সাবেক ভিসির অনিয়মে ‘অকাজের কাজি’ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল
‘দেশেই মিলবে বিশ্বমানের চিকিৎসা, যেতে হবে না বিদেশ'— এমন স্লোগানে ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। গত বছর লোকবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর থেকে থমকে আছে হাসপাতালটির কার্যক্রম। উদ্বোধনের পর ২০ মাস পেরিয়ে গেলেও অনেক কিছু করে দেখানোর আশা দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি এখন ‘অকাজের কাজি’ রূপে মূর্ত হয়ে আছে। বিশাল এই প্রতিষ্ঠান থেকে কার্যত কোনো সেবাই মিলছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের নজিরবিহীন অপকর্মে হাসপাতালটি এখনো ‘শুরুর সংকটে’ই ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে যে স্বপ্ন নিয়ে হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়েছিল সেটি ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। যদিও নতুন উপাচার্য বলছেন, প্রশ্নফাঁসের তদন্ত শেষ হওয়ার পরপরই আসবে বড় নিয়োগের ঘোষণা। এরপর পুরো দমে শুরু হবে হাসপাতালের কার্যক্রম।
২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৮ ক্যাটাগরির পদে ৪র্থ থেকে ৯ম গ্রেডে ১৭২ জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ৬৮টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতা চাওয়া হয় বিএমডিসি কর্তৃক স্বীকৃত এমবিবিএস বা সমমান ডিগ্রি এবং বিএমডিসি কর্তৃক স্থায়ী রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বিভাগীয় প্রার্থী ও বিএসএমএমইউ থেকে প্রাপ্ত পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সের সীমা রাখা হয় অনূর্ধ্ব ৩২ বছর পর্যন্ত। তবে বিভাগীয় ও অভিজ্ঞ প্রার্থীর ক্ষেত্রে বয়স শিথিলযোগ্য বলেও উল্লেখ করা হয়, যার বেতন স্কেল হবে ২২,০০০-৫৩,০৬০ টাকা (গ্রেড-৯)।
মেডিকেল অফিসার নিয়োগ কমিটির প্রধান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিশ্চিত করতে পরীক্ষা কমিটি গঠন না করে নিয়োগ কমিটি দিয়েই যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতে তাকে নানা মহল থেকে চাপ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন পরীক্ষা কমিটি গঠন না করেই পরীক্ষা নেন। নিয়োগ কমিটিতে অধ্যাপক ও ডিনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের একান্ত সচিব (পিএস-২) দেবাশীষ বৈরাগী পরীক্ষা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ৬৮ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিতে ওই বছরই লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ২১ অক্টোবর রাত ৮টার পর। তবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন সবকিছুতেই বড় অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এমনকি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা ছিলেন রাসেল-রসুল আমিন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের মেয়াদে বিভিন্ন নিয়োগ কেলেঙ্কারি ও অনিয়মে উপাচার্যের একান্ত সচিব ডা. মোহাম্মদ রাসেল ও সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রসুল আমিন জড়িত ছিলেন। তারা ৬৮ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রেরও মূল হোতা ছিলেন। তারা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ইফতেখার আলমকে ম্যানেজ করে প্রাথমিক মডারেশনে তাদের পছন্দের শিক্ষকদের রেখেছিলেন।
তিনি বলেন, শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রশ্নপত্র কন্ট্রোলার অফিসে জমা দেওয়া এবং ভল্টে সিলগালা থাকার কথা। কিন্তু এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কন্ট্রোলার অফিসে জমা না দিয়ে নিয়োগ কমিটির সভাপতি উপ-উপাচার্যের কাছে জমা দেওয়া হয়। সেখান থেকেই কিছু অসাধু শিক্ষক তা অর্থের বিনিময়ে ফাঁস করেন।
আরও পড়ুন
যে প্রশ্নগুলো থেকে প্রশ্নপত্র সেট করা হয়েছে সেই প্রশ্নগুলো মডারেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রার্থীদের কাছে প্রশ্ন বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ উত্তীর্ণ হওয়া কিছু প্রার্থীর আগের একাডেমিক ফলাফল যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করে। অফলাইনে সব যোগ্য প্রার্থীর প্রবেশপত্র দেওয়া হয়নি। এমনকি অনলাইনে আবেদনের কথা বলা হলেও অফলাইনেও আবেদন গ্রহণ করা হয়।
সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতার কল রেকর্ড ফাঁস
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ নেতার কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড সম্প্রতি হাতে আসে ঢাকা পোস্টের। কলের এক প্রান্তে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ। অপর প্রান্তে থাকা শিক্ষার্থী নিজেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এমআর মামুন বলে পরিচয় দেন।
কল রেকর্ডের সূত্র ধরে জানা যায়, বিএসএমএমইউয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এমআর মামুনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেন শারফুদ্দিন আহমেদের সাবেক পিএস রাসেল। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আটকে যাওয়ায় তিনি (মামুন) বিপাকে পড়েন।
মামুন শারফুদ্দিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘স্যার, আর তো কিছু করলেন না। রাসেলও আমার টাকা-পয়সা ফেরত দিলো না। আপনি আমার সঙ্গে কমিটমেন্ট করেছিলেন আপনি যতদিন দায়িত্বে থাকবেন, ততদিনের মধ্যে আমাকে চাকরিটা দিয়ে যাবেন। এখন স্যার আমি কী করমু, বলেন স্যার।’
এ সময় শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখন আর কিছু করার নেই। সব তো বন্ধ করে দিলো, দেখেননি?’
এ পর্যায়ে মামুন বলেন, ‘নতুন ভিসি স্যারকে আমার ব্যাপারে একটু সুপারিশ করে যান।’
শারফুদ্দিন বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি আর কিছু করব না। আপনি ওনার সঙ্গে নিজেই যোগাযোগ করেন।’
মামুন বলেন, ‘তাহলে স্যার রাসেলের কাছ থেকে আমার টাকাগুলো উদ্ধার করে দেন।’
জবাবে শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আপনি তার সঙ্গে কথা বলেন।’
মামুন বলেন, ‘রাসেল তো আপনার কথা বলেই সব টাকা নিয়েছে। আপনি তো শুরু থেকে সব জানেন, সবকিছু আপনার সঙ্গে শেয়ার করেছি। এখন যদি আপনি ডিনাই করেন, তাহলে আমি কী করব স্যার?’
সবশেষে শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমার আর কিছু করার নেই। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেন।’
কল রেকর্ডের বিষয়ে মন্তব্য জানতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এমআর মামুনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ঢাকা পোস্ট। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত সেলফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সিসিটিভি ফুটেজ ফাঁস : পেনড্রাইভে করে প্রশ্ন সরানোর অভিযোগ
ঢাকা পোস্টের হাতে আসা একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গত বছরের ১৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জাহিদুল ইসলাম ও কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফয়সাল ইবনে কবির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন মডারেশন কক্ষে অবস্থান করছেন। বেলা ২টা ১৩ মিনিটে ডা. জাহিদুল ইসলাম তার পকেট থেকে পেনড্রাইভ বের করে কম্পিউটারে ঢুকিয়ে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন কপি করেন। তখন কক্ষে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। ২টা ১৮ মিনিটে কম্পিউটার থেকে পেনড্রাইভ বের করে শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে নেন।
অভিযোগ রয়েছে, পেনড্রাইভে করে ৩০০ প্রশ্ন চুরি করে সেগুলো ফাঁস চক্রের সদস্যদের কাছে সরবরাহ করেন ডা. জাহিদুল ও ডা. ফয়সাল। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। তারাই চাকরি প্রত্যাশীদের কাছে তা বিক্রি করেন। এই চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রসুল আমিন, একই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. জাহিদ হাসান পলাশ, বিএসএমএমইউর নিউরো সার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. আবেদ আব্বাস, কনজারভেটিভ ডেনটিস্ট বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মোমিনুর রহমান ও ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাঈনুল মাহমুদ সানী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষার মডারেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা মডারেশন কক্ষে মোবাইল ফোন, ক্যামেরাসহ এ ধরনের কোনো ডিভাইস নিয়ে ঢুকতে পারেন না। কক্ষে প্রবেশের আগে তাদের দেহ তল্লাশি করার কথা।
আরও পড়ুন
ওই কর্মকর্তারা মনে করেন, প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগ জালিয়াতির মতো অসৎ উদ্দেশ্যে ডা. জাহিদুল ইসলাম ও ডা. ফয়সাল পেনড্রাইভ নিয়ে ঢুকেছিলেন এবং বেরিয়েছেন।
জানতে চাইলে পেনড্রাইভে করে প্রশ্ন সরানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ডা. জাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে, তদন্ত কমিটির রিপোর্টও শুনেছি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। যেদিনের ফুটেজ বের হয়েছে, সেদিন কোনো মডারেশন ছিল না। আমরা আসলে প্রশ্ন ব্যাংক তৈরি করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। মডারেশন হয়েছে এর পরের দিন। এটা নিয়ে আমার পক্ষ থেকে আর কিছু বলার নেই।’
ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পাস করা চিকিৎসকদের মিষ্টি খাওয়ান পরিচালক
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০ অক্টোবরের লিখিত পরীক্ষায় যেসব চিকিৎসক উত্তীর্ণ হন, তাদের মধ্য থেকে যারা নিয়োগের জন্য আর্থিক লেনদেন করেছিলেন, ২৬ অক্টোবর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের তৎকালীন অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রসুল আমিন তাদের মিষ্টিমুখ করান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পেনড্রাইভে প্রশ্ন নেওয়া ডা. ফয়সাল ইবনে কবির।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাসুম আলম এবং প্রশ্ন বিক্রি চক্রের সদস্য ডা. আবেদ আব্বাস, ডা. মোমিনুর রহমান, ডা. মাঈনুল মাহমুদ সানী, ডা. জাহিদ হাসান পলাশ। তাদের সঙ্গে মিষ্টি খান চাকরিপ্রত্যাশী ডা. অনুপম সাহা, ডা. রাব্বী হাসান, ডা. সানাহউল্লাহ মোল্লা স্বপন, ডা. জুনায়েদ আহমেদ, ডা. সর্বজিত রায়, ডা. তনুময় দত্ত রায়, ডা. আরিফুর রহমান শাওয়ান, ডা. আদনান ইবরাহিম, ডা. দাউদ চৌধুরী পলাশ, ডা. জাকিউল ইসলাম ফুয়াদ, ডা. মাইদুল ইসলাম, ডা. আবু বকর সিদ্দিক লিমন, ডা. নাফিস রায়হান, ডা. আতিকুর রহমান মিজু প্রমুখ।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন প্রশ্নফাঁসে জড়িত ২ মেডিকেল অফিসার ডা. আবেদ আব্বাসের স্ত্রী ডা. উম্মে হাবিবা শান্তা, মেডিকেল অফিসার ডা. মোমিনুর রহমানের স্ত্রী ডা. মাহিরুন নাহার অরিনও।
মৌখিক পরীক্ষার আগেই উত্তীর্ণদের মিষ্টিমুখ করান অতিরিক্ত পরিচালক
মেডিকেল অফিসার নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একটা অংশ গত বছরের ২৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক ও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম সালেককে সদস্য সচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তবে সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখন পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগে বলা হয়, লিখিত পরীক্ষায় কাদের উত্তীর্ণ করা হবে তা আগেই চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছিল এবং সেই তালিকা অনুযায়ী মনোনীত প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষার আগেই নিজ কক্ষে ডেকে মিষ্টিমুখ করান সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. রসুল আমিন।
শিক্ষার্থীদের দাবি, পরীক্ষা কেন্দ্রে অনুপস্থিত থেকেও চূড়ান্ত মেধাক্রমে ৫০৩১৫ রোলধারী এক প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন।ৎ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরীক্ষার্থী বলেন, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথাগুলো পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রত্যেক চিকিৎসকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এই অনিয়মের সঙ্গে কারা জড়িত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কারও বিরুদ্ধে আমরা চাইলেই আঙুল তুলতে পারি না।
৩০-৪০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় প্রশ্ন
মেডিকেল অফিসার নিয়োগ কমিটির প্রধান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিশ্চিত করতে পরীক্ষা কমিটি গঠন না করে নিয়োগ কমিটি দিয়েই যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতে তাকে নানা মহল থেকে চাপ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন পরীক্ষা কমিটি গঠন না করেই পরীক্ষা নেন। নিয়োগ কমিটিতে অধ্যাপক ও ডিনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদের একান্ত সচিব (পিএস-২) দেবাশীষ বৈরাগী পরীক্ষা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১০টি করে প্রশ্নপত্র পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিসে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও নিয়ম লঙ্ঘন করে সেই প্রশ্নপত্র রাখা হয় নিয়োগ কমিটির সভাপতি ডা. ছয়েফ উদ্দিনের কাছে। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের দেওয়া প্রশ্ন থেকে দেবাশীষ বৈরাগী ও তার সহযোগীরা ৩০০ প্রশ্ন প্রাথমিকভাবে মনোনীত করেন এবং তা চাকরি প্রত্যাশীদের কাছে ৩০-৪০ লাখ টাকায় বিতরণ করেন। মডারেশন বোর্ডের সদস্যরা ৩০০ প্রশ্ন থেকে ১০০ প্রশ্ন বাছাই করেন এবং ওই প্রশ্নেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। ফলে আগে যারা প্রশ্ন পেয়েছেন, তাদের উত্তীর্ণ হওয়া নিশ্চিত ছিল।
এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে, তাই তদন্তাধীন বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না।’
নিয়োগপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই বেসরকারি মেডিকেল থেকে পাস করা
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৭৫০ বেডের এই হাসপাতালে চালাতে লোক দরকার ২ হাজার ৭৫৮, তবে নেওয়া হয়েছে মাত্র ৩৭৬ জন। অর্থাৎ হাসপাতালটিতে প্রয়োজনের বিপরীতে কর্মী-চিকিৎসক নেওয়া হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। নিয়োগ প্রাপ্তদের নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ। বলা হচ্ছে, বেশিরভাগ পদেই সুযোগ পেয়েছেন অদক্ষরা। আর্থিক অনিয়ম ছাড়াও আছে বিতর্কিতদের নিয়োগ কমিটিতে রাখার অভিযোগ।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল যেহেতু দেশের সর্ববৃহৎ ও উন্নত মানের একটি হাসপাতাল, স্বাভাবিকভাবেই নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী চিকিৎসকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা। কিন্তু এই হাসপাতালে নিয়োগ পাওয়া মেডিকেল অফিসারদের বেশিরভাগই বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা।
এছাড়াও কথা ছিল বিশেষায়িত সেবা দিতে কনসালটেন্ট পদে এখানে আসবেন দেশ সেরা চিকিৎসকরা। তবে শুরুতেই নেওয়া হয়েছে ৪৪ জন মেডিকেল অফিসার। অভিযোগ উঠেছে, একক ক্ষমতাবলে অ্যাডহক ভিত্তিতে তাদের নিয়েছেন সাবেক উপাচার্য।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিকল্পনায় ছিল, এখানকার চিকিৎসকেরা বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন না। বিনিময়ে পদ অনুযায়ী মাসে বেতন হবে আড়াই থেকে পাঁচ লাখ টাকা হবে। চলবে কর্পোরেট ব্যবস্থাপনায়, ১০ লাখ টাকা বেতনে আসবেন একজন প্রধান নির্বাহী। সেসব ভুলে গিয়ে এই স্পেশালাইজড হাসপাতালটি চালানো হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আদলে।
দক্ষতা বাড়াতে প্রথম ধাপে দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে চিকিৎসকসহ ১৫৯ জন স্বাস্থ্য কর্মী প্রশিক্ষণ নেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই এমন অসংখ্য ব্যক্তি সেখানে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আর যোগ দেননি কাজে। এসব অনিয়মের কারণে দ্বিতীয় ধাপে আরও ৫৬ জনের প্রশিক্ষণ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
নানা কর্মকাণ্ডে নিয়োগটি বিতর্কিত হয়েছে : স্বাচিপ সদস্য সচিব
স্বাচিপের বিএসএমএমইউ শাখার সদস্য সচিব অধ্যাপক মো. আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার টিটো ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএসএমএমইউয়ে মেডিকেল অফিসার নিয়োগ নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশকিছু কল রেকর্ড, সিসিটিভি ফুটেজ আমরা দেখেছি। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে মনে হয় নিয়োগ নিয়ে অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে। আমরা চাই সবকিছু স্বচ্ছ ও সঠিক হোক। এখন যেহেতু তদন্ত কমিটি হয়েছে, প্রতিবেদন সাপেক্ষে সঠিক সিদ্ধান্তটাই যেন নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, যেহেতু বিষয়টি এখন তদন্তাধীন, তাই এই বিষয়ে এখন বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে সত্যিকার অর্থে যদি এই নিয়োগ কার্যক্রমে অন্যায় বা অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে জড়িতদের বিচার হোক।
আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার আরও বলেন, সিসিটিভি ফুটেজটা আমরাও দেখেছি, জড়িতরা বিষয়টি যতই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক, তাদের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি দেখে যেকেউ বলতে পারবে এখানে বড় ধরনের কিছু একটা হয়েছে। সবমিলিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে লেনদেন নিয়ে কল রেকর্ড ফাঁস, সিসিটিভির ফুটেজগুলো দেখে যেকেউ বলবে এসব কর্মকাণ্ড পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে বিতর্কিত করেছে। আমার কাছেও তাই মনে হয়।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা : বিএসএমএমইউ প্রশাসন
এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেডিকেল অফিসার নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি নিয়ে শুরুতে একবার তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা একটা প্রতিবেদনও দাখিল করেছে। এরপর মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এই তদন্ত কমিটিতে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করে পুনঃতদন্তের জন্য নতুন সময়সীমা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের কথা বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে প্রশ্ন কিন্তু ফাঁস হয়নি। বলা হচ্ছে বাছাইকৃত ৩০০ প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এমন অভিযোগ আসার পর সেগুলো থেকে কিছু প্রশ্ন পরিবর্তনও করা হয়েছে। এরপর আরও দুটি ধাপে মৌখিক এবং প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
উপাচার্য বলেন, নিয়োগ কমিটি শুরুতে লিখিত পরীক্ষা নিয়েছে। এরপর প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা ও ভাইভা (মৌখিক) পরীক্ষা হয়েছে। দুটোতেই আলাদা পাস নম্বর ছিল। সুতরাং কেউ লিখিত পরীক্ষায় ১০০ নম্বর পেলেও কোন লাভ নেই, এরপর দুটি পরীক্ষা আলাদাভাবে পাস করতে হবে। এখন যেহেতু এটা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী নিয়োগ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রথম তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দীন মো. নূরুল হক বলেন, তদন্ত কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে মেডিকেল অফিসার নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে, সেটি উল্লেখ করেছে। এমনকি যারা অনিয়ম করেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত বলেও সুপারিশ করেছে। কিন্তু বিষয়টি অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আমরা আবারও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তারা যে পরামর্শ দেবে, নিয়োগ কমিটি সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে।
নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অনিয়ম প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছিল, সে অনুযায়ী আমরা একটা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। সেই অনুযায়ী কিছু প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছায় পরবর্তীতে আবারও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে নতুন সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে কী হবে তা এখন নতুন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে।
টিআই/এসকেডি