৩৪ কোটির হিসাব না মিললেও ‘দায়মুক্ত’ তারা!
মৌলভীবাজারের মনু নদের সেচ প্রকল্পের আওতায় কাশিমপুর পাম্প হাউস। এটির পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে পাম্প ক্রয়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ ওঠে। ২০২০ সালে মামলাও হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্পে কোনো অনিয়ম না পাওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘দায়মুক্তি’ দেয়। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মামলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) যান্ত্রিক বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীসহ আট প্রকৌশলী ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্সের তিন কর্তাব্যক্তিকে আসামি করা হয়। মামলার তিন বছরের মাথায় এসে দুদক বলছে, ‘প্রকল্পের কাজে কোনো দুর্নীতি হয়নি’। যে কারণে মামলার সব আসামিকে কমিশনের সিদ্ধান্তে দায়মুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি এফআরটি’র (ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু) মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়েছে। দুদক থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পাঠানো এক চিঠির সূত্রে এমন তথ্য জেনেছে ঢাকা পোস্ট।
২০১৭ ও ২০১৮ সালের এলসির বিপরীতে এনসিসি ব্যাংকের মাধ্যমে আটটি পাম্পের পরিশোধিত ক্রয়মূল্য ১৭ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার এবং ঠিকাদারের ১৫ শতাংশ লাভসহ মোট ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৪১ লাখ ৬০৩ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর হিসাবে আসে আরও ছয় কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। কিন্তু পাম্প ক্রয়বাবদ ৬১ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার টাকার বিল ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি
ওই প্রকল্পে আসলেই দুর্নীতি হয়নি, নাকি দুদকের তদন্তে কোনো গাফিলতি কিংবা পক্ষপাতিত্ব ছিল, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে। যদিও এ বিষয়ে দুদকের সরাসরি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
তবে, দুদক সচিব মো. মাহাবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তদন্তে দুর্নীতির সত্যতা না পাওয়ায় আইন ও বিধি অনুসরণ করে কমিশন থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বিস্তারিত না জেনে এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া উচিত হবে না।’
আরও পড়ুন >> ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে বসবাস, দুর্নীতি ৬৯০ কোটি!
অন্যদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয়ের যান্ত্রিক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এ হান্নান খাঁন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাম্পগুলোর স্থাপন ২০১৮ সালের জুন মাসে শেষ হয়। এখন পর্যন্ত সেগুলো ভালোভাবেই চলছে। কোনো ত্রুটি দেখা যায়নি।
পাম্প হাউস পুনর্বাসন প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি- দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কাশিমপুর পাম্প প্রকল্পের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানের পর প্রথমে মামলা দায়ের হয়। সেই মামলা গত জানুয়ারিতে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জেনেছি। অর্থাৎ কোনো ধরনের দুর্নীতির না পাওয়ায় দুদক মামলাটি নিষ্পত্তি করেছে।’
মামলা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তরা হলেন- পাউবোর যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী চৌধুরী নাজমুল আলম, পাউবোর পাবনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক এস এম শহিদুল ইসলাম, ঢাকা যান্ত্রিক (পাম্প হাউস) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান, ঢাকার কেন্দ্রীয় যান্ত্রিক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবু তালেব।
এছাড়া দায়মুক্তি পাওয়া কর্মকর্তারা হলেন- ঢাকা যান্ত্রিক (পাম্প হাউস) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এম গোলাম সরওয়ার, পাউবোর নকশা সার্কেল- ৩ (যান্ত্রিক) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্বাস আলী, ডিজাইন সার্কেল- ১ ঢাকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আব্দুল বাছিত ও চাঁদপুর যান্ত্রিক উপবিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রুহুল আমিন এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) প্রকৌশলী সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, চেয়ারম্যান প্রকৌশলী সৈয়দ আরশেদ রেজা ও মহাব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার) প্রকৌশলী আব্দুস সালাম।
সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ মামলা হয়। মামলার তিন বছরের মাথায় এসে দুদক বলছে, ‘প্রকল্পের কাজে কোনো দুর্নীতি হয়নি’। যে কারণে মামলার সব আসামিকে কমিশনের সিদ্ধান্তে দায়মুক্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি এফআরটি’র (ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু) মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়েছে
মনু নদের সেচ প্রকল্পের পটভূমি
মনু সেচ প্রকল্পটি কাউয়াদীঘি হাওর এলাকায় অবস্থিত। প্রকল্পের উত্তরে কুশিয়ারা নদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমে মনু নদ আর পূর্বে ভারতের ভাটেরা পাহাড়। ভারতের ত্রিপুরায় প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে মনু ও ধলাই নদে আকস্মিক বন্যায় ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছিল। নিচু এলাকাগুলোতে দীর্ঘসময় ধরে পানি আটকে থাকায় এলাকায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল। প্রতি বছর গড়ে ছয় হাজার টন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ১৯৭২ সালে মৌলভীবাজারের সদর উপজেলা ও রাজনগর উপজেলার সংশ্লিষ্ট এলাকা নিয়ে মনু নদ সেচ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ১৯৭৫-৭৬ সালে শুরু হয়ে ১৯৮২-৮৩ সালে শেষ হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো- এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ও সেচের মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদন।
আরও পড়ুন >> এমটিএফইর মতো উচ্চপ্রযুক্তির দুর্নীতি ধরতে জাইকার দ্বারস্থ দুদক
কাশিমপুর পাম্প হাউসে কেএসবি, জার্মানির তৈরি মোট আটটি এক্সিয়াল ফ্লো প্রপেলার টাইপ পাম্প স্থাপন করা হয়। যার প্রতিটির কার্যক্ষমতা ছিল ১৫০ কিউসেক (পানির প্রবাহ পরিমাপের একক) অর্থাৎ মোট পাম্পিং ক্ষমতা ১২০০ কিউসেক। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ২৬ হাজার থেকে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ ৯৮ হাজার টনে উত্তীর্ণ হয়। সুদীর্ঘ ৩৫ বছরকাল পার হলে পাম্পগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় নতুন করে প্রকল্প হাতে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরপর ‘মনু নদের সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কাশিমপুর পাম্প হাউস পুনর্বাসন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৬ সালে হাতে নেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে যা পেয়েছিল দুদক
অভিযোগ থেকে অনুসন্ধান শুরুর পর মৌলভীবাজারের কাশিমপুর পাম্প হাউসের আটটি পাম্প প্রতিস্থাপনে কেএসবি, এনড্রিজ ও উইলো ব্রান্ডের দরপত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডে জমা পড়ে। বাপাউবোর কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা তাদের পছন্দনীয় কেএসবি পাম্প সরবরাহ নেওয়ার জন্য কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দরপত্রের পরিবর্তে ডিএমপি পদ্ধতিতে কেএসবি পাম্প গ্রহণের সর্বোচ্চ অনিয়ম করে অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। কিন্তু সিসিইএ সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির পরিবর্তে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে পাম্প ক্রয়ের সিদ্ধান্ত প্রদান করে। দরপত্র দাখিলের জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী, মৌলভীবাজার যান্ত্রিক বিভাগ হতে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লি. বরাবর পত্র প্রেরণ করে। উক্ত পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লি. পাম্প ইউনিট ও প্যানেল বোর্ড প্রতিস্থাপনের দর প্রদত্ত তফশিল মোতাবেক দাখিল করে। এতে আটটি পাম্পের জন্য ৬৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং প্যানেল বোর্ডের জন্য আট কোটি ২২ লাখ টাকাসহ মোট ৭৮ কোটি চার লাখ টাকা দর উল্লেখ করে। পিইসি সভার প্রদত্ত অন্যান্য সিদ্ধান্তের আলোকে মোট ৮৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কমিটি দরপত্র যাচাই করে আটটি নতুন পাম্প সরবরাহ, প্রতিস্থাপন এবং স্কাডা সিস্টেম, রিমোট সেন্সিংসহ আধুনিক প্যানেল বোর্ড প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পাদনের নিমিত্তে পিপিআর- ২০০৮ এর বিধি ৭৬ (১) (ক) মোতাবেক সরাসরি ক্রয় (ডিপিএম) পদ্ধতিতে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অনুকূলে অনুমোদন জ্ঞাপনের সুপারিশ করা হয়। কোনো প্রকার নিয়মনীতি অনুসরণ না করে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা তিনগুণ বেশি দামে কেএসবি পাম্প সরবরাহ নিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে। অর্থাৎ অনুসন্ধান পর্যায়ে পাম্পের মূল্য, দরপত্র প্রক্রিয়া এবং পাম্প ছাড়াও অতিরিক্ত ব্যয় সংক্রান্ত অনিয়মের তথ্য মেলে।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়
দুদক কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান বাদী হয়ে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর এ সংক্রান্ত মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, মনু নদ সেচ প্রকল্পের অধীনে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরের ২৪ হাজার ১৭৮ হেক্টর এলাকার ১৯ হাজার ২২৮ হেক্টর চাষযোগ্য জমির বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ-ব্যবস্থা প্রদান করার লক্ষ্য নিয়ে কাউয়াদীঘি হাওরের কাশিমপুর পাম্প হাউসে দ্বিতীয়বারের মতো স্থাপন করা হয় নতুন পাম্প মেশিন। এ প্রকল্পে আটটি পাম্পের মূল্য দেখানো হয় ৫৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। বাস্তবে দুদকের অনুসন্ধানে প্রকৃত মূল্য পাওয়া যায় ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৩৪ কোটি ৪২ লাখ ১৭ হাজার ১০৬ টাকা ২০ পয়সা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পায় দুদক। যে কারণে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯ ও ১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
আরও পড়ুন >> পেট্রোবাংলার পেটে সরকারের ২২ হাজার কোটি টাকা
তদন্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, পাম্পের মূল অংশ কেএসবি জার্মান থেকে আমদানি করা হলেও আনুষঙ্গিক বেশকিছু সরঞ্জাম মূল কেএসবি’র ডিজাইন ও গাইডলাইন মোতাবেক দেশেই তৈরি করা হয়। যেমন- স্পেয়ার জয়েন্ট অ্যাসেম্বল, ডিসকার্স পাইপ, ফ্লেন্জ, নাট-বল্টু ও গ্যাসকেট ইত্যাদি। অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দাখিল করা পাম্প ক্রয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় দ্বারা সম্পূর্ণ পাম্প সেটের মূল্য নির্ধারণ করে মামলাটি রুজু করা হয়। কিন্তু তদন্তকালে দেখা যায়, আমদানি করা মূল অংশ এবং দেশে প্রস্তুত করা অংশের সমন্বয়ে পাম্পের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া একনেক কর্তৃক অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ঠিকাদার পাম্প ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেন। দুই বছর ধরে ইন্সটলেশন ও কমিশনিং করাসহ অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স করতে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সমাগম করা হয়েছে। এসব বিবেচনায় রেখে পাম্পের সামগ্রিক মূল্য ৬১ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার ২৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন >> জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রিতে করের ‘জটিল অঙ্ক’, পকেট ফুরোবে বিক্রেতার
এছাড়া সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড সঠিক সময়ে সঠিকভাবে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করেছে এবং স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাম্প সরবরাহ করেছে। বর্তমানে পাম্প হাউসটি চালু রয়েছে এবং কাজের মান নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী সঠিকভাবে কাজ সম্পাদনের জন্য বাপাউবো গত ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর কাজ সম্পাদনের সনদ প্রদান করে। চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী পরবর্তীতে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড আরও দুই বছর স্থাপিত পাম্প, স্কাডা সিস্টেম, রিমোট সেন্সিং প্যানেল বোর্ডসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের কাজও যথাযথভাবে সম্পন্ন করে এবং বাপাউবো কর্তৃক ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত একটি সনদ প্রদান করা হয়। ডিপিপি কর্তৃক অনুমোদিত অর্থ এবং একনেক কর্তৃক অনুমোদিত অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত কোনো অর্থ ঠিকাদারকে প্রদান করা হয়নি। এক্ষেত্রে তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ও বর্ণিত ঘটনার আলোকে পাম্প ক্রয়ে অতিরিক্ত মূল্য অথবা অনিয়ম বা দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হলো।
মিলছে না অনেক প্রশ্নের জবাব
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও দুদকের প্রতিবেদন সূত্রে বেশকিছু তথ্যের গরমিল পাওয়া যায়। যার মধ্যে রয়েছে-
বাপাউবোর কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা তাদের পছন্দনীয় কেএসবি পাম্প সরবরাহ নেওয়ার জন্য আগে থেকে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে ডিপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করতে অর্থনৈতিক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে (সিসিইএ) প্রভাবিত করেছে। কারণ, সিসিইএ অনুমোদনের প্রথম দফায় উন্মুক্ত পদ্ধতির কথা বলা হয়।
দ্বিতীয়ত, কেএসবি জার্মানির পাম্প হওয়ায় তাদের একমাত্র এজেন্ট সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি পাম্প ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের মূল্য বেশি নিয়েছে কি না- সেটি যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয়নি।
দুদকের দাবি অনুযায়ী অতিরিক্ত যন্ত্রাংশসহ অন্যান্য যে কাজের কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্যের কিছু গরমিল পরিলক্ষিত হয়েছে।
আরও পড়ুন >> এমপি সোহেলের জমি দখল ও দুর্নীতি, অনুসন্ধানে দুদক
মামলার এজাহার অনুযায়ী, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের এলসির বিপরীতে এনসিসি ব্যাংকের মাধ্যমে আটটি পাম্পের পরিশোধিত ক্রয়মূল্য ১৭ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ও ঠিকাদারের ১৫ শতাংশ লাভসহ মোট ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৪১ লাখ ৬০৩ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর হিসাবে আসে আরও ছয় কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। কিন্তু পাম্প ক্রয়বাবদ ৬১ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার টাকার বিল ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
তার ওপর পরিশোধিত মূল বিল ৭৮ কোটি টাকা হিসাবে আরও ১৭ কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল কেন- এ প্রশ্নেরও জবাব মেলেনি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে দুদকের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার এজাহার অনুযায়ী আটটি পাম্পের মূল্য ২০ কোটি টাকা। কিন্তু শুধু যন্ত্রাংশ ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় প্রায় ৫১ কোটি (৩৪+১৭) টাকা। ব্যয়ের এমন হিসাব কিছুতেই মিলছে না। অনেকটা ‘খাজনার চেয়ে বাজনাই যেন বেশি’- এমন অবস্থা মনে হয়েছে আমার কাছে।
অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা আসলে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত; বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তি... যাদের রুই-কাতলা বলা হয়, তাদের ক্ষেত্রে দুদককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তারা মূলত যারা চুনোপুঁটি তাদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া করছে। দুদক এখন রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়। যারা প্রভাবশালী দুদক তাদের ধরতে সাহস দেখায় না।
আরএম/এমএআর/