হানি ট্র্যাপ : ভারতে বসে বাংলাদেশে প্রেমের ফাঁদ
প্রথমে ফেসবুকে বন্ধুত্ব ও কথোপকথন, তারপর ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা; এরপর ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতার ভিডিও চিত্র সম্পাদনা করে নানাভাবে প্রতারণা এবং দীর্ঘমেয়াদে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া— ধারাবাহিক এ কর্মযজ্ঞ চালান একজন সুন্দরী নারী আর এর শিকার হন ধনাঢ্য ও খ্যাতনামা ব্যক্তিরা। ঘটনার প্রকৃতি বলে, এটা অনেকটা অতীতের ‘হানি ট্র্যাপ’-এর মতো। অতীতে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ‘হানি ট্র্যাপ’ (Honey Trap) বা সুন্দরী নারীদের দিয়ে ফাঁদ তৈরি করা হতো।
বিশ্বে এমন অপরাধের ঘটনা দিনদিন বেড়ে চলেছে। পাশের দেশ ভারতে এমন প্রতারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রা পেয়েছে এ অপরাধ। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে ভারতীয় সুন্দরী তরুণীরা বাংলাদেশিদের এ ‘মধু ফাঁদে’ ফেলছেন। দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, স্বনামধন্য সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তারা এ ফাঁদে পা দিয়ে খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক কোটি ছুঁয়েছে।
যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্কের প্রলোভন দেখিয়ে ‘হানি ট্র্যাপে’র মতো প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে ঢাকা পোস্টের। কীভাবে তারা এ ফাঁদে পা রাখেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। হানি ট্র্যাপ থেকে বাঁচার উপায় এবং প্রতিকার নিয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। দুই পর্বের বিশেষ আয়োজনের আজ থাকছে প্রথমটি।
বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ সম্প্রতি ভয়ংকর একটি তথ্য দিয়েছে। সেটি হলো- গত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৭০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩০টির মতো। প্রতিটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে। চাতুর্যপূর্ণ এ ফাঁদে পা দিয়ে ২০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত খুইয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
আরও পড়ুন >> ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে : ব্যবসায়ীর বাড়ি-গাড়ি সবই এখন স্বর্ণার
সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিত্তশালী, ব্যবসায়ী, ভিআইপি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে হানি ট্র্যাপে ফেলেন প্রতারকরা। মূলত তথ্য ও অর্থ হাতিয়ে নিতে এ পন্থা অবলম্বন করেন তারা। তবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্য নয়, মোটা অঙ্কের অর্থ পেতে সরকারি কর্মকর্তা, সেলিব্রিটি সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ফাঁদে ফেলেন ভারতীয় তরুণীরা
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয় এক সুন্দরী তরুণীর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা খুইয়েছেন দেশের স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ী, যিনি ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিও করেন। যৌন প্রলোভনের এমন ফাঁদে পা দিয়ে আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজীবী। এমনকি দেশের স্বনামধন্য সাংবাদিকের নামও রয়েছে এ তালিকায়। লোকলজ্জা এবং সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। মামলা করারও সাহস দেখাচ্ছেন না।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতারণার ফাঁদটি পেতেছে মূলত ভারতীয় সাইবার অপরাধীদের একটি চক্র। এ চক্রে সে দেশের নারী-পুরুষ ও বাংলাদেশের এজেন্টসহ প্রায় ৫০০ সদস্য রয়েছেন। শুধু ভারতেই রয়েছে ১৫০ জনের মতো সদস্য। বাকিরা বাংলাদেশি, তারা ভারতীয়দের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
ভারতীয় সুন্দরী তরুণীদের টার্গেট যারা
সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিত্তশালী, ব্যবসায়ী, ভিআইপি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে হানি ট্র্যাপে ফেলেন প্রতারকরা। মূলত তথ্য ও অর্থ হাতিয়ে নিতে এ পন্থা অবলম্বন করেন তারা। তবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্য নয়, মোটা অঙ্কের অর্থ পেতে সরকারি কর্মকর্তা, সেলিব্রিটি সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ফাঁদে ফেলেন ভারতীয় তরুণীরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এ ফাঁদে সবচেয়ে বেশি পা দিয়েছেন সরকারি কর্তারা। তারা প্রত্যেকেই বিবাহিত। মোটা অঙ্কের অর্থ খোয়ালেও তারা মামলা করতে চান না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম বিভাগে লিখিত অভিযোগ করে জানান। অনেকে আবার ব্যক্তিগতভাবে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে ব্ল্যাকমেইলের তথ্য জানান।
আরও পড়ুন >> সার্ভেয়ারের চাকরি নাকি সম্পদ গড়ার পরশ পাথর!
গত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৭০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে ৩০টির মতো। প্রতিটি ঘটনাই ঘটানো হয়েছে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য থেকে। চাতুর্যপূর্ণ এ ফাঁদে পা দিয়ে ২০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত খুইয়েছেন ভুক্তভোগীরা
এ বিষয়ে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম বিভাগের এক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বিষয়টি সুরাহা করতে বলেন। অনেক উঁচু মহল থেকে ফোন করান। রেস্টুরেন্ট বা হোটেল লবির মতো নিরাপদ স্থানে আমাদের বিষয়গুলো জানান। তবে, তারা যেহেতু মামলা করতে চান না সে কারণে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে ঘটনাগুলোর তদন্ত করতে হয়।
কাউন্টার টেররিজমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত তিন মাসে সিটিটিসির কাছে কমপক্ষে ২০টির মতো হানি ট্র্যাপের ঘটনা এসেছে। এগুলোর মধ্যে দেশের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষও রয়েছেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে চক্রগুলো বাংলাদেশি নাগরিকদের সহায়তায় এ সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। তাদের সংখ্যা প্রায় ৫০০।’
বাংলাদেশিদের যেভাবে হানি ট্র্যাপে ফেলছেন ভারতের তরুণীরা
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত আসাম, মেঘালয় ও শিলিগুড়ি এলাকা থেকে বাংলাদেশিদের ফাঁদে ফেলছেন ভারতের মেয়েরা। তারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ওয়েবসাইট থেকে ভিআইপি ও উচ্চবিত্তদের নম্বর সংগ্রহ করেন। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ফেসবুক থেকে তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। যেসব মেয়ে বাংলাদেশি পুরুষদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে প্রতারণা করেছেন তারা প্রত্যেকেই নিজ দেশের (ভারত) প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আর্মড ফোর্সে কর্মরত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির একমাত্র মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমে তারা ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে টেক্সট চ্যাটিং করেন। পাশাপাশি ভারতের +৯১ কোড সম্বলিত ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিয়েও কথা চালিয়ে যান।
আরও পড়ুন >> কিং মুশতাক ও রানি সিনথিয়া উপাখ্যানে ‘বিব্রত’ আইডিয়াল
মূলত আসাম, মেঘালয় ও শিলিগুড়ি এলাকা থেকে বাংলাদেশিদের ফাঁদে ফেলছেন ভারতের মেয়েরা। তারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ওয়েবসাইট থেকে ভিআইপি ও উচ্চবিত্তদের নম্বর সংগ্রহ করেন। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ফেসবুক থেকে তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান
ভুক্তভোগী এমন এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে ভারতীয় তরুণীর কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, ওই তরুণী ভুক্তভোগী পুরুষের সঙ্গে হিন্দি ও বাংলা ভাষা মিশিয়ে কথা বলছেন। নিজেকে তরুণী প্রমাণ করতে কোনো শর্ত ছাড়াই ভিডিও কলে কথা বলার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ভিডিও চ্যাটের একপর্যায়ে তরুণী নিজেই নগ্ন হন। পরে ওই বাংলাদেশিকেও নগ্ন হওয়ার আহ্বান জানান। ভারতীয় তরুণীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনিও নগ্ন হন। চ্যাট বক্সে চলে যৌনতার সুড়সুড়ি!
ভিডিও চ্যাটের আট দিন পর অজ্ঞাত এক বাংলাদেশি ওই ব্যবসায়ীর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে নগ্ন হওয়া ছবির স্ক্রিনশট পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন এবং মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন।
এমন ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন বাংলাদেশের বিশিষ্ট এক ব্যবসায়ী (ভিআইপি) ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (নাম প্রকাশ করা হলো না)। বাধ্য হয়ে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের একটি ইউনিটের কাছে বিষয়টি জানান। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, তিনি ‘সিনথিয়া সাহা’ নামে (ফেসবুক অ্যাকাউন্টধারী) ভারতীয় এক তরুণীর সঙ্গে ফেসবুকে সম্পর্ক করেছিলেন। ওই আইডির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে ফেসবুককে চিঠি দেয় বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ইউনিট।
সম্প্রতি ফেসবুক বাংলাদেশ পুলিশকে জানায়, ওই তরুণীর আইডিটি ভারতের শিলিগুড়ি থেকে পরিচালিত। পাশাপাশি যে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের অধীনে সংযোগ নিয়ে ওই তরুণী আইডিটি চালাচ্ছিলেন তার নামও দেয় তারা। তবে, ওই আইডি বা ব্ল্যাকমেইলারের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বাংলাদেশ পুলিশ।
আরও পড়ুন >> প্রতারণার জাল ফেলে আত্মগোপনে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা
জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ এমন প্রায় ডজনখানেক আইডি শনাক্ত করে ফেসবুককে দিয়েছে। আইডিগুলো ভারতের শিলিগুড়ি, আসাম ও মেঘালয় রাজ্য থেকে লগইন করা— জানিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। তবে, সেগুলো নিষ্ক্রিয় করেনি তারা।
প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বেশকিছু হোয়াটসঅ্যাপ ও বিকাশ নম্বর পুলিশের হাতে এসেছে। সেগুলো হলো- ০১৭৪১৬৬২..., ০১৬০২৬২০..., ০১৯০২০৭৯... হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর। বিকাশের মাধ্যমে টাকা আদায় করা নম্বরগুলো হলো- ০১৯৩৩১০২..., ০১৯১৭১১৭..., ০১৩২৬৯১২..., ০১৯৭৭১০১..., ০১৯৭৭১০১..., ০১৩০৫৩০৬..., ০১৯৭৭১০১..., ০১৯২৯৬৬৬..., ০১৮৫৬৩৩৩...।
ব্ল্যাকমেইলের টাকা ভারতে যায় যেভাবে
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে ভারতীয় প্রতারক চক্রের হয়ে কাজ করেন তিনশর অধিক মানুষ। তারা দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের বাসিন্দা। মূলত তারা স্বর্ণের চোরাচালান ও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারাই বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ভারতে পাঠান।
ঢাকা পোস্টের কাছে আসা কয়েকজন ভুক্তভোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, ভারতীয় আইডিগুলো থেকে বাংলাদেশিদের ব্ল্যাকমেইল করার পর টাকা চাওয়া হয় দুটি উপায়ে। প্রথমটি, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট নম্বরে এবং অপরটি, বাংলাদেশি কিছু বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এসব অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে বলা হয়।
আরও পড়ুন >> টাকা-উপহারে ‘বিক্রি হচ্ছেন’ চিকিৎসক, বাড়ছে ব্যয়!
ভুক্তভোগী এমন এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে ভারতীয় তরুণীর কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, ওই তরুণী ভুক্তভোগী পুরুষের সঙ্গে হিন্দি ও বাংলা ভাষা মিশিয়ে কথা বলছেন। নিজেকে তরুণী প্রমাণ করতে কোনো শর্ত ছাড়াই ভিডিও কলে কথা বলার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ভিডিও চ্যাটের একপর্যায়ে তরুণী নিজেই নগ্ন হন। পরে ওই বাংলাদেশিকেও নগ্ন হওয়ার আহ্বান জানান। ভারতীয় তরুণীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনিও নগ্ন হন। চ্যাট বক্সে চলে যৌনতার সুড়সুড়ি
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অ্যাকাউন্টগুলো শনাক্ত করেছেন। দেখা গেছে, সেগুলো দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত। নগদ ও বিকাশ অ্যাকাউন্টগুলো দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত ও স্থলবন্দরের আশপাশে এলাকায় অবস্থিত।
রাজধানীর নিউমার্কেট থানার একটি মামলার সূত্র ধরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট সম্প্রতি দিনাজপুরের হিলিতে একটি অভিযান চালায়। অভিযানে গিয়ে প্রথমে স্থানীয় এক বিকাশের দোকানদারকে শনাক্ত করে আটক করা হয়। এরপর যারা বিকাশের টাকা ক্যাশ-আউট করেন তাদের শনাক্ত করে মোট চারজনকে আটক করা হয়।
তারা হলেন- সফল খান, মো. মিজানুর রহমান, মো. জসিম উদ্দিন ও মো. মমতাজুল ইসলাম।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা সিটিটিসিকে জানায়, ভারতীয় প্রতারক চক্রের হয়ে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টের টাকা ক্যাশ-আউট করেন তারা। সেগুলো স্থানীয় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে দেন। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ওই টাকা ওপারে পাঠান। টাকা-ক্যাশ আউটের জন্য তারা মোট পাঠানো অর্থের ১০ শতাংশ কমিশন পান।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, হিলি সীমান্তে প্রায় ৫০ বাংলাদেশি ও ভারতীয় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের একটি চক্র রয়েছে। তারা একে-অপরের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সংযুক্ত। তারা স্থলবন্দর দিয়ে নানা পণ্য আমদানি-রপ্তানি করান। স্বর্ণ চোরাচালানের মতো অবৈধ ব্যবসাও করেন কেউ কেউ। মূলত তারাই ভারতীয় প্রতারকদের হয়ে টাকা লেনদেন করেন। তারা পাঁচ শতাংশ কমিশন পান।
আরও পড়ুন >> বিদেশি নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে বাড়ছে অপরাধ
হিলি সীমান্তে প্রায় ৫০ বাংলাদেশি ও ভারতীয় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের একটি চক্র রয়েছে। তারা একে-অপরের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সংযুক্ত। তারা স্থলবন্দর দিয়ে নানা পণ্য আমদানি-রপ্তানি করান। স্বর্ণ চোরাচালানের মতো অবৈধ ব্যবসাও করেন কেউ কেউ। মূলত তারাই ভারতীয় প্রতারকদের হয়ে টাকা লেনদেন করেন। তারা পাঁচ শতাংশ কমিশন পান
ঢাকা পোস্ট ওই সীমান্তের এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে। তার দাবি, তিনি ব্ল্যাকমেইলের টাকা হুন্ডি করেন না। তবে, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। বলেন, ‘এমন কথা শুনেছি, তবে কখনও দেখিনি। কারণ, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা এপারে (বাংলাদেশ) একজনের পক্ষে টাকা সংগ্রহ করে ওপারে (ভারত) পাঠান। এটা যে কোনো ব্যবসার পেমেন্টের ক্ষেত্রে হতে পারে। কে, কোন উদ্দেশ্যে টাকা নেয়— এটা জানার চেষ্টাও করেন না কেউ। শুধু কমিশন পেলেই হয়। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা পৌঁছানোই মুখ্য, টাকা পাঠানোর কারণটা মুখ্য না।’
হানি ট্র্যাপে নিঃস্ব হওয়ার গল্প
হানি ট্র্যাপের শিকার হয়ে ২৩ লাখ টাকা খুইয়েছেন সাব্বির আহমেদ (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যবসায়ী। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার সঙ্গে অনলাইনে ভারতীয় এক তরুণীর পরিচয় হয়। ওই তরুণী নিজেকে মিজোরামের একজন শিল্পপতির মেয়ে বলে পরিচয় দেন। সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাব্বির বলেন, “ওই তরুণীর ফেসবুক আইডি ছিল প্রিয়সি কর্মকার নামে। আইডির ভেতরে গিয়ে ছবিগুলো ভুয়া (ফেক) মনে হচ্ছিল, পুরোনো কোনো ছবি বা পোস্ট দেখা যাচ্ছিল না। তারপরও তার সঙ্গে চ্যাট হচ্ছিল আমার। একপর্যায়ে তাকে আমি সরাসরি বলি যে, সে মেয়ে না, এটা ভুয়া আইডি। নিজেকে ‘তরুণী’ প্রমাণ দিতে এক দিন মেয়েটি আমাকে ভিডিও কল দেয়। এরপর নিয়মিত টেক্সট চ্যাটে কথা শুরু হয় আমাদের। একপর্যায়ে নিয়মিত ভিডিও কলে কথা হয়।”
‘ভিডিও কলে এক দিন আমাদের কথোপকথন সংবেদনশীল পর্যায়ে যায়, তরুণী নিজেই আগে নগ্ন হয়। পরিস্থিতির কারণে আমিও বিবস্ত্র হই। এরপর তিন/চার দিন এভাবে কথা হয় আমাদের। শুরু থেকে প্রায় ১৭ দিনের মতো কথোপকথনের পর +৯১ হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে আমার কাছে একটা মিসড কল এবং মেসেজ আসে। মেসেজে শুধু আমার নগ্ন হওয়া একটি স্ক্রিনশট আসে। আর হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। আমি প্রথমে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেইল না করার অনুরোধ করি। কিছুদিন পর আমাকে ১৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাঠানো হয়।’
আরও পড়ুন >> ‘জেনে, না বুঝে’ সাইবার অপরাধে কিশোর-তরুণরা
‘সেই ভিডিওতে শুধুমাত্র আমি ছিলাম, অথচ পাশের স্ক্রিনে প্রিয়সিরও থাকার কথা। কিন্তু সে ছিল না। একপর্যায়ে আমি ভীত হয়ে লোকলজ্জার ভয়ে পাঁচটি বিকাশ নম্বরে পর্যায়ক্রমে আরও চার লাখ টাকা পাঠাই। তাদের দেওয়া কয়েকটি ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড নম্বরে মোট ১৩ লাখ টাকা দিই। এরপর তারা আর আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেনি। পরে ওই আইডি মুছে ফেলা হয়। বিষয়টি আমার পরিবার জানে না, এ কারণে আমি আর পুলিশের কাছে যাইনি’— যোগ করেন হানি ট্র্যাপে পড়া ভুক্তভোগী।
মামলায় অনীহা, সাহস করে ‘ডিজিটাল প্রতারণার’ মামলা দিয়েছেন একজন
সিআইডি, ডিবি ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ ভুক্তভোগীর তথ্য এসেছে তাদের কাছে। তবে, হানি ট্র্যাপের বিষয়ে মামলার সংখ্যা শূন্য। একজন ভিক্টিম (স্বর্ণ ব্যবসায়ী) ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খুইয়ে ঢাকায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে একটি মামলা করেছেন। মামলায় হানি ট্র্যাপে পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেননি তিনি।
ডিএমপির একটি থানায় দায়ের করা মামলার কপিতে উল্লেখ করা হয়, এক তরুণী ভারতীয় নম্বর থেকে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দেন এবং স্বর্ণ কেনার বিষয়ে আলোচনা করেন। তাদের নিয়মিত কথা হতো এবং একপর্যায়ে ওই তরুণী ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে বলেন। বিনিময়ে প্রতি মাসে তিনি এক লাখ ৭০ হাজার টাকা মুনাফা এবং সেলিব্রিটিদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন বলে জানান। প্রলোভনে পড়ে ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ী হুন্ডির মাধ্যমে ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠান। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
আরও পড়ুন >> স্বপ্নের দুবাইয়ে দুঃস্বপ্নের রাত পার করছেন বাংলাদেশি তরুণীরা
বাংলাদেশি ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন ভারতীয় তিন তরুণী। ফেসবুকে তারা শিলা, পিয়ালী সাহা ও তানিয়া নামের অ্যাকাউন্ট থেকে যোগাযোগ করেন। তিনজনের সঙ্গেই ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়ান ওই ব্যবসায়ী। একপর্যায়ে তারা ব্যবসায়ীকে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করার প্রলোভন দেখান। লাভের সঙ্গে সেলিব্রিটি নারীদের সঙ্গে রাত কাটানোর লোভ দেখান। তবে, ওই ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করতে রাজি না হওয়ায় তার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ফাঁস করার ভয় দেখান তিনজন। সম্মান হারানোর ভয়ে ওই ব্যবসায়ী পরে তাদের দেওয়া বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টে ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠান
মামলায় ওই ব্যবসায়ী অনলাইনে আক্রমণাত্মক আচরণ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন, পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশে প্রতারণা, ডিজিটাল জালিয়াতি ও ডিজিটাল প্রতারণার ধারা যুক্ত করেন। তবে, মামলার তদন্ত সূত্রে উঠে আসে অন্য ঘটনা। জানা যায়, ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য সঙ্গী খুঁজছিলেন এবং নিজের ফোন নম্বর পোস্ট করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনটি ফেসবুক আইডি থেকে তাকে নক করা হয়। বাংলাদেশি ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন ভারতীয় তিন তরুণী। ফেসবুকে তারা শিলা, পিয়ালী সাহা ও তানিয়া নামের অ্যাকাউন্ট থেকে যোগাযোগ করেন। তিনজনের সঙ্গেই ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়ান ওই ব্যবসায়ী। একপর্যায়ে তারা ব্যবসায়ীকে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করার প্রলোভন দেখান। লাভের সঙ্গে সেলিব্রিটি নারীদের সঙ্গে রাত কাটানোর লোভ দেখান। তবে, ওই ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করতে রাজি না হওয়ায় তার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ফাঁস করার ভয় দেখান তিনজন। সম্মান হারানোর ভয়ে ওই ব্যবসায়ী পরে তাদের দেওয়া বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টে ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠান।
[চলবে...]
দ্বিতীয় পর্বে থাকছে >> হানি ট্র্যাপ : মুখ খুলতে কেন এত ভয়?
এআর/এমএআর/