সড়কের বিটুমিন গলছে কেন?
এক মাস ধরে সারা দেশে চলছে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রার পারদ উঠেছে ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এমন অবস্থা আরও কয়েকদিন চলবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তীব্র গরমের কারণে দেশের অনেক জায়গায় সড়কের বিটুমিন গলে যাওয়ার খবর আসছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সড়কে ব্যবহার করা বিটুমিনের মান নিয়ে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটুমিন সড়কের পাথরকে শক্তভাবে ধরে রাখে। এটি বাইরের তাপ থেকে ভেতরে নিজের তাপ ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি ধরে রাখে। যেসব জায়গার সড়কে বিটুমিন গলেছে সেসব জায়গায় নিম্ন মানের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিটুমিন গলে যাওয়ার কথা নয়।
কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটুমিনের সফটেনিং বা নরমকরণ তাপমাত্রা ৩৫-৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। সুতরাং বর্তমান তাপমাত্রায় সড়কের বিটুমিন গলে যাওয়ার কথা নয়, কিছুটা নরম হতে পারে।
চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে ৫০০ থেকে ৬০০ মিটার সড়কের বিটুমিন গলেছে বা নরম হয়েছে বলে স্বীকার করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্টের জেলা প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ ও ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় জেলা শহরের বিভিন্ন সড়কে রাস্তার পিচ গলে যায়। ওই দুদিন সেখানে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এরপর ২৫ এপ্রিল শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের ১৫টি স্থানে বিটুমিন গলে যায়। ওই সড়ক দিয়ে গাড়ি চালাতে গেলে টায়ারের সঙ্গে বিটুমিন লেগে যাচ্ছিল। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা-কালীগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়ক, যশোর-নড়াইল মহাসড়ক ও গাজীপুরের কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বিটুমিন গলে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, একসময় আমাদের দেশের সড়কে সফটগ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে আমরা হার্ডগ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করছি। আমরা এখনও প্রচলিত বিটুমিনই ব্যবহার করছি। এই বিটুমিনের তাপমাত্রা সহনশীল ক্ষমতা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে হয়। আমাদের তাপমাত্রা কিন্তু ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়নি। আমরা বলে থাকি বাইরের তাপমাত্রা যদি টানা সাত দিন ৪০ ডিগ্রি হয়ে থাকে, তবে বিটুমিনের ভেতরের তাপমাত্রা আরও ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি বেড়ে যায়। তখন বিটুমিন গলে উপরে ওঠা শুরু করে।
তিনি বলেন, আমরা দেখলাম একই মহাসড়কের কোনো কোনো জায়গায় এ রকম হয়েছে আবার কোনো কোনো জায়গায় এ রকম হয়নি। সেক্ষেত্রে আমি বলব, এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার আছে। ওইসব জায়গায় নির্মাণ করার সময় নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে কি না এটা যাচাই-বাছাইয়ের দরকার আছে। যেসব জায়গায় বিটুমিন গলে গেছে, সেসব জায়গায় সড়কের সক্ষমতা কমে গেছে। ফলে সড়কে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে এটা নিয়ে বেশিকিছু করার নেই। তবে যখন এই রাস্তাগুলো সংস্কার করা হবে তখন অবশ্যই পলিমার মডিফাইড বিটুইন ব্যবহার করতে হবে। আমরা যদি আবারও সেই প্রচলিত বিটুমিন ব্যবহার করি, তবে এটি আর টেকসই হবে না।
এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আমাদের আবহাওয়াবিদরা বলছেন তাপমাত্রা আরও বাড়তে থাকবে। ফলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে। প্রচলিত বিটুমিন ব্যবহার বাদ দিয়ে আমাদের পলিমার মডিফাইড বিটুমিন ব্যবহার করতে হবে। এটি ব্যবহার করলে সড়কের সহনশীল তাপমাত্রা ৮৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
বিটুমিন সম্পর্কে বুয়েট কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. মো. শাহীনুর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেমিক্যাল হিসেবে বিটুমিনের গলনাঙ্ক প্রায় ১২০-১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে বিটুমিনের নরমকরণ (সফটেনিং) তাপমাত্রা ৩৫-৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে আলকাতরার গলনাঙ্ক প্রায় ৪২-৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেসব দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে ওঠে সেসব দেশের সড়কে আলকাতরা ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই, অবশ্যই বিটুমিনই ব্যবহার করতে হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দেশে যদি ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস সাধারণ তাপমাত্রা হয়, তবে বিটুমিনের তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ সাধারণ তাপমাত্রার চেয়ে বিটুমিনের তাপমাত্রা ২০ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়। এটা যদি ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রার কাছাকাছি যায়, তাহলে এটি একটু নরম হয়ে যায়।
তিনি বলেন, চলমান তাপপ্রবাহে গোটা দেশের মধ্যে কেবল ৫০০-৬০০ মিটার সড়ক এমন হয়েছে। এছাড়া আর যেসব জায়গার তথ্য আমরা পেয়েছি, সেসব জায়গায় গিয়ে তেমন কিছু পাইনি।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার সড়ক আছে সওজের অধীনে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক আছে ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়ক আছে ১৩ হাজার ৫৫৮ কিলোমিটার।
এমএইচএন/এসকেডি