‘অর্থ ও আসন’ নিয়ে জাপার বিরোধের সমাধান কোন পথে?
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে ছাড় পাওয়া আসন ও অর্থের সমবণ্টন না করার অভিযোগ তোলায় জাতীয় পার্টি থেকে ইতোমধ্যে শীর্ষ চার নেতা বহিষ্কৃত হয়েছেন। ক্ষোভে নিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন একজন। অন্যদিকে, নেতৃত্বে দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে আগে থেকেই দূরে অবস্থান নিয়েছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। ফলে, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাওয়ায় রওশনপন্থী ও বহিষ্কৃতরা এক হয়ে পাল্লা ভারী করছেন।
এদিকে, দলে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে জি এম কাদেরের নেতৃত্ব। বিশ্লেষকরা বলছেন, সবসময় সুবিধাভোগী এ দলে অতীতেও একাধিকবার ভাঙন ধরেছে, আগামীতেও ভাঙবে— এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপিবিহীন আসন সমঝোতার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসন ছাড় পায় জাতীয় পার্টি। কিন্তু ছাড় পাওয়া আসনের মধ্যে ঠাঁই হয়নি জাপার রাজনীতিতে প্রভাবশালী দুই নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার নাম। প্রভাবশালী দুই নেতাকে বলি দিলেও নিজের স্ত্রী শেরিফা কাদেরকে ঠিকই ঢাকা-১৮ আসন ছাড় দেওয়ার অভিযোগ ওঠে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে নির্বাচনের আগে জাপার মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। ক্ষোভে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান সংসদ সদস্য ফিরোজ রশীদ।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, নির্বাচনে পরাজিত হয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে পদ থেকে অপসারণের দাবি তোলেন আরেক সংসদ সদস্য বাবলা। পরবর্তীতে নির্বাচনে দলের পরাজিত প্রার্থীদের নিয়ে সভা করেন বিক্ষুব্ধ নেতারা। সেখান থেকে দলের শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও অশোভন মন্তব্য করেন পরাজিত প্রার্থীরা।
জি এম কাদেরপন্থীরা বলছেন, বহিষ্কার করে দলের বিরোধ যে মেটানো সম্ভব না, সেটা বুঝতে পেরেছেন শীর্ষ নেতারা। এটা করতে গিয়ে বিরোধ আরও বেড়েছে। যার কারণে সমালোচনা করার পরও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, লিয়াকত হোসেন খোকা ও সাইদুর রহমান টেপার মতো নেতারা, যাদের ঢাকার রাজনীতিতে ‘ম্যান পাওয়ার’ আছে, তাদের বহিষ্কার করা হয়নি। আগামীতে তাদের বিভিন্নভাবে সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, জেলার নেতাদের সঙ্গেও কথা বলতে শুরু করেছেন শীর্ষ নেতারা
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পায় জাতীয় পার্টি। আসনগুলো থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু রয়ে যান আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ফলে, ছাড় পাওয়া ২৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ১১টিতে জয় পায় জাপা। বাকি ১৪টি আসনে পরাজিত হন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। তাদের মধ্যে শেরিফা কাদেরসহ সাত প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
আরও পড়ুন
গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, ‘নির্বাচন উপলক্ষ্যে সরকার জাতীয় পার্টিকে ভরপুর দিয়েছে। সরকার কোনো কার্পণ্য করেনি। টাকা-পয়সা দিয়েছে। আসনও বেশি ছাড় দিতে রাজি ছিল সরকার। কিন্তু চেয়ারম্যান ও মহাসচিব আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। মহাসচিবের ব্যর্থতার কারণে আজ জাতীয় পার্টির এ অবস্থা।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রার্থীরা যখন আমার কাছে এসে ক্ষোভ জানাল তখন আমি মহাসচিবকে ফোন করি। তিনি আমাকে বলেন, অল্পকিছু টাকা পেয়েছেন। সেখান থেকে একটা অংশ তিনি শেরিফা কাদেরের কাছে রেখে নিজের নির্বাচন করতে চলে গেছেন। কিন্তু সেখান থেকে প্রার্থীরা কোনো সহযোগিতা পাননি।’
ওই সভায় দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে ‘প্রতারক ও বাটপার’ বলে অভিহিত করেন নোয়াখালী-৩ আসন থেকে নির্বাচন করা জাতীয় পার্টির প্রার্থী ফজলে এলাহী সোহাগ। দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা এবং সিলেট-২ আসনের পরাজিত প্রার্থী ইয়াহিয়া চৌধুরীসহ ১৫ জনের অধিক প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় নেতা জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্ব ও চরিত্রগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। চুন্নুকে বাদ দিয়ে নতুন করে দলকে গতিশীল করতে জি এম কাদেরের প্রতি আহ্বান জানান।
জি এম কাদেরপন্থীরা বলছেন, বহিষ্কার করে দলের বিরোধ যে মেটানো সম্ভব না, সেটা বুঝতে পেরেছেন শীর্ষ নেতারা। এটা করতে গিয়ে বিরোধ আরও বেড়েছে। যার কারণে সমালোচনা করার পরও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, লিয়াকত হোসেন খোকা ও সাইদুর রহমান টেপার মতো নেতারা, যাদের ঢাকার রাজনীতিতে ‘ম্যান পাওয়ার’ আছে, তাদের বহিষ্কার করা হয়নি। আগামীতে তাদের বিভিন্নভাবে সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, জেলার নেতাদের সঙ্গেও কথা বলতে শুরু করেছেন শীর্ষ নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, যাদের বহিষ্কার না করলে দলে বেশি বিশৃঙ্খলা দেখা দিত, তাদের করা হয়েছে। অন্যদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তাদের আগামীতে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।
এ নেতা আরও বলেন, অনেক নেতা প্রকাশ্যে শীর্ষ নেতাদের সমালোচনা করেছেন। এটা যে ভুল হয়েছে, সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন তারা। তাদের আগামীতে মূল্যায়ন করার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। তারপরও আমরা কিছুদিনের মধ্যে নেতাদের সঙ্গে বসব, তাদের অভিযোগগুলো শুনব।
এদিকে, গত ১৬ জানুয়ারি এক ভিডিও বার্তায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের কোনো লোক যদি বলতে পারেন আমি বা চেয়ারম্যান কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, প্রমাণ করতে পারলে পদত্যাগ করব। শত কোটি টাকা পেলে তো বিদেশ চলে যেতাম।’
তিনি আরও বলেন, অনেকেই মনে করেছেন যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেহেতু আমাদের কথাবার্তা হয়েছে, ২৬টি সিট দিয়েছে; তাদের ধারণা সরকার শত শত কোটি টাকা দিয়েছে। প্রার্থীদের কেন আমরা টাকা দিলাম না, এটা তাদের মনের আসল ব্যথা। দু-একজন ছাড়া পরাজিত প্রার্থীদের আসল ব্যথা যে আমরা শত কোটি টাকা পেয়েছি, তাদের কেন দিইনি?
সমালোচনা করে বহিষ্কার ৪ নেতা
দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সমালোচনা করায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরীকে। এ ছাড়া, ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও গাজীপুর মহানগরের সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন এম এম নিয়াজউদ্দিন।
সুবিধাভোগী দলে ভাঙন স্বাভাবিক
জাতীয় পার্টির মতো সুবিধাভোগী দলগুলো ভাঙবে— এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যতক্ষণ সুবিধা পাবে ততক্ষণ তারা দলে থাকবে। সুবিধা না পেলে দলে থাকবে না, ভাঙন ধরাবে— এটাই স্বাভাবিক। আর স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিভিন্ন দলের নেতাদের রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধা দিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তারা বিভিন্ন সময় সুবিধা নিয়েছেন। সুবিধাবঞ্চিত হলে দলত্যাগ করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় এখন যারা সুবিধা পাবেন না তারা দলত্যাগ করবেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নেতারা যারা আছেন, তারা প্রচণ্ড সুবিধাবাদী। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে তারা সব ধরনের সুবিধা নিতে চান। তাদের মধ্যে আদর্শবাদী কোনো জায়গা নেই। নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। তাদের দলে ভাঙন হবে, বিপর্যয় হবে— এটাই স্বাভাবিক।’
‘জাতীয় পার্টি এক সময় পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগে পরিণত হবে’— মনে করেন সাব্বির আহমেদ। তার মতে, ‘যে দল কতগুলো সুবিধাবাদী নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই দলের পরিণতি এমনই হয়। এ–যাবৎকালে নির্বাচিত হয়ে সরকারের তোষণ ছাড়া তাদের কোনো ভূমিকা নেই।’
এএইচআর/এমএআর/