সামনে আরও ‘কার্ড’ প্রয়োগ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র
প্রায় দুই বছর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এ বাহিনীর সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা এবং এর প্রয়োগ শুরু করেছে দেশটি। সামনের দিনে বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও চাপ বাড়াতে পারে দেশটি। নেওয়া হতে পারে আরও নানা পদক্ষেপ।
ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করা। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় এ অঞ্চলে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় নিজেদের মতো করে বাংলাদেশকে পাশে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য হাসিল করতে দেশটি গণতন্ত্রকে ইস্যু করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে কৌশল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। সেজন্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, শ্রম অধিকারের মতো বিষয়ে বাংলাদেশের যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো কাজে লাগাতে চাইবে দেশটি। নির্বাচনের আগে, এমনকি নির্বাচন-পরবর্তীতে সুবিধা মতো সময়ে এসব ইস্যুকে একেকটি ‘কার্ড’ হিসেবে প্রয়োগ করবে ওয়াশিংটন।
আরও পড়ুন
ঢাকার এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি অন্য যেসব দেশে প্রয়োগ করা হয়েছে সেখানে তা করা হয়েছে নির্বাচনের পরে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে করা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে এসে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আগে থেকে তারা সব তথ্য সংগ্রহ করত; কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাত না। এখন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এখন তারা জানান দিচ্ছে যে, আমার কাছে তোমার এই এই দুর্বল পয়েন্ট আছে। এগুলো তোমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে। তাদের ওপর আমাদের নির্ভরতা অনেক। সেই সুযোগ তারা নিচ্ছে। তারা কিছু একটা পাকাচ্ছে। এত দিন জোগাড় করেছে, এখন একটি একটি করে প্লে করছে। হাতের প্রতিটি কার্ড তারা খেলতে চাইবে।
যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করা। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় এ অঞ্চলে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় নিজেদের মতো করে বাংলাদেশকে পাশে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য হাসিল করতে দেশটি গণতন্ত্রকে ইস্যু করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে কৌশল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। সেজন্য গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, শ্রম অধিকারের মতো বিষয়ে বাংলাদেশের যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো কাজে লাগাতে চাইবে দেশটি। নির্বাচনের আগে, এমনকি নির্বাচন-পরবর্তীতে সুবিধা মতো সময়ে এসব ইস্যুকে একেকটি ‘কার্ড’ হিসেবে প্রয়োগ করবে ওয়াশিংটন
এ কূটনীতিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন কিন্তু সফট পাওয়ার প্লে করছে। সামনে হার্ড পাওয়ার প্লে করতে পারে। আমরা মানবাধিকার বা গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলি না। যখন তারা বলে, আমরা প্রতিক্রিয়া দিই। আমরা নিজেদের থেকে তুলি না। তারাও চুপ করে থাকে। একটা সময়ে এসে ঠিকই ওটাকে কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এখন তারা বসে বসে খেলছে।’
‘যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য এখন ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলো। দেশগুলোকে হাত করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র সামনের দিনে চীনের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করতে পারবে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভারত-নির্ভরতা কমানোর সুযোগও তারা কাজে লাগাতে চাইবে। আর বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে মনোভাব, এখন দেখার বিষয় হচ্ছে ভারত কি ভূমিকা পালন করে? ভারত ভূমিকা পালন করবে কি করবে না, সেটিও এখন বড় প্রশ্ন।’
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে রেজুলেশন, নির্বাচনে বড় পরিসরে পর্যবেক্ষক না পাঠানোসহ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগ শুরু— সবকিছু প্রায় একই সময়ে ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ আলাপ-আলোচনা করে এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্রগুলো আরও বলছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ডেও নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মযজ্ঞ বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখছে।
নাম প্রকাশ না করে ঢাকার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রচুর এনগেজমেন্ট হয়েছে। তাদের এমন কোনো অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নাই, এখানে আসেননি। আমরা যেটি শুনতে পাচ্ছি, ওরা ওপরে ওপরে অনেক কিছু দেখাচ্ছে। ভেতরে কিন্তু ভিন্ন। যেগুলো বলার সেগুলো বলতে থাকবে। বলতে হয় বলবে। আমরা শুনছি, ঢাকা থেকে তাদের প্রতিনিধিরা যে বার্তা পাঠায়, সেখানে (ওয়াশিংটন) কিন্তু দ্বিতীয় মতামতও তারা নিচ্ছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে প্রচারণা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, এটি কিন্তু তাদের স্বার্থেই করছে। সামনে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসন কতটুকু অগ্রগতি করতে পেরেছে, তা তারা নিজ দেশের জনগণকে দেখানোর চেষ্টা করছে। যদি এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি তারা দেখাতে না পারে, সেটি হবে বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতা। এমন ব্যর্থতা তারা কখনও নিতে চাইবে না। তারা বাইরের রাষ্ট্রগুলোতে নিজেদের চাপানো সফলতা দেখাতে পছন্দ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে— এমন কোনো নজির নেই।
আরও পড়ুন
‘দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে মার্কিন উপস্থিতি নেই। মার্কিন আধিপত্য ভারত মহাসাগরের অঞ্চলগুলোতে বজায় রাখতে হলে এখানে তার কিছু বন্ধু-রাষ্ট্রের প্রয়োজন। সেই বন্ধু-রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে তারা। সেজন্য বাংলাদেশ তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের সম্পর্ক। বাণিজ্য, সাহায্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক। সেটি তারা সহজে নষ্ট করতে চাইবে বলে আমি মনে করি না। সেই বিবেচনায় তাদের হাতে যে কার্ড আছে তা ব্যবহার করে নির্বাচনে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে, সেটির কোনো নিশ্চয়তা এখনও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মানুষের ওপরই নির্ভর করছে।’
‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে গেছে’— উল্লেখ করে আবদুর রশীদ বলেন, ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের সঙ্গে হিসেব করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখানে যুক্ত হয়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞার যে রাজনৈতিক প্রচলন যুক্তরাষ্ট্র ঘটিয়েছে, এটি নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। এ অধিকার তাদের কে দিল? অন্য দেশে গণতন্ত্র স্থাপন, জাতিসংঘের অস্তিত্বকে তারা অনেক বেশি খর্ব করছে না?’
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন বিষয়ক একটি পর্যবেক্ষক দল আগামী মাসের শুরুর দিকে এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে আসছে। দেশটির অর্থায়নে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই)-এর প্রতিনিধিদলটি আগামী ৭ থেকে ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশে অবস্থান করবে। তাদের সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ— জানিয়ে এক কূটনীতিক বলেন, ‘ইইউ বলল, নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। সামনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল আসছে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ প্রতিনিধিদলের সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ।’
আরও পড়ুন
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব এবং বাহিনীটির সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন করে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে না। কিন্তু চলতি বছরের মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। সেখানে বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে দেশটির অব্যাহত নজরদারির বিষয়টি উঠে আসে।
মার্কিন ভিসানীতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এরপরও সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু আসছে না। কিন্তু দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার প্রায় চার মাসের মাথায় সম্প্রতি এ নীতিতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ প্রয়োগের ঘোষণা আসে। কারা এর আওতায় পড়ছেন, তা প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। তবে, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সদস্যরা বিধিনিষেধের আওতায় পড়ছেন বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাবেক-বর্তমান সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গণমাধ্যমও আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে যুক্ত হবে
গত ২২ সেপ্টেম্বর ভিসা বিধিনিষেধ ঘোষণার দিন এক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম জানান, নির্বাচনের আগে আর কোনো ধরনের বিবৃতি দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছি যে, এ রকম সেনসিটিভ সময়ে কোনো পদক্ষেপ বা বিবৃতি ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে মনে করা হবে।
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) একটি গণমাধ্যমকে বলেন, প্রয়োজন হলে সামনে আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাবেক-বর্তমান সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গণমাধ্যমও আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে যুক্ত হবে।
এনআই/