শুধু পরিবারই নয়, টিফিন বক্সেও পুষ্টিবঞ্চিত শিশুরা
রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প বাজারে মাংসের দোকানে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় কিরণ দাসকে। চার সন্তানের জনক কিরণ দাস অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে খাসির মাংসের দাম শুনে ফিরে যান মুরগির দোকানে। আড়াই শ টাকায় দেড় কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনে ফেরার পথে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় এ ভবন নির্মাণশ্রমিকের।
তিনি জানান, অল্প বয়সে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি তিন সন্তানের মধ্যে ১২ বছরের ছেলে স্কুলে যাচ্ছে, দুই মেয়ে এখনো স্কুলের গণ্ডিতে পা রাখেনি। স্ত্রী গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। দুজনের আয় প্রতিদিন গড়ে ৭০০ টাকা। মাংস খাওয়া তাই আদিখ্যেতা মনে হয়।
কিরণ দাসের ভাষ্য, বাচ্চাদের খাসির মাংস খুবই পছন্দ। জেনেভা ক্যাম্পে মাংসের দাম তুলনামূলক কম। তবুও এক কেজি খাসির মাংস কেনার সাহস করিনি। তারা দাম চাচ্ছে ১০৫০ টাকা। একটু চিন্তা করে মাংস কেনা বাদ দিয়েছি। কারণ, এক কেজি মাংসের টাকায় ১৫ কেজি মোটা চাল ও দেড় কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনতে পারব। খাসির মাংস পাতে না উঠলেও অন্তত মাসের অর্ধেকটা বাচ্চারা পেট ভরে খেতে পারবে।
এরপরও ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে একটি জায়গায় সবাই হাত দিয়েছেন, সেটি হলো ‘খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট’। এটি করতে গিয়ে আমিষসমৃদ্ধ পণ্যসহ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির ঘাটতি আরও বেড়েছে। বড় খেসারত দিতে হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে অনেক শিশু ও প্রসূতি মা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। স্কুলগামী শিশুশিক্ষার্থীদের টিফিনের খাবারেও এসেছে পরিবর্তন
কিন্তু শুধু ভাত-সবজি আর ব্রয়লার মুরগি দিয়ে কত দিন? এর উত্তর জানা থাকলেও কিছুই যেন করার নেই। ‘বাচ্চারা খাসির মাংস খেতে চায় কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যয় যে বেড়েছে দ্বিগুণ’— বলেন কিরণ দাস।
শুধু কিরণ দাস নয়, তার মতো অসহায় অবস্থা স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের। না পারছেন কাউকে কিছু বলতে, না পারছেন কারো কাছে হাত পাততে! অন্যদিকে, বিক্রেতারা বলছেন, ডিম বিক্রি যেমন কমেছে তেমনি কমেছে মাছ, মাংস, দুধসহ অন্য সব পুষ্টিকর খাবারের বেচা-বিক্রিও। ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ কেনার সাহস করছেন না অনেক ক্রেতা। রুই, কাতলার পরিবর্তে অনেকের পছন্দ এখন চাষের তেলাপিয়া ও পাঙাশ।কিরণ দাসের বক্তব্য এবং বাজারের সার্বিক চিত্রই যেন বলে দেয় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বাজারে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার চাপে বেসামাল অবস্থা স্বল্প আয়সহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেউ স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, কেউ-বা কম ভাড়ার ছোটো বাসায় উঠছেন৷
আরও পড়ুন
এরপরও ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে একটি জায়গায় সবাই হাত দিয়েছেন, সেটি হলো ‘খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট’। এটি করতে গিয়ে আমিষসমৃদ্ধ পণ্যসহ পুষ্টিকর খাবার কেনা কমিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির ঘাটতি আরও বেড়েছে। বড় খেসারত দিতে হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের। পুষ্টিকর খাবার না পেয়ে অনেক শিশু ও প্রসূতি মা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। স্কুলগামী শিশুশিক্ষার্থীদের টিফিনের খাবারেও এসেছে পরিবর্তন!
শিশুর পুষ্টিগত চাহিদার ক্রমবর্ধমান গতির সঙ্গে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিতের গুরুত্ব তুলে ধরে শিশুবিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, শিশুর শরীর ও মস্তিষ্ক বিকাশের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সংকীর্ণতা তৈরি হয়েছে। বিনোদন, খেলাধুলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ও মাঠ কমে গেছে। এখন যদি শিশুর পুষ্টিকর খাদ্যতালিকাতেও টান পড়ে তাহলে ভবিষ্যতে বড় ঝুঁকিতে পড়বে দেশ, খর্বাকৃতিসহ রুগ্নতার শিকার হবে শিশুরা। সামাজিক অস্থিরতা ও বাল্যবিবাহ বাড়বে, বাড়বে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুশিক্ষার্থীর সংখ্যাও।
বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বারটান) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাসনীমা মাহজাবীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পণ্যের মূল্য অবশ্যই পুষ্টির জোগানে প্রভাব ফেলে। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘৯০ টাকার ডিম দেড় শ টাকা হলেও পুষ্টিচাহিদা একই। কিন্তু আগের মতো দাম অনুযায়ী শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে কি? খাদ্যনিরাপত্তা বলতে খাদ্যের ক্রয়ক্ষমতা ও খাদ্যের সহজলভ্যতা দুটোই বোঝায়। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন। অন্য উপায় হচ্ছে মানুষের আয় বাড়ানো।’
টিকে থাকতে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট
স্বল্প আয় বা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে পুষ্টি নয়, টিকে থাকাই এখন যেন অনেকের মূল লক্ষ্য। এর বড় কারণ, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই আর স্বাভাবিক আয়ে ফেরেননি।
করোনাকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন মিনহাজুল আবেদীন। বেশ চলছিল দিনকাল। করোনার সময় সব এলোমেলো হয়ে যায়। খরচ কমাতে অফিসের কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকায় পড়তে হয় তাকেও। ওই সময় পরিবার নিয়ে হঠাৎ আয়শূন্য মিনহাজ ব্যয় মেটাতে ভ্যানে করে বাসায় বাসায় সবজি বিক্রি শুরু করেন।
বাস্তবতা বদলে গেছে, করোনা পরিস্থিতিও হয়েছে স্বাভাবিক। শুধু স্বাভাবিক হয়নি মিনহাজের জীবন। নতুন চাকরি মিললেও বেতন যেমন আগের মতো নয়, তেমনি জীবনযাত্রায় ব্যয়ও বেড়েছে বেশ।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘করোনাকালে চাকরি হারানোর পর অনেক কষ্ট করেছি। ২০২২ সালে আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছি। কিন্তু আগের মতো আর সামলানো যাচ্ছে না। সবকিছু যেন বেসামাল, নিয়ন্ত্রণহীন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া এক সন্তানের স্কুল খরচা, আরেক শিশুসন্তানের অসুস্থতা, নিত্য সব পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে আয়-ব্যয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। বাসা বদলে মিরপুরের ছোট্ট একটি ঘর নিয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছি।’
শিশুর শরীর ও মস্তিষ্ক বিকাশের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সংকীর্ণতা তৈরি হয়েছে। বিনোদন, খেলাধুলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ও মাঠ কমে গেছে। এখন যদি শিশুর পুষ্টিকর খাদ্যতালিকাতেও টান পড়ে তাহলে ভবিষ্যতে বড় ঝুঁকিতে পড়বে দেশ, খর্বাকৃতিসহ রুগ্নতার শিকার হবে শিশুরা। সামাজিক অস্থিরতা ও বাল্যবিবাহ বাড়বে, বাড়বে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুশিক্ষার্থীর সংখ্যাও
‘করোনাকালে যেমন চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছিলাম, তেমনি এখন খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করছি। খারাপ লাগে দুই বাচ্চার জন্য। টিকে থাকার জন্য আগের মতো দুধ, কলা, ডিম, বাদাম কিংবা ওটস ওদের খাওয়াতে পারি না। খরচের হিসাবে কাটছাঁটে ওদের (সন্তান) পুষ্টিতে টান পড়ছে। বাস্তবতা হলো, খাদ্যপণ্য ছাড়া আর কাটছাঁটের জায়গাও নেই।’
স্কুলগামী শিশুর টিফিন থেকে বাদ পড়ছে পুষ্টিকর খাবার
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস ওঠার প্রভাব শুধু পরিবারের খাদ্যতালিকা কাটছাঁটে সীমাবদ্ধ নেই। স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের টিফিনেও এসেছে পরিবর্তন। টিফিনে ডিম, কলা, ফলমূলের পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে কেক বা বিস্কুট। অনেক অভিভাবক টিফিন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। সরেজমিন বেশ কয়েকটি স্কুল পরিদর্শনে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
মিরপুর ৬০ ফিট এলাকার গ্লোবাল স্কুলের এক শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাঁচ বছর ধরে এ স্কুলে শিক্ষকতা করি। আমিসহ সহকর্মীদের বাচ্চাদের টিফিন থেকে শুরু করে অনেক কিছু সামলাতে হয়। চলতি বছরের মতো এত খারাপ অবস্থা আগে দেখিনি। আগে বাচ্চাদের টিফিনে আপেল, ডিম, কলা বা বাদাম; কিছু না কিছু থাকত। এখন এর পরিবর্তন এসেছে। অনেক মা বাচ্চাদের টিফিনে পুষ্টিকর খাবারের পরিবর্তে দিচ্ছেন ‘টিফিন’ নামক কেক কিংবা বিস্কুট। অনেক অভিভাবক বাচ্চার টিফিন দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন।
অজয় কর (ছদ্মনাম) নামের এক অভিভাবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে বড় দুঃস্বপ্নের যাত্রায় আছি। বেতন পাই ২৪ হাজার টাকা। ছেলে ও বড় মেয়ের স্কুলের খরচ আর বাড়িভাড়া দিতেই সব শেষ হয়ে যায়। করোনাকাল আরও কঠিন করে দিয়েছে সবকিছু। খরচ কমাতে বাসা বদলেছি। বাজারের অবস্থা নিয়ন্ত্রণহীন, সবকিছুর খরচ দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। কিন্তু বেতনটা বাড়েনি। আয় না বাড়লেও খরচের খাত বেড়েছে। এখন কাটছাঁটের জায়গায় ওই একটাই, খাওন কমাও। সেটাই করছি।’
‘বাচ্চাদের টিফিন দেওয়াও বন্ধ করেছি। বায়না ধরলে মাঝেমধ্যে হাতে ১০ বা ২০ টাকা দিয়ে বলি কিছু খেয়ে নিও। নিজের অবস্থা মিসকিনের চেয়েও খারাপ। কিছু বলতে পারি না, সইতেও পারি না।’
বনমালির জানা কষ্ট, অব্যক্ত আর্তনাদ
রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে জীবনের ২৪টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বাবুল রিষি। জুতা সেলাইয়ের কাজ করা বাবুল রিষি সবার কাছে ‘বনমালি’ নামেই পরিচিত। ১২ বছর বয়সে ঢাকায় আসা বনমালি প্রথমে বাবার সঙ্গে, পরে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে ডিআরইউ চত্বরের সামনে জুতা সেলাইয়ের কাজে হাত পাকান।
বর্তমানে ৩৬ বছরের বনমালি নিজের তিন শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে, এরপর মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে এখনো বুঝতে শেখেনি বাবার জীবনের লড়াইটা।
বনমালি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে সারাদিনে ৩০০ টাকা আয় হতো। খেয়েদেয়েও ১০০ টাকা হাতে থাকত। এখন দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকাও আয় হয়। তবুও কুলাতে পারি না। খরচ বেড়ে গেছে।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘২৪ বছর ধরে যে লড়াইটা করতেছি, চাই না আমার তিন সন্তানের কেউ সেটা করুক। কিন্তু বাস্তবতা এখন অনেক কঠিন। চাল ৬০ টাকার নিচে নাই, সবজি সব ৬০ টাকার ওপরে, পেয়াজ-ডিম দেড় শ ছুঁই ছুঁই। রসুন-আদা ২৫০-৩০০ টাকা কেজি। আলুর নাগাল আর পাই না। মাংস শেষ কবে খেয়েছি তা বলতে পারব না। মাছ-মুরগির বাজারে যাবার মতো হিম্মত হয় না।’
বেঁচে থাকাটাই এখন লড়াই মনে হয় বনমালির। বলেন, ‘হয় আয় আরো বাড়াতে হবে, নয়তো খরচ কমাতে হবে। আয় তো সেভাবে বাড়েনি। উল্টো খরচ অনেক বেড়েছে। বাধ্য হয়ে খরচ কমাতে কাটছাঁট করতাছি। আগে মাসে মাছ খাইতাম পাঁচ দিন, এখন তিন দিন। মুরগি একবারের বেশি কুলানো যায় না। ডিম কেনাটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। দুধ, কলা, ফলমূল, বাদাম— এসব আর মাথায় আনি না।’
শিশুস্বাস্থ্য বিকাশে প্রতিদিন ডিম, সপ্তাহে তিন দিন মাছ খাওয়া প্রয়োজন
পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার শিশুর মস্তিষ্ক সক্রিয় ও সতেজ রাখে। মস্তিষ্ক সক্রিয় ও সতেজ থাকলে শিশুর মেধা ও বুদ্ধির বিকাশ দ্রুত হয়। শিশুদের বেড়ে ওঠায় যেসব খাবার অনেক বেশি ভূমিকা রাখে সেগুলো পরিমিত পরিমাণে খাওয়ানোর পরামর্শ জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডায়টেশিয়ান আয়েশা সিদ্দিকার।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের পাকস্থলী ছোট। তাই তাদের পেট অল্পতেই ভরে যায়। এক্ষেত্রে অল্প পরিমাণ করে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। পনিরে আছে প্রচুর আমিষ ও ক্যালসিয়াম, যা সুস্থ হাড় ও দাঁতের জন্য আবশ্যক। একই সঙ্গে দাঁতের ক্ষয়রোধ করে। শিশুর মস্তিষ্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির উপযুক্ত বিকাশে তাকে ছয় মাস বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।’
ডিমে রয়েছে প্রচুর আয়রন। যা লোহিত কণিকা তৈরি করে রক্তের উপাদানে সঠিক মাত্রা বজায় রাখে। এটি মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ায়। যা চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে সহায়ক। সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এগুলো খাওয়ানো উচিত। কলা এমন একটি ফল, যা তুলনামূলক সস্তা ও প্রচুর পরিমাণে বলকারক কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাযুক্ত। প্রতিদিন একটি করে কলা শিশুর পুষ্টির অনেক কিছু পূরণ করে।
রুই-কাতলা বা ইলিশ নয়, পছন্দ এখন তেলাপিয়া ও পাঙাশ
রাজধানীর উত্তর পীরেরবাগ ছাপড়া মসজিদ বাজারের মাছবিক্রেতা তরিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রুই, কাতলা, ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করি। এখন এসব মাছের বিক্রি কমেছে। দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতার অবস্থা বুঝে এখন রাখতে হচ্ছে তেলাপিয়া ও পাঙাশ। রুই-কাতলার বদলে অনেকের পছন্দ এ দুই মাছ। ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ কেনার সাহস করছেন না অনেক ক্রেতা।
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার অলি মিয়ার টেক বউ বাজারের ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে যারা এক খাঁচা (৩০ পিস) ডিম কিনতেন তারা এখন কিনছেন এক ডজন। যারা ডজন ডিম কিনতেন তাদের অনেকেই সপ্তাহে একবার আসেন এক হালি ডিম কিনতে।
টিসিবির মূল্য তালিকা বলছে, আমিষ স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ‘না’
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের পণ্যের বাজারদর বলছে, রুই প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ৩৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা। যা গত সপ্তাহ এবং গত মাসেও প্রায় একই ছিল। ছোট সাইজের ইলিশের কেজি ৬০০ টাকা। এক কেজি সাইজের ইলিশ ১৩০০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি ৭৩০-৭৫০ টাকা। তবে, বাজারে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে ঘুরছে দাম।
টিসিবি বলছে, খাসির মাংসের কেজি এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৬৫ থেকে ১৭৫ টাকা বলা হলেও বাজারে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগির কেজি ৫০০ টাকা বলা হলেও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
টিসিবির নিত্যপণ্যের মূলতালিকা বলছে, প্যাকেটজাত দুধ সবার জন্য নয়। বিভিন্ন ধরনের গুঁড়া দুধ (প্যাকেটজাত) ৭৮০ থেকে ৮৩০ টাকার মধ্যে। ডিম (ফার্ম) প্রতি হালি ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। গত সপ্তাহে যা ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। তবে, বাজারে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা হালিতে বিক্রি হচ্ছে ফার্মের ডিম।
খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ
দেশের মানুষের বড় অংশ এখন খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। খাবার কেনার জন্য কেউ কেউ পরিবারের কোনো না কোনো সম্পদ বিক্রি করছেন। কেউ কেউ ঋণও করছেন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপভিত্তিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গত বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিগত ছয় মাসে তাদের ওপর বড় আঘাত কী? জবাবে ৮৮ শতাংশ মানুষ ‘খাদ্যের চড়া দাম’ বড় আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ।
আরও পড়ুন
সামগ্রিকভাবে দেশের ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন (আগস্ট- ২০২২)। নিম্ন আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রা ও খাদ্য পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। এ পরিস্থিতির জন্য মূলত খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগবালাইয়ের মতো স্বাস্থ্যসমস্যা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে।
অপুষ্টির প্রভাবে দেশে ২৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়
অপুষ্টির কারণে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। এসব শিশুর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। তাদের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের চলতি বছরের ২৩ মে প্রকাশিত ‘শিশুর অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের শুরুতে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, পুষ্টি প্রতিটি শিশুর অধিকার। পুষ্ট শিশু পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠতে এবং উন্নতি করতে পারে। তারা স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের অধিকারী হয়, তারা শেখা ও চর্চার ক্ষেত্রে ভালো করে, তারা দারিদ্র্য থেকে দূরে থাকে। বৈশ্বিকভাবে অপুষ্টি কমে এলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে অন্তত একটি ক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বাড়ছে। আগের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ওজনের শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।
বৈশ্বিক প্রতিবেদনটি বলছে, বাংলাদেশে বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম— এমন শিশুর সংখ্যা কমছে। ২০১২ সালে যা ছিল ৩৯ শতাংশ বা ৬০ লাখ ৪৬ হাজার। বর্তমানে ২৬ শতাংশ বা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার। তবে, এ সংখ্যাকেও ‘উচ্চ হার’ বলছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংক।
প্রতিবেদনের তথ্যগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন— উল্লেখ করে পুষ্টিবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের দেশীয় পরিচালক সাইকা সিরাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শিশু অপুষ্টির আলোচনায় প্রথমে শিশুদের উচ্চতার প্রসঙ্গ চলে আসে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। খর্বকায় শিশুদের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এ সমস্যা জীবনভর চলে এবং এর পরিণাম পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছায়। অপুষ্টির দ্বিগুণ বোঝা নিরসনে বহু খাতভিত্তিক পুষ্টিব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য বিভাগগুলোর পুষ্টি সহায়ক কার্যক্রমগুলো জোরদার করা উচিত।’
পরিবারের আয়ের সঙ্গে পুষ্টির সম্পর্ক রয়েছে— উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘আয় কমলে, অন্যদিকে ব্যয় বাড়লে প্রথমে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট শুরু হয়। মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের পরিবার থেকে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসসহ আমিষ জাতীয় খাদ্য উঠে যাচ্ছে। খাদ্য সংকট বা অপুষ্টির কারণে শিশুদের প্রথমে ওজন কমে। প্রসূতি মায়েরা সঠিক খাদ্য পান না। যার বড় খেসারত দিতে হয় অনাগত শিশুদের। পারিবারিক খাদ্যতালিকা থেকে যদি প্রাণীজসহ পুষ্টিকর খাদ্য বাদ যায় তাহলে ভবিষ্যতে শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বেই।’
শিশুর পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্যতা নিশ্চিতের পরামর্শ ইউনিসেফের
ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী, শিশুর পুষ্টিগত চাহিদার ক্রমবর্ধমান গতির সঙ্গে তাদের প্রাপ্য খাবারের চাহিদা তাল মেলাতে ব্যর্থ হওয়ায় বৈশ্বিকভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী রুগ্নতার শিকার হওয়া শিশুদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ দুই কোটি ৩০ লাখ শিশু যাদের বয়স দুই বছরেরও কম, তাদের মধ্যে খর্বাকৃতির সমস্যা দ্রুত বাড়ছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ খাদ্য সম্মেলনের আগে ইউনিসেফের প্রকাশিত ‘ফেড টু ফেইল : দ্য ক্রাইসিস অব চিলড্রেন্স ডায়েটস ইন আর্লি লাইফ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের হার, অসমতা, সংঘাত, জলবায়ু-সংক্রান্ত দুর্যোগ এবং কোভিড- ১৯ মহামারির মতো জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিশ্বে সবচেয়ে কম বয়সীদের মাঝে বিদ্যমান পুষ্টি সংকটকে প্রকট করেছে। এ ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে খুব সামান্যই উন্নতির লক্ষণ দেখা গেছে। ইউনিসেফের ওই প্রতিবেদনে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তার প্রথমেই আছে উৎপাদন, বিতরণ এবং খুচরা পর্যায়ে বিক্রয়কে উৎসাহিত করার মাধ্যমে ফল, শাক-সবজি, ডিম, মাছ, মাংস এবং শক্তিবৃদ্ধি করে এমন খাবারসহ পুষ্টিকর খাবারের প্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।
নিত্যপণ্যের মূল্য কমানো-বাড়ানো সরকারের দায়িত্ব
সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ঝুঁকির মধ্যে চলে যাচ্ছে দেশ। মূল্যস্ফীতির কারণে লাগামহীন সব পণ্য। দিশেহারা হচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। সরকারের উদ্যোগ থাকলেও তেমন ফলপ্রসূ নয়। মূল্যস্ফীতি কমানো না গেলে কষ্ট আরও বাড়বে স্বল্প আয়ের মানুষের। এর বড় প্রভাব সরাসরি পড়বে শিশুদের ওপর।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিষয়ক লেখক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সরকার দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের পরিসংখ্যান দিয়েছে সেটা ভুল। কারণ, মানুষের আয় ও বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী দারিদ্র্যের সংখ্যা সরকারের হিসাবের চেয়েও বেশি।
‘মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। যারা মাছ-মাংস খেতে পারছেন না, তারা খাওয়া কমাচ্ছেন। প্রসূতি মা যদি পুষ্টি না পান, সেটার প্রভাব তো অনাগত শিশুর ওপর পড়বেই। শিশুর শারীরিক গঠনের সময় যদি আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুষ্টিকর খাবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকে সেটার প্রভাব সরাসরি শিশুর ওপরেই পড়ে। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা কিন্তু জাতীয় সমস্যা। তাদের জন্য পুষ্টি সরবরাহ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। অথচ এ জায়গায় সরকারকে আমরা খুবই নির্লিপ্ত দেখি।’
‘ক্রমাগত মানুষের সত্যিকারের আয় কমলেও সামঞ্জস্যতা রক্ষার উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব স্পষ্ট’— উল্লেখ করে তার পরামর্শ, ‘সরকারের উচিত আয় অনুযায়ী পুষ্টির জোগান সহজ করা। পুষ্টিকর খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম কমানো বা আয় বাড়ানো। এটা করতে পারলে শিশুর পুষ্টির অভাব হবে না। কারণ, কোনো অভিভাবক চান না তার সন্তান অপুষ্টিতে বড় হোক।’
সবকিছুর আগে উচিত শিশুর স্বার্থ দেখা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক এম আনওয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা সৎপথে আয় করেন কিংবা স্বল্প আয়ের মানুষ তারা বিপাকে আছেন। আয়ের সঙ্গে তাদের ব্যয়ের অসঙ্গতি বা ফারাক অনেক। বর্তমান বাজার-ব্যবস্থা স্বল্প আয়ের মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অবস্থা এমন আপেল নয়, পেয়ারা কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছেন স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা। এটা কিন্তু সামাজিক বৈকল্য তৈরি করবে।
‘সরকার সবই জানে। সরকারের স্টেকহোল্ডারগুলো জানে কোথায় এবং কীভাবে রাষ্ট্রের অর্থ বণ্টন করতে হবে। কিন্তু হচ্ছে না। পলিসি এক্সপার্টরা বারবার শিশুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সামনে আনলেও সমাধান দেখছি না। আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ শিশুরা যাতে পুষ্টিকর খাবার পায় সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেটা না হলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে, অপুষ্টিতে ভুগবে শিশুদের বড় একটি অংশ। বাল্যবিবাহ বাড়বে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুশিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়বে।’
জেইউ/এমএআর/