসারণ করতে হবে। এখনও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন সৎ কর্মকর্তারা। এমডির পাশাপাশি ওইসব কর্মকর্তাদেরও ওয়াসা থেকে সরাতে হবে।
আরও পড়ুন
ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে বেশ কিছু দিন ধরে বিক্ষোভ করে আসছেন কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমডিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছেন তারা।
সংগঠনের সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, তাকসিমের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করলেই সেসব কর্মকর্তাদের ওপর চাপ নেমে এসেছে। কোনো কারণ প্রদর্শন ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হতো। কয়েকজন আদালতের আদেশ নিয়ে আসার পরও চাকরি করতে দেওয়া হয়নি। তার আমলে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে। সেই কারণে এমডিকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি ওয়াসা এমডিকে যারা সহযোগিতা করেছে, তাদেরও অপসারণ করতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন সরকার বলেন, ঢাকা ওয়াসা থেকে সাবেক এমডি তাকসিম চলে গেলেও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখনও রয়ে গেছে। তারা সাধারণ মানুষের অর্থ লুটপাট করে খাচ্ছে। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি, নইলে ঢাকা ওয়াসায় দুর্নীতি চলতেই থাকবে।
তাসকিম এ খানকে ঘিরে দুর্নীতি চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে : স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, ঢাকা ওয়াসার এমডি তাসকিম খানের চুক্তির মেয়াদ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। ১২ বছর ধরে তিনি একটার পর একটা চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। এই তথ্যগুলো, ছবিসহ তার দুর্নীতির চিত্র, এমনকি তার চেহারাও মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে গেছে। তাকে ঘিরে যে দুর্নীতি চক্র গড়ে উঠেছে, সেই চক্র এখনো ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় আছে। চক্রটির সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ এখনও সক্রিয় আছে কিংবা লুকিয়ে আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের হাসান আরিফ বলেন, যেখানে একটি বড় বাজেট বরাদ্দ থাকে এবং কর্মকাণ্ড থাকে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। দুর্নীতির পথ খুলে যায়। সে জায়গাগুলো বন্ধ করা আমাদের জন্য একান্ত জরুরি। যারা সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। ফাঁকফোকর দিয়ে যে দুর্নীতি হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে। কিন্তু আগামীতে এমন হলে আমার নজরে নিয়ে আসবেন।
তিনি আরও বলেন, অন্তত মূলনীতিটি যদি আমরা ঠিক করে দিয়ে যেতে পারি এবং সে ধারাবাহিকতা চললে আগামীতে দুর্নীতি কমে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। যদি আমরা ন্যায়-নীতি ঠিক করতে পারি দুর্নীতির এই জায়গাটা অনেকটা সীমিত হয়ে যাবে। আমাদের সামনে এখন অনেক বড় কাজ। অনেক দিনের জঞ্জাল জমে আছে। এটা এক-দুই দিনে ঠিক হবে না। সবার সহযোগিতা থাকলে ধাপে ধাপে সমাধান হবে।
এএসএস/এমজে