ছাত্র সংগঠনগুলোর আয়ের উৎস কী?
শিক্ষার্থীদের অধিকার, সমস্যা, দাবি-দাওয়া ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করাই হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলোর মূল কাজ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে।
কিন্তু অতীতের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছাপিয়ে ৯০ দশকের পর থেকে ধীরে-ধীরে এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। এর মধ্যে আর্থিক কেলেঙ্কারি অর্থাৎ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য ও ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর অভিযোগই বেশি।
বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলো, বিশেষ করে রাষ্ট্রপরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যথাক্রমে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল ছাত্রদের অধিকার আদায়ের চাইতে মূল দলের লেজুড়বৃত্তি ও এজেন্ডা বাস্তবায়নে বেশি মনযোগী থাকে। এরপরও বিভিন্ন সময় ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রদের দাবি-দাওয়া, জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা এবং তাদের মূল দলের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু এসব কার্যক্রম পরিচালনায় ছাত্রদের নিয়ে গঠিত এসব সংগঠনের আয় বা তহবিল সংগ্রহ হয় কীভাবে?
ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, তাদের স্থায়ী আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে সদস্যদের মাসিক চাঁদা। যদিও সেটি নিয়মিত আদায় করা সম্ভব হয় না। এর বাইরে যে কোনো কর্মসূচি ঘিরে সংগঠনের সাবেক নেতা ও শুভানুধ্যায়ীর চাঁদা/অনুদান সংগ্রহ করা হয়। তবে, এ ক্ষেত্রে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গণচাঁদা সংগ্রহ করে তহবিল গঠন করে।
আরও পড়ুন
সংগঠন পরিচালনার অর্থ কোথা থেকে আসে— জানতে চাওয়া হয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতি প্রাচীন একটি সংগঠন। ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখে চলছে এটি। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, প্রত্যেক সদস্যের মাসিক একটি চাঁদা দেওয়ার বিধান রয়েছে। ছাত্রলীগের অফিসিয়াল একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা সংগ্রহ থেকে যে অর্থ আদায় হয় তা দিয়ে কিছু কাজের ব্যয় নির্বাহ করা হয়— উল্লেখ করে শেখ ইনান আরও বলেন, ‘৭৬ বছরে আমাদের সংগঠনের অনেক সদস্য ব্যক্তি, ব্যবসায়িক ও চাকরিজীবনে অনেক ভালো অবস্থানে আছেন। তারা সংগঠনের যে কোনো কর্মসূচিতে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন।’
অতীতের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছাপিয়ে ৯০ দশকের পর থেকে ধীরে-ধীরে এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। এর মধ্যে আর্থিক কেলেঙ্কারি অর্থাৎ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য ও ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর অভিযোগই বেশি
‘মোট কথা সদস্যদের মাসিক চাঁদা, সাবেক নেতা ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতা নিয়ে সংগঠনের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এর বাইরে সংগঠনের সম্মেলন উপলক্ষ্যে ফরম বিক্রি থেকেও আয় হয়’— বলেন ইনান।
অন্যদিকে, ‘ছাত্রদলের স্থায়ী কোনো আয় নেই’— উল্লেখ করে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের কোনো আয় নেই। তবে, সংগঠন পরিচালনা করতে যেসব খরচ হয় সেগুলো আমরা ছাত্রদলের সাবেক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে পেয়ে থাকি।’
‘এছাড়া ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন কর্মসূচিভিত্তিক আর্থিক সহায়তা করেন। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক বড় বড় কর্মসূচিতে সংগঠনকে আর্থিক সহযোগিতা করেন’— বলেন এই ছাত্রনেতা।
আরও পড়ুন
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা গণসংগঠন। সুতরাং আমাদের একমাত্র আয়ের উৎস হচ্ছে গণ-মানুষ। সংগঠনের সম্মেলন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, মিটিং-মিছিল ও সমাবেশের দাওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যাই। তাদের বলি, আমাদের কথাগুলো-দাবিগুলো আপনাদেরই দাবি। আপনারা পাঁচ টাকা থেকে যত পারেন সহযোগিতা করেন।’
‘আমাদের সংগঠনের বয়স ৭২ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে সংগঠনের অনেক সাবেক নেতা কর্মসূচি উপলক্ষ্যে সহযোগিতা করেন। মোট কথা, গণচাঁদাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র ও প্রধান আয়ের উৎস।’
ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সংগঠন পরিচালনার অর্থ আমরা আমাদের সদস্য, সাবেক নেতৃবৃন্দ ও শুভানুধ্যায়ীদের থেকেই সংগ্রহ করি। যখন কোনো বড় কর্মসূচি পালন করা হয় তখন ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে আমরা অর্থ উত্তোলন করি।’
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘আমাদের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছেন সাবেকরা। যারা বিভিন্ন সময় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করি। এর বাইরে শুভানুধ্যায়ীরা চাঁদা দিয়ে থাকেন।’
‘এসব খাত থেকে অর্থ নিয়ে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যয় নির্বাহ করি। কাউন্সিলের মতো বড় কর্মসূচির ক্ষেত্রে গণচাঁদা সংগ্রহ করি। এর বাইরে সংগঠনের সদস্যদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাসিক একটা চাঁদা নির্ধারণ করা থাকে। এ অর্থ থেকেই সংগঠনের সার্বিক কাজ পরিচালিত হয়।’
সংগঠনের আর্থিক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এ ছাত্রনেতা বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের এমন অর্থ নেই যে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। এরপরও আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন থাকে আমাদের।’
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের কয়েকজন সাবেক নেতা বলেন, সংগঠন পরিচালনার অর্থ এক কথায় মূল দল থেকেই আসে। যে কোনো কর্মসূচি উপলক্ষ্যে মূল দল থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। দলের নেতাদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও আর্থিক সহযোগিতা করেন।
সংগঠনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য ও ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠে। এ প্রসঙ্গে তাদের অভিমত হলো, এগুলো তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। দল বা সংগঠন এর দায় নেবে না। তাদের টাকাও সংগঠনের কাজে ব্যবহার করা হয় না।
আরও পড়ুন
এত কর্মসূচি, এত অর্থ— এগুলো আসে কোথা থেকে, জানতে চাওয়া হয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) মারুফা আক্তার পপির কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রয়োজনে জনগণের কাছে যাওয়া যায়। যেমন- বন্যাপরিস্থিতি বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যাই। তাদের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করি এবং দুর্গতদের পেছনে তা ব্যয় করি।
‘তবে, ব্যক্তিস্বার্থে কেউ যদি কিছু করে থাকে, নিঃসন্দেহে সেটি গুরুতর অপরাধ। ছাত্রলীগের কোনো নেতার বিরুদ্ধে যদি এমন অভিযোগ আসে, তা হলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। আপনারা দেখেছেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
সংগঠন পরিচালনা আইনে যা আছে
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইনের ৯০বি এর (১)(বি) ধারা অনুযায়ী, ‘যদি কোনো রাজনৈতিক দল… কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত হতে চায়, তাহলে তার গঠনতন্ত্রে নিম্নের সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে। যেমন … (iii) কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা ছাত্র অথবা আর্থিক, বাণিজ্যিক অথবা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তা অথবা শ্রমিকদের অথবা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ রাখবার। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো কিছুই তাদেরকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হবার অথবা সংগঠন, সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি গঠন করবার এবং সকল প্রকার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করবার এবং ব্যক্তিহিসেবে বিদ্যমান আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হবার ক্ষেত্রে বাধা হবে না।’
উপরের উল্লিখিত ধারার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নিবন্ধিত দলের জন্য অঙ্গ অথবা সহযোগী সংগঠন থাকা বেআইনি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই আইনটি করা হয়েছে। কিন্তু কেউ তো এ আইন মানে না।
‘আবার যারা এ আইন মানতে বাধ্য করাবে, সেই নির্বাচন কমিশনও নীরব ভূমিকা পালন করে।’
বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি নাই— উল্লেখ করে বদিউল আলম বলেন, ‘এখন ছাত্রদের মাস্তান হিসেবে ব্যবহারের রাজনীতি চলছে। এটি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।’
এএইচআর/