‘দুর্নীতি-প্রশ্নফাঁসে’ বিব্রত আওয়ামী লীগ?
বর্তমানে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিসিএসসহ নানা পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস। এর আগে দেশজুড়ে আলোচিত ছিল ছাগলকাণ্ডে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউরের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ। এরও আগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের খোঁজ মেলে। এভাবে একের পর এক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর বের হতে থাকায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছে টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দুর্নীতির এমন খবরে আওয়ামী লীগ বিব্রত কি না— জানতে চাওয়া হয় দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের কাছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, দুর্নীতির অনেক বিষয় এখনও আলোতে আসেনি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সাংবাদিক সমাজ বিভিন্নভাবে কিছু কিছু তথ্য উদঘাটন করতে পেরেছেন। তবে, সরকার এ বিষয়ে বেশ সচেতন। প্রশাসনিকভাবে দায়ীদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
‘এটি এমন না যে হঠাৎ করে শুরু হলো, এটি চলমান ছিল। তবে, আগে ঢালাওভাবে আমরা জানতে পারিনি। সেভাবে প্রচারিতও হয়নি। এখন যখন হচ্ছে তখন এর বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের এ কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।’
সম্প্রতি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান এবং তাদের স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের নামে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকায় দল হিসেবে এসব ঘটনায় তারা বিব্রত কি না— এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র
সম্প্রতি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দুদকের অনুসন্ধানে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে ঢাকায় মোট ১২টি ফ্ল্যাট, বিভিন্ন জেলায় ৬৯৭ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার, ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) পাওয়া যায়। এ ছাড়া সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধেও সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু নিজের নামে নয়; স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ের নামে বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান সরকারি চাকরি করে দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের সাংসারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজেদের এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নামে গড়েছেন বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এখন পর্যন্ত দেশেই তাদের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকাতে অন্তত ২৪টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে।
আরও পড়ুন
এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়। এটি আমাদের অঙ্গীকার। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহার পালনের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ দায়িত্বশীল কাজের ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমরা দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করতে চাই।
‘দুর্নীতিবাজদের কোনো দল নেই। দুর্নীতিবাজ সে যে-ই হোক, সবাইকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মানুষের কল্যাণে, মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে, সর্বোপরি বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথ আরও মসৃণ করতে দুর্নীতিবাজদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক দলের একার দায়িত্ব নয়। এমনকি কোনো সরকারের দায়িত্ব নয়, সবার দায়িত্ব। আমাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে, সক্রিয় হতে হবে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রায়শ জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলেন। কোনো দুর্নীতিবাজকে ক্ষমা করা হবে না বলেও হুমকি দেন। তারপরও দলের নেতাকর্মীরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়াচ্ছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। যে যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন, দুর্নীতি করলে তদন্ত হবে। দুদক এটি করবে। আদালত স্বাধীন। তারাই দেখবে।’
দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগ বিব্রত কি না— একই প্রশ্ন রাখা হয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের কাছে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা বিব্রত নই। বঙ্গবন্ধুকন্যা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি দেখিয়ে আসছেন। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে অবস্থান নেওয়ার কথা বলা আছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চলমান ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুকন্যার জিরো টলারেন্স নীতির একটি কর্মসূচি।’
আরও পড়ুন
‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত গাড়িচালক (সৈয়দ আবেদ আলী) বিএনপির আমলে এক চেয়ারম্যানের (পিএসসি চেয়ারম্যান) গাড়ি চালাতেন। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তিনি তখন চাকরি ছেড়ে দেন। তখন তিনি বিএনপির শ্রমিক কর্মচারী দলের নেতা ছিলেন। দুর্নীতি তো সেই সময় থেকে। তারা কেউ ধরেনি। একটা পর্যায়ে এসে সরকার দুদককে একটি স্বাধীন সংস্থা করে দেয়। সেই দুদক আজ দুর্নীতিবাজদের খুঁজে বের করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
কামাল হোসেন বলেন, ‘এই ধরার মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ যাচ্ছে, সরকার কাউকে ছাড় দেবে না। রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী, পুলিশ বা সিভিল প্রশাসনের লোক কিংবা সাংবাদিক হোক, সবার জন্য মেসেজ যে দুর্নীতি করলে ছাড় নয়। দুর্নীতি হয়তো শূন্যের কোঠায় আনা যাবে না কিন্তু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকার বিএনপির মতো পৃষ্ঠপোষকতা করছে না। এই মেসেজটা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, দুর্নীতি যারা করবে তারা সতর্কভাবে চলবে বলে আমি মনে করি। প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলেছেন, দুর্নীতি উন্নয়নের অন্তরায়। বঙ্গবন্ধু-তনয়া চান দেশের মানুষ ভালো থাকুক, শান্তিতে থাকুক, নিরাপদে থাকুক। এ কারণে এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করা হয়েছে, আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার। এজন্য দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত একটি সমাজ আমাদের গড়তে হবে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মতে, সম্প্রতি আমলাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির খবরে বিব্রত আওয়ামী লীগ। তাদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের যে অর্জন, সব মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমলাদের পাশাপাশি দলের অনেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মী দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়েছেন। এ বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক অভিযোগও জমা পড়েছে। তারপরও অজানা কারণে দায়ীদের বিষয়ে নীরব সংশ্লিষ্টরা। ফলে যারা সততার সঙ্গে দল করেন, তাদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ। তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সৎ লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। একইসঙ্গে তারা প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শাস্তির মুখোমুখি করার আহ্বান জানান। আর যারা টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে ক্যাডার হয়েছেন, তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে বলেছেন। তা না হলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া যাবে না।
এদিকে, দুর্নীতির উত্তাপ ছড়িয়েছে জাতীয় সংসদেও। বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের দুই সংসদ সদস্যও রয়েছেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে সংসদে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, চাকরিতে নিয়োগের সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হলফনামা দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে। পাশাপাশি তিনি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অথবা পদোন্নতির সময় হলফনামা জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা হলফনামা না দিলেও একজন রাজনীতিবিদকে তা দিতে হয়। দুর্নীতির অবাধ প্রবাহ থাকলে কখনও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
‘এবার কোরবানির ঈদে একটি গরু এক কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। গরুটি কারা কিনল, কেন কিনল? অবশ্যই যাদের অবৈধ আয় আছে, তারা কিনেছে। আবার ১৫ লাখ টাকায় ছাগলও কেনা হলো। অর্থাৎ বড় বড় কর্তারা বড় ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। ধরা পড়লে তাদের শাস্তির পরিমাণও হয় সামান্য। অথচ নন-ক্যাডার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই তাদের চাকরি নাই। একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তার করতে কোনো অনুমতি লাগে না। কিন্তু সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগে যদি মামলা হয়, তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি লাগে।’
২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করছে। আইনটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত— বলেন এই আইনপ্রণেতা।
সংসদে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, মতিউর রহমানের মতো দুর্নীতিবাজকে দুদক, সরকারি সংস্থা, মিডিয়া ও আমরা, কেউই চিহ্নিত করতে পারিনি। তাকে চিহ্নিত করেছে একটি বোবা প্রাণি (ছাগল)। সরকারের কাঠামোয় মতিউরের মতো এমন কোনো দুর্নীতিবাজ আর আছে কি না, সেটি কোনো বোবা প্রাণি বের করে আনার আগে সরকারি সংস্থাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। কোনো দুর্নীতিবাজকে রেহাই দেওয়া যাবে না।
বিসিএসের মতো পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস আওয়ামী লীগের জন্য বিব্রতকর কি না— জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে কোনো একটি চক্র বা একাধিক চক্র এ বিষয়ে সক্রিয়। এমন খবর বিভিন্ন সময়ে নানাজনের কাছ থেকে শুনেছি। সুনির্দিষ্ট প্রমাণসহ এবারই প্রথম তা মিডিয়ায় আসল। আবেদ আলীসহ কারা কারা জড়িত তা এখন স্পষ্ট হয়েছে। আরও কারা জড়িত, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ঘটনায় আমরা বিব্রত বটে। তবে, সরকার যে অ্যাকশনে যাচ্ছে, প্রশ্রয় দিচ্ছেন না— এটি সরকারের সদিচ্ছারই প্রমাণ।’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে তখনই যাওয়ার সম্ভব, যখন তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠবে। যখন সাধারণ মানুষ, সব রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, তখনই দুর্নীতিবাজমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব আমরা।’
এমএসআই/এমএআর/