দুর্নীতির টাকায় শালা-দুলাভাইয়ের সম্পদের পাহাড়, স্বজনেরাও কোটিপতি
ফেনী জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের ক্রাইম শাখার পুলিশ পরিদর্শক, পিরোজপুর মঠবাড়িয়া থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আব্দুল্লাহ কাগজে-কলমে সোয়া ১৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার আসামি। ওই মামলায় আসামি হয়েছেন তার স্ত্রী ফারহানা আক্তার ও শাশুড়ি কারিমা খাতুনও।
আদালতের আদেশে পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহসহ ওই তিনজনের ১৮ কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার ২৮৬ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করা হয়েছে।
এদিকে, ওসি আব্দুল্লাহর স্ত্রী ফারহানা আক্তার বর্তমানে আলোচিত আয়কর বিভাগের ট্যাক্স লিগ্যাল ও এনফোর্সমেন্ট শাখার প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বোন। অর্থাৎ আব্দুল্লাহ হচ্ছেন ফয়সালের দুলাভাই। আর আব্দুল্লাহর শাশুড়ি কারিমা খাতুন ফয়সালের মা।
আরও পড়ুন
কারিমা খাতুনের সম্পদের তথ্য খুঁজতে গিয়ে দুদকের জালে আটকা পড়েন তার ছেলে এনবিআর কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। ফয়সালের সম্পদের খোঁজ করতে দুদকের প্রধান কার্যালয় ও পিরোজপুর থেকে দুটি পৃথক অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। ওই টিম ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে অনুসন্ধান শুরু করে সম্পদের নিত্য-নতুন তথ্য পেতে শুরু করে। একে একে দুদকের জালে পেঁচিয়ে যেতে থাকেন ফয়সাল ও তার স্ত্রীর পরিবার।
গত ১৬ জুন আদালতের নির্দেশনায় ফয়সাল, তার স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই, শ্যালকসহ সংশ্লিষ্টদের নামে থাকা ১৬ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৯০৮ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করা হয়েছে। যদিও অভিযোগ ছিল হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের।
ফয়সাল তার স্ত্রী আফছানা নাজনীন, শ্বশুর আহম্মেদ আলী ও শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে অঢেল সম্পদ গড়েছেন। নিজের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্লট ও জমি কিনেছেন ফয়সাল। এ ছাড়া তার নামে ছয়টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে লেনদেন হয়েছিল পাঁচ কোটি ২১ লাখ টাকা। তবে, আদালতে দেওয়া তথ্যানুসারে ফ্রিজ হয় ৫০ লাখ টাকা
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে আব্দুল্লাহ থেকে ফয়সাল পর্যন্ত যতটুকু দুদকের অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত হয়েছে তাতে মনে হবে সম্পদ অর্জনের চক্রাকার সম্পর্ক। পরিবারের মেয়ে জামাই থেকে শুরু, এরপর একে একে যোগ হতে থাকেন বাকিরা। আসলে আমরাও জানি না এর শেষ কোথায়। তবে, মনে হচ্ছে আরও রাঘব-বোয়াল বাকি রয়ে গেছে। আমরা এনবিআরের সদস্য পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার যোগসূত্র পেয়েছি। তথ্য-প্রমাণের অপেক্ষায় আছি। তথ্য-প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থায় যাব।
অন্যদিকে, এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেন, তার পূর্বপুরুষ ব্যবসায়ী, অভিজাত পরিবার। তাদের সব সম্পদ বাবা-মায়ের ব্যবসা থেকে অর্জিত।
আরও পড়ুন
পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহর যত সম্পদ
২০২৩ সালের ২৮ মে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের আদেশে সৈয়দ আব্দুল্লাহর অপরাধলব্ধ আয়ের মাধ্যমে অর্জিত মোট ১৮ কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার ২৮৬ টাকার স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা হয়।
সৈয়দ আব্দুল্লাহর নামে পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি-২ এর সদস্য নং- ২৯০ এর অনুকূলে আনন্দ হাউজিং সোসাইটিতে রোড নং- ড্যাপ ৬০ ও ১১০ এর প্লট নং- ৬৩০৩ ও ৬৩০৪ এ বরাদ্দকৃত (প্রতিটি প্লট ছয় কাঠা) জমিসহ তিন কোটি ৪৫ লাখ ৩৪ হাজার ২৬৫ টাকার সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করা হয়। যা তিনি উৎস ও মালিকানা গোপন করার চেষ্টা করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
আব্দুল্লাহর স্ত্রী ফারহানা আক্তারের (ফয়সালের বোন) নামে দুটি এনআইডি কার্ড তৈরি করে এর বিপরীতে পৃথক দুটি ট্যাক্স শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) গ্রহণ করা হয়। যা ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫ টাকা, এক কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩১ লাখ টাকায় গাড়ি ক্রয়সহ মোট তিন কোটি সাত লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫ টাকার অস্থাবর সম্পদ ক্রয় করেন। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে দুটি আবাসিক ফ্ল্যাট ও একটি বাণিজ্যিক স্পেস যা শাশুড়ি কারিমা খাতুন থেকে দান হিসেবে দেখিয়েছেন কিন্তু অর্থ পরিশোধ হয়েছে স্ত্রী ফারহানা আক্তারের ব্যাংক হিসাব থেকে।
স্ত্রী ফারহানা আক্তারের নামে কাকরাইলের আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন লিমিটেডের ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন গ্রিন সিটি রিজেন্সির তৃতীয় তলায় দুই হাজার ১২০ বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেস ও ২৬৬ বর্গফুটের গাড়ি পার্কিংসহ মোট দুই হাজার ৩৮৬ বর্গফুট, ঢাকার বড় মগবাজারে এবিসি রিয়েল এস্টেটের দ্য ওয়েসিস কমপ্লেক্স টাওয়ারের ১০ম তলায় দুই হাজার ১৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও গাড়ি পার্কিং, স্ত্রী ফারহানা আক্তারের খিলগাঁওয়ের পশ্চিম নন্দীপাড়ায় দুই হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট ও গ্যারেজ থাকার তথ্য রয়েছে। স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে তাদের নামে দালিলিক মূল্য হিসাবে মোট ১৮ কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার ২৮৬ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে।
আব্দুল্লাহ ১৯৯১ সালে সাব-ইনস্পেক্টর পদে পুলিশে যোগ দেন। ২০০৭ সালে ইনস্পেক্টর পদে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আরও পড়ুন
আব্দুল্লাহর শাশুড়ি ও ফয়সালের মায়ের যত সম্পদ
পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ তার শাশুড়ি (ফয়সালের মা) কারিমা খাতুনের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাব খুলে লেনদেন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসামি কারিমা খাতুনের নামে ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয়, বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে এক কোটি ৬৯ লাখ ৭২ হাজার ৬৫ টাকা জমা রাখার তথ্য পাওয়া যায়। তদন্তকালে কারিমা খাতুনের নামে গুলশানে নাভানা রিয়েল এস্টেটের নাভানা এসিলমন প্যালেস নামে ১৩তলা ভবনের ১২ তলায় তিন হাজার ৯০৯ বর্গফুটের ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কারিমা খাতুনের নামে টয়োটা হার্ড জিপ ২০১৭ মডেলের একটি গাড়ি পাওয়া যায়। যার মূল্য ধরা হয় ৬৫ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন
ফয়সালের ১১ স্বজনের অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেন
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ফয়সাল তার স্ত্রী আফছানা নাজনীন, শ্বশুর আহম্মেদ আলী ও শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে অঢেল সম্পদ গড়েছেন। নিজের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্লট ও জমি কিনেছেন ফয়সাল। এ ছাড়া তার নামে ছয়টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে লেনদেন হয়েছিল পাঁচ কোটি ২১ লাখ টাকা। তবে, আদালতে দেওয়া তথ্যানুসারে ফ্রিজ হয় ৫০ লাখ টাকা।
আদালতের নির্দেশনায় ফ্রিজ হওয়া টাকার মধ্যে ফয়সালের স্ত্রীর নামে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এর বাইরে তার নামে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে খোলা হিসাবগুলোতে লেনদেন করা অর্থের পরিমাণ দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর বাইরে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তার নামে ঢাকা ও রূপগঞ্জে মোট ১০ কাঠার প্লট কেনা হয়।
কারিমা খাতুনের সম্পদের তথ্য খুঁজতে গিয়ে দুদকের জালে আটকা পড়েন তার ছেলে এনবিআর সদস্য কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। ফয়সালের সম্পদের খোঁজ করতে দুদকের প্রধান কার্যালয় ও পিরোজপুর থেকে দুটি পৃথক অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। ওই টিম ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে অনুসন্ধান শুরু করে সম্পদের নিত্য-নতুন তথ্য পেতে শুরু করে। একে একে দুদকের জালে পেঁচিয়ে যেতে থাকেন ফয়সাল ও তার স্ত্রীর পরিবার
অন্যদিকে, ফয়সালের শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ২০২২ সালে ঢাকার খিলগাঁওয়ে ১০ কাঠার প্লট কেনা হয়। দলিলমূল্যে এর দাম ৫২ লাখ টাকা দেখানো হলেও দুদক এ বিষয়ে আদালতকে জানিয়েছে যে, ওই প্লটের দাম সাড়ে চার কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তার নামে খোলা আটটি ব্যাংক হিসাবে ছয় কোটি টাকার বেশি অর্থ লেনদেন হয়।
ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলীর (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা) নামে গত বছর সিদ্ধেশ্বরীতে ১১তলা ভবনের ১১ তলায় এক হাজার ৯৯০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কেনা হয় এক কোটি টাকা দিয়ে। এ ছাড়া তার নামে ২০২০ ও ২০২১ সালে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। পাশাপাশি তার নামে থাকা আটটি ব্যাংক হিসাবে ১১ কোটি টাকা লেনদেন হওয়ার তথ্য পেয়েছে দুদক।
ফয়সালের শ্যালক আফতাব আলীর নামে ২০২০ ও ২০২১ সালে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। তার নামে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। এতে লেনদেন হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৪০ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন
ফয়সালের ভাই কাজী খালিদ হাসানের (আইনজীবী) নামে ২০২১ সালে ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। এ ছাড়া ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তার ছয়টি ব্যাংক হিসাবে দুই কোটি ১২ লাখ টাকা লেনদেন হয়।
২০২১ ও ২০২২ সালের মধ্যে ফয়সালের মামা-শ্বশুর শেখ নাসির উদ্দিনের দুটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হওয়া অর্থের পরিমাণ এক কোটি ৭১ লাখ টাকা।
কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেন, তার পূর্বপুরুষ ব্যবসায়ী, অভিজাত পরিবার। তাদের সব সম্পদ বাবা-মায়ের ব্যবসা থেকে অর্জিত
অন্যদিকে, ফয়সালের খালা-শাশুড়ি মাহমুদা হাসানের নামে ২০২১ সালের একটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয় তিন কোটি ৭৬ হাজার টাকা। তবে, সঞ্চয়পত্র পাওয়া যায় পাঁচ লাখ টাকার।
এ ছাড়া খালা-শাশুড়ি মাহমুদার মেয়ে ফারহানা আফরোজের চারটি ব্যাংক হিসাবে (২০২০-২৩ সালের মধ্যে খোলা) এক কোটি ২১ হাজার টাকার লেনদেনের তথ্য রয়েছে।
আদালতে দেওয়া দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ফয়সালের পূর্বপরিচিত খন্দকার হাফিজুর রহমানের (মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী) নামে ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়। এর বাইরে ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তার নামে খোলা পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হওয়া অর্থের পরিমাণ ১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
ফয়সালের আরেক স্বজন রওশন আরা খাতুনের নামে থাকা দুটি ব্যাংক হিসাবে আট কোটি ৪৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়। দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয় ২০১৯ ও ২০২০ সালে।
আরএম/এসকেডি