বিনামূল্যের পাঠ্যবই সময় মতো পৌঁছাবে কি?
আগামী বছরের জন্য মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ২১ কোটি ৩২ লাখ ৭৯ হাজার ৯১১ কপি বই ছাপার কথা। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২৩ শতাংশ বই উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণির একটি বইও এখনো ছাপা হয়নি। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছেছে মাত্র পাঁচ কোটি ৩২ লাখ পিস। এ দুই শ্রেণির ‘ইতিহাস’ ও ‘সামাজিক বিজ্ঞান’ বই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর পাণ্ডুলিপি তৈরিতে অনেক দেরি হয়েছে। সংশোধিত পাণ্ডুলিপি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর গত সপ্তাহ থেকে ছাপার কাজ শুরু হয়েছে
আগামী শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে মহা সংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নির্বাচনী বছর হওয়ায় অক্টোবরের মধ্যে শত ভাগ বই ছেপে মাঠপর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু রোববার (১২ নভেম্বর) পর্যন্ত প্রাথমিকের ৫০ শতাংশ বই উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছেছে। মাধ্যমিকের বই ছাপা নিয়েও তৈরি হয়েছে বিড়ম্বনা। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপা শুরু হলেও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) গত বুধবার (৮ নভেম্বর) দেওয়া হয়েছে। নবম শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি এখন পর্যন্ত প্রস্তুত করতে পারেনি এনসিটিবি। সবমিলিয়ে নতুন বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার সরকারের যে সাফল্য তা ম্লান হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় ৩১ কোটি বই ছাপার কাজ চলছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের বই ১৮ কোটি ৬১ লাখ এক হাজার ২০৬টি। প্রাথমিক স্তরের বই প্রায় নয় কোটি ৫০ লাখ। এ ছাড়া, ইবতেদায়ির জন্য দুই কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৫ বই ছাপা হচ্ছে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বছরের জন্য মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ২১ কোটি ৩২ লাখ ৭৯ হাজার ৯১১ কপি বই ছাপার কথা। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২৩ শতাংশ বই উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণির একটি বইও এখনো ছাপা হয়নি। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই উপজেলাপর্যায়ে পৌঁছেছে মাত্র পাঁচ কোটি ৩২ লাখ পিস। এ দুই শ্রেণির ‘ইতিহাস’ ও ‘সামাজিক বিজ্ঞান’ বই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর পাণ্ডুলিপি তৈরিতে অনেক দেরি হয়েছে। সংশোধিত পাণ্ডুলিপি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর গত সপ্তাহ থেকে বই দুটির ছাপাকাজ শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন
এনসিটিবি সূত্র আরও জানিয়েছে, নির্বাচনী বছর হওয়ায় হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবে। ছাপাখানাগুলো (প্রেস) নির্বাচনীসামগ্রী ছাপায় ব্যস্ত থাকবে। এসব কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষে অষ্টম ও নবম শ্রেণির নতুন কারিকুলামের বই শিক্ষার্থীদের দিতে রাজি ছিল না এনসিটিবি। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের চাপে এ দুই শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের বই ছাপাতে বাধ্য হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। নতুন কারিকুলামে তৈরি করা পাণ্ডুলিপি মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্তাব্যক্তি নিজেরা দেখে ছাপার জন্য অনুমোদন দেবেন। যে কারণে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে বই ছাপাতে দেরি হচ্ছে।
নির্বাচনী বছর হওয়ায় হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবে। ছাপাখানাগুলো (প্রেস) নির্বাচনীসামগ্রী ছাপায় ব্যস্ত থাকবে। এসব কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষে অষ্টম ও নবম শ্রেণির নতুন কারিকুলামের বই শিক্ষার্থীদের দিতে রাজি ছিল না এনসিটিবি। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের চাপে এ দুই শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের বই ছাপাতে বাধ্য হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। নতুন কারিকুলামে তৈরি করা পাণ্ডুলিপি মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্তাব্যক্তি নিজেরা দেখে ছাপার জন্য অনুমোদন দেবেন। যে কারণে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে বই ছাপাতে দেরি হচ্ছে
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই বাতিল করায় পাণ্ডুলিপি তৈরিতে দেরি হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই এ দুই শ্রেণির বই ছাপা হয়ে যাবে। অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার জন্য আজ মুদ্রাকরদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। নবম শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ এখনও শেষ হয়নি। দ্রুত হয়ে যাবে।
নতুন বছেরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ যারা পেয়েছেন তারা এক মাসের মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করতে পারবেন।’
বইয়ের মান রক্ষায় কড়াকড়ি
এদিকে, শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত বই তুলে দিতে শুরু থেকেই কড়াকড়ি আরোপ করেছে এনসিটিবি। মাধ্যমিক বইয়ের মান রক্ষা করা সম্ভব হলেও প্রাথমিক স্তরে বিতর্কিত ও নতুন এজেন্সিকে কাজ দেওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি।
এনসিটিবি সূত্র বলছে, মাধ্যমিক স্তরের কাজ শুরুর পর গত শনিবার পর্যন্ত ১৪টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঁচ লাখ বই বাতিল করে কেটে ফেলা হয়েছে। নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ছাপানোর আগ মুহূর্তে ১৫০০ টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হওয়া কাগজ ছাপাখানা থেকে অন্যত্র সরানো হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে নিয়োজিত পরিদর্শন এজেন্সি শেখ ট্রেডিং অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসেস-এর কঠোর তদারকির কারণে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার চেষ্টা রোধ করা সম্ভব হয়েছে। তবে, প্রাথমিকের ১০ কোটি বেশি বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত পরিদর্শন এজেন্সি ‘ইনফিনিটি’-এর সঙ্গে একজন প্রভাবশালী মুদ্রাকর জড়িত। তিনি ইচ্ছামাফিক বই ছাপাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন
নিম্নমানের কাগজে কত সংখ্যক বই বাতিল হয়েছে তা জানাতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনসিটিবি। এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এবার বইয়ের মান রক্ষায় কোনো আপস করা হবে না। নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বই ছেপে সরবরাহ করতে হবে। যাদের ছাপায় সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে তাদের বই বাতিল করা হচ্ছে। নিম্নমানের বই কেটে ফেলারও নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যাতে এ ধরনের বই কেউ ব্যবহার করতে না পারে।
‘বইয়ের মান রক্ষায় আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। পরিদর্শন টিম এবার বেশ তৎপর। বইয়ের মান রক্ষায় যা যা দরকার সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।’
এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, কাগজের মান ও ছাপা হওয়া বইয়ের মান ঠিক রাখতে ইন্সপেকশন এজেন্সি ছাড়াও এনসিটিবির কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক ছাপাখানায় যাচ্ছেন। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এবার একজনের পরিবর্তে দুজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে টিম করে দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিকের বইয়ের মান নিয়ে এখনও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তবে প্রাথমিকের বিষয়ে তিনি জানান, এ স্তরে দুভাবে মনিটরিং হয়। ইন্সপেকশন এজেন্সি নিয়োগ দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
মাধ্যমিক স্তরের কাজ শুরুর পর গত শনিবার পর্যন্ত ১৪টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঁচ লাখ বই বাতিল করে কেটে ফেলা হয়েছে। নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ছাপানোর আগ মুহূর্তে ১৫০০ টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে। বাতিল হওয়া কাগজ ছাপাখানা থেকে অন্যত্র সরানো হয়েছে
চার স্তরের তদারকি
বই ছাপার সঙ্গে জড়িতরা জানান, মাধ্যমিকের বিনামূল্যে পাঠ্যবইয়ের মান নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থানে এনসিটিবি। বই ছাপার আগে তিন স্তর এবং পরে এক স্তর, মোট চার স্তরে তদারকি করছে পরিদর্শন এজেন্সি শেখ ট্রেডিং অ্যান্ড ইন্সপেকশন। শুধু তা-ই নয়, গভীর রাতে নিম্নমানের বই ছাপানো ঠেকাতে এবার প্রত্যেকটি ছাপাখানায় ২৪ ঘণ্টার জন্য তদারকি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কাগজের মান (স্থায়িত্ব ও জিএসএম) ঠিক না থাকায় এরই মধ্যে ১৫০০ টনের বেশি কাগজ ও পাঁচ লাখ বই বাতিল করা হয়েছে। পরিদর্শন এজেন্সির কড়াকড়িতে অনেক ছাপাখানা থেকে নিম্নমানের কাগজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রতি বছরের মতো এবারও পাঠ্যবইয়ের কাগজের মান ঠিক রাখার জন্য দরপত্রে স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করে দেয় এনসিটিবি। এবার দরপত্রে প্রাথমিকের বই ছাপার কাগজের পুরুত্ব (জিএসএম) ৮০ এবং মাধ্যমিকের বই ছাপার কাগজের পুরুত্ব ৭০ থাকার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া, ব্যবহৃত কাগজ কতখানি মজবুত তার নির্দেশনাকারী ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ ন্যূনতম ১২ শতাংশ থাকার কথা বলা হয়েছে।
যাদের কাগজ ও বই বাতিল
মাধ্যমিক স্তরের পরিদর্শন সংস্থা ‘শেখ ট্রেডিং অ্যান্ড ইন্সপেকশন’ গত শনিবার (১১ নভেম্বর) পর্যন্ত ১৫০০ টন কাগজ এবং পাঁচ লাখ ছাপা বই বাতিল করেছে। সরকার প্রিন্টিং প্রেসের ৩৫০ টন কাগজ, লেটার অ্যান্ড কালারের ১০০ টন, টাইম মিডিয়া প্রেসের ২০০ টন, বর্ণমালা প্রিন্টিং প্রেসের ১০০ টন, দিগন্ত প্রিন্টিং প্রেসের ১০০ টন, ভাই ভাই প্রেসের ৫০ টন এবং মোল্লা প্রিন্টিং প্রেসের ৫০ টন কাগজ বাতিল করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
এনসিটিবির বিতরণ শাখা সূত্রে জানা যায়, মাধ্যমিক স্তরে কাগজের পুরুত্ব ৭০ জিএসএম থাকার কথা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠান ৬০ থেকে ৫৪ জিএসএম দিয়ে বই ছাপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরে পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের এসব কাগজ বাতিল করে।
জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে বই ছাপায় বিলম্ব হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাও রয়েছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে সরকারের শিক্ষা খাতের সবচেয়ে বড় সাফল্য এবার ম্লান হয়ে যাবে।
‘এনসিটিবির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বেশির ভাগ বই নিউজ প্রিন্ট কাগজে ছাপা হচ্ছে। ছয় মাসও পড়তে পারবে না শিক্ষার্থীরা।’ অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার ওয়ার্ক অর্ডার না দেওয়ায় ফেব্রুয়ারির আগে বই ছাপা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এনএম/এমএআর