টিকা সংকট : ভারত ছেড়ে ভরসা এখন বিকল্প দেশ
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। এ অবস্থায় চলতি মাসেই টিকার মজুত ফুরিয়ে যাওয়া এবং নতুন টিকার সন্ধান না পাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভাবাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, যে টিকা মজুত আছে তাতে এপ্রিল মাস চলবে। মে মাসের মধ্যে নতুন টিকা না এলে টিকার কার্যক্রম নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে দেশ। এ অবস্থায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা সরবরাহে ব্যর্থ হলে বিকল্প দেশের ওপর ভরসা রাখবে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, টিকার বিষয়ে গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার অবসান হচ্ছে বলে আভাস মিলেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি ভারত সরকারের টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে শুরু করে সরকার। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার টিকা পেতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। টিকা বিক্রির জন্য অন্যকোনো মাধ্যমে নয়, সরাসরি ওই দুটি দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে বলা হয়। এতে আশার আলো দেখতে পায় সরকার। চীনের সিনোফার্ম ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। যা নিয়ে অনেক দূর এগিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সোমবার জরুরি বৈঠকে চীন বা রাশিয়ার টিকা কীভাবে দ্রুততম সময়ে পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হয়।
সম্প্রতি ভারত সরকারের টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে শুরু করে সরকার। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার টিকা পেতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অন্যকোনো মাধ্যমে নয়, সরাসরি ওই দুটি দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে বলা হয়। এতে আশার আলো দেখতে পায় সরকার
সূত্রটি আরও জানায়, বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের লক্ষ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে টিকার বিকল্প উৎসগুলো খুঁজে বের করে সাতদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেরামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছে, ভারত সরকারের বিরোধিতায় টিকা পাঠাতে পারছে না। অনুমতি পেলেই রফতানি করবে। তারা টিকা দিতে প্রস্তুত। তবে, আমরা আশা করছি টিকার সংকট হবে না। এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘টিকা পাওয়া নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আমরা টিকার বিকল্প উৎস খুঁজতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছি। তারা রাশিয়া ও চীনের টিকা নিয়ে কাজ করছে। ওদের যেসব সোর্স আমাদের কাছে অ্যাপলাই করেছে তাদের যাচাই-বাছাই করে কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে একটি রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব, কার কাছ থেকে কীভাবে টিকা সংগ্রহ করব।’
খুরশীদ আলম বলেন, চীনের টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে একটি প্রস্তাব দিয়েছে। কমিটি প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করে দেখবে। তারা এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার পর একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
টিকার দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একেকজন একেকরকম প্রস্তাবনা দিয়েছে। কোভ্যাক্স ৭ ডলার, চীনের দুই ডোজের টিকা ৩২ ডলারের প্রস্তাব এসেছে। তবে কোনটার কার্যক্ষমতা কেমন, কী কী কাজ করে, আমরা এখনো তা জানি না। আমরা এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তারপর কথা বলতে চাই। চীনসহ কোনোটি এখনো চুক্তির পর্যায়ে যায়নি। প্রাথমিক আলোচনা চলছে।’
কোভ্যাক্সও আশা দেখাচ্ছে
করোনার টিকা সরবরাহের বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সও দ্রুততম সময়ে টিকা পাওয়ার বিষয়ে আশা দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে গত রোববার সংস্থাটির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের কী পরিমাণ টিকা লাগবে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী শনিবারের মধ্যে টিকার চাহিদার তথ্য কোভ্যাক্সকে জানাতে বলা হয়েছে। ওই চিঠি পাওয়ার পর কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। কোভ্যাক্স থেকে কোন প্রক্রিয়ায় টিকা পাওয়া যাবে এবং কতদিনের মধ্যে টিকা আসবে, তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।
করোনার টিকা সরবরাহের বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সও দ্রুততম সময়ে টিকা পাওয়ার বিষয়ে আশা দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে গত রোববার সংস্থাটির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের কী পরিমাণ টিকা লাগবে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী শনিবারের মধ্যে টিকার চাহিদার তথ্য কোভ্যাক্সকে জানাতে বলা হয়েছে। ওই চিঠি পাওয়ার পর কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ
এর আগে কোভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে টিকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ হিসাবে বাংলাদেশের ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা। এর মধ্যে আগামী মে মাসের মধ্যে এক কোটি নয় লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো কোনো টিকা পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় কোভ্যাক্স থেকে আবারও চিঠি দিয়ে টিকার চাহিদার কথা জানতে চাওয়া হলো। কোভ্যাক্সের টিকা দেওয়ার আগ্রহের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খুরশীদ আলম বলেন, ‘কোভ্যাক্স থেকে চিঠি পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের কী পরিমাণ টিকা লাগবে, তা নিরূপণ করে তিনি কোভ্যাক্সের চিঠির জবাব দেবেন।’
টিকা পেতে কোভ্যাক্সকে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোভ্যাক্সকে আমরা অগ্রিম টাকা দিইনি। তারা প্রথমে বলেছিল দুই ডলার দামে ২০ শতাংশ মানুষের টিকা দেবে। কিন্তু পরে দাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা বলেছে, ওটা বিনামূল্যে দেবে। পরে আমাদের কী পরিমাণ টিকা লাগবে জানতে চায় তারা। ২০ শতাংশের বাইরে কোনো টিকার প্রয়োজন হলে এবং তা কোভ্যাক্স থেকে নিলে সেগুলোর প্রতি ডোজের দাম পড়বে সাত ডলার করে।’
কোভ্যাক্স কোন টিকা সরবরাহ করবে— এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, কোভ্যাক্সের কাছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়া সব ধরনের টিকা রয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্নাসহ যে কটি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে সেগুলো কোভ্যাক্সের কাছে পাওয়া যাবে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নেই, এমন টিকা কোভ্যাক্স সরবরাহ করবে না।
টিকার সংরক্ষণ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন মাইনাস ৩০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার রেফ্রিজারেটর। কিন্তু তা বাংলাদেশে আছে মাত্র কয়েকটি। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনাতেই রাশিয়ার টিকা সংরক্ষণ সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার ও বেক্সিমকো সেরামের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখছে। কিন্তু তারা এখন টিকা দিতে পারছে না। অন্যদিকে, আমাদের লাগবেই। কেননা দ্রুত আমাদের টিকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া উপায় নেই। সে অনুযায়ী রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে অনেকদিন ধরে যোগাযোগ চলছে। এরই মধ্যে চীনের সঙ্গে মোটামুটি একটি জায়গায় আমরা পৌঁছে গেছি।
তিনি বলেন, ‘চীনের সিনোফার্ম করপোরেশন এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে টিকা দিতে বেশি আগ্রহী। তবে সেটি কীভাবে পাওয়া যাবে, দরদাম নির্ধারণসহ আরও কিছু বিষয় রয়েছে। আশা করা যায় দু-একদিনের মধ্যেই এর সমাধান হবে। আপাতত অ্যাপ্রুভ হওয়া যেকোনো টিকা পেলেই হবে। বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে যে হারে টিকার প্রয়োগ হচ্ছে তাতে মে মাসের শুরুতেই টিকার সংকট দেখা দেবে।’
‘তাই, যা-ই বলি না কেন, টিকা আমাদের পেতেই হবে’— বলেন ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন।
এদিকে, বাংলাদেশের হাতে থাকা এক কোটি তিন লাখ ডোজ টিকা ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮৫ জন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৯ জন। অর্থাৎ দুই ডোজ মিলে এখন পর্যন্ত ৭৪ লাখ ২৩ হাজার ২৭৪ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। চলমান টিকা কার্যক্রমের ধারা অব্যাহত থাকলে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এটি চলতে পারে। এ সময়ের মধ্যে টিকা না পেলে চলমান কার্যক্রম শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়বে বাংলাদেশ।
টিআই/জেডএস/এমএআর/জেএস