ঢামেকে চালু হয়নি ডেঙ্গু কর্নার, ভোগান্তিতে রোগীরা
ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির দিকে থাকায় গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয় সব হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু কর্নার স্থাপন করা হবে। গত কয়েকদিন ধরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলে বেড়াচ্ছেন সব জায়গায় ডেঙ্গু কর্নার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এখনো ডেঙ্গু কর্নার স্থাপন করা হয়নি। চালু করার কোনো উদ্যোগও নেই। সেখানে মেডিসিন ওয়ার্ডের অন্য রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে নানারকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ডেঙ্গুরোগীসহ সব ধরনের রোগীরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বছরের সবসময় রোগীদের ভিড় লেগে থাকে। বিশেষ করে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এখানে রোগীদের রেফার করার ফলে এ চাপ অব্যাহতভাবে চলছেই। ডেঙ্গুর মৌসুমেও অন্যসব রোগীদের সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হয় এই হাসপাতালটিকে।
এবার এখানে ডেঙ্গু রোগীর চাপ অনেক বেশি। প্রতিদিনই ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তরা এখানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। এত রোগীর জন্য স্বাভাবিকভাবেই আলাদা ব্যবস্থাপনা দরকার। কিন্তু সেরকম কিছু এখানে দেখা যায়নি। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নির্দেশনা দিলেও এ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করছে না। তারা মেডিসিন ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। এতে ডেঙ্গু আক্রান্তরা অনেক বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় ডেঙ্গু রোগীদেরও টিকিট কাটা থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব কাজে সিরিয়াল ধরতে হচ্ছে এবং চিকিৎসা পেতে অনেক বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। এতে অনেক রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাচ্ছে এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়ে যাচ্ছে। অনেকে জ্বর নিয়ে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না।
আরও পড়ুন : টিকিট-ডাক্তারে দুই ঘণ্টা, ওষুধ নিতে কয় ঘণ্টা?
ঢাকা মেডিকেলের মতো জায়গায় এসে সঠিক, উপযুক্ত ও দ্রুত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন রোগীরা। অনেকে বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সরকার বলার পরও এরা ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার কেন করছে না? পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোও তো এখন আলাদাভাবে করা দরকার। এখন তো বিশেষ পরিস্থিতি। এখনও যদি অন্য সময়ের মতো আচরণ করে তাহলে কীভাবে হবে?
মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালের ৫০০ শয্যার মেডিসিন বিভাগে শুধু ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি আছেন ২২৭ জন। তবে ভর্তির বাইরেও এই বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে-বাইরে অনেক রোগী অবস্থান করছেন। তাদের সবাই 'নন-এডমিট' রোগী হিসেবে সেখানে অবস্থান করছেন। ফ্লোর, বারান্দা, সিঁড়ি, করিডোরসহ নানা জায়গায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বেড পেতে স্থান নিয়ে আছেন রোগী ও স্বজনরা।
দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ১০ তলা হাসপাতালটির প্রতিটি ফ্লোর রোগী ও স্বজনে ঠাসা। বেড তো খালি নেই-ই, হাসপাতালের বারান্দা, করিডোর ও সিঁড়ির নিচেও রোগীরা অবস্থান নিয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ডেঙ্গু রোগী।
তবে কে ডেঙ্গু রোগী আর কে অন্য রোগে আক্রান্ত তা ফাইল ছাড়া শনাক্ত করার ব্যবস্থা নেই সেখানে। ডেঙ্গুর জন্য আলাদা কর্নার না করায় সব যেন এলোমেলো অবস্থা হয়ে আছে। চিকিৎসক ও নার্সরাও কাকে কীভাবে চিকিৎসা দেবেন তা নিয়ে দিশেহারা অবস্থায় পড়েছেন।
ভোগান্তির নাম রক্ত পরীক্ষা
প্যাথলজি (রক্তের পরীক্ষাগার) বিভাগের সামনে গিয়ে দেখা যায়, রোগী ও স্বজনদের দীর্ঘ লাইন। সেখানে সিরিয়াল আগে পিছে করা নিয়ে সারাক্ষণ হট্টগোল লেগে আছে। সকাল আটটায় সিরিয়ালে দাঁড়িয়েও অনেকে টেস্টের স্যাম্পল দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। অনেকে আবার স্যাম্পল দিয়ে এখনো রিপোর্ট পাননি বলে জানান।
ক্লিনিকাল প্যাথলজি বিভাগের সামনে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক রোগীর স্বজন আওয়াল বলেন, এখানে সব সেবাই আপনি পাবেন, তবে তা অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে। টাকা খরচা করুন, বাইরের লোক আপনার স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে যাবে, রিপোর্টও দিয়ে যাবে।
আমানুর রহমান নামে আরেক স্বজন বলেন, এখানকার প্যাথলজি মানে ভোগান্তি আর অপেক্ষা। টাকা জমা দেওয়া, রিসিট নেওয়া, স্যাম্পল দেওয়া, রিপোর্ট নেওয়া- সব কাজেই সবাইকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। একেকটা কাজে এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টাও লেগে যায়। রোগীর অবস্থা যত খারাপই হোক ডেঙ্গু টেস্ট করতে, রক্ত পরীক্ষা করতে এসব ঝামেলা পোহাতেই হবে।
আরও পড়ুন : মুগদা মেডিকেলে নিত্যদিনের ‘যুদ্ধ’ লিফটে ওঠা
প্যাথলজি বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে ডেঙ্গুর জন্য প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০০ স্যাম্পল টেস্ট করা হয়। একজনের একবার টেস্ট করা হলে ৪/৫ দিন আগে আর সিরিয়ালই পাওয়ার সুযোগ নেই। অনেক চাপ, লাইন দেখলেই বুঝতে পারবেন।
দুশ্চিন্তায় রোগীরা, খারাপ আচরণ করেন নার্সরা
দুইদিন জ্বরে ভোগার পর শরীর আরও খারাপ হওয়ায় গত শুক্রবার ভোরে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ঢাকার দক্ষিণখানের রিকশাচালক ফারুক আহমেদকে (২৮)। কিন্তু তার ভাগ্যে হাসপাতালের বেড মেলেনি, বারান্দায় বিছানা করা হয়েছে। ভর্তি হওয়ার পর থেকে প্লাটিলেট কমছে ফারুকের।
ফারুকের স্ত্রী জাকিয়া বলেন, ভর্তির সময় বেশ খারাপ অবস্থা ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা, অনুনয়-বিনয় করেও বেড পাইনি। শুক্রবার থেকে এই বারান্দাতেই পড়ে আছি। প্লাটিলেট ৪৮ হাজার থেকে কমতে কমতে ১০ হাজারে এসেছে। এটাও বাইরে পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারছি, এখানেও কোনো পরীক্ষা করাতে পারছি না।
ফারুককে হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। সেটি এখনো চলছে, এখন প্লাটিলেট ১৪ হাজার। চিকিৎসকরা অভয় দিচ্ছেন। তাতে দুশ্চিন্তা কমছে না স্ত্রী জাকিয়ার- ‘প্লাটিলেট বাড়ব কখন, এরা তো কিছুই করতেছে না, খালি স্যালাইন দিয়া রাখছে।’
কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে মো. খাজা হোসেন (৪২) নামে এক ব্যবসায়ী গত বৃহস্পতিবার এসে ভর্তি হয়েছেন। বেড পেয়েছেন গতকাল সোমবার। ৪ দিন ফ্লোরেই থাকতে হয় তাকে।
খাজা হোসেনের স্ত্রী রাশেদা খানম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্লাটিলেট কমে এখন ৪০ হাজার। তবে ডাক্তাররা বলছেন সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে। বেড পাইলাম মাত্র গতকাল, আজ বলছে ছেড়ে দেবে।
এই বিভাগে চিকিৎসকরা মোটামুটি নিয়মিত রাউন্ডে আসছেন। তবে নার্সরা অসহযোগিতা করছেন এবং অপেশাদার আচরণ করছেন বলে অভিযোগ করেন ডেঙ্গু রোগীরা।
এক রোগীর স্বজন বলেন, চিকিৎসা ভালো। হাজার হাজার রোগী, কী করব ডাক্তাররা। তবে নার্সরা খারাপ আচরণ করে। ডেঙ্গু রোগীর বমি হবে এটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু নার্সরা কোনো সহযোগিতা তো করছেই না উল্টো বমির জন্য রোগীকে বকাবকি করছে।
ডেঙ্গু রোগী মশারির বাইরে!
এখানে আরেকটা সমস্যা দেখা গেল। ডেঙ্গু মশাবাহিত রোগ, অথচ এখানে অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী মশারির বাইরে। বেড ছাড়া কোথাও মশারি লাগানোর মতো ব্যবস্থাও নেই। এদিকে কয়েল জ্বালানোও নিষেধ। ফলে মশা আছে অনেক এবং এটি অন্য রোগীদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে।
পেটের পীড়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী রেহেনা পারভিন বলেন, এখানে সাধারণ রোগীর চেয়ে ডেঙ্গু রোগী বেশি। তাদের জন্য তো একটা ফ্লোর বা বিশেষ ইউনিট চালু করা যেত। তাহলে তারাও বিশেষ চিকিৎসা পেতেন আর আমরাও হাসপাতালে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকতাম না। সারাক্ষণ একটা আতঙ্ক- কখন মশা কামড়ায় আর ডেঙ্গু হয়ে যায়।
সব রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না
মেডিসিন বিভাগে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট যা তারচেয়ে অন্তত পাঁচগুণ বেশি রোগী আমাদের হ্যান্ডেল করতে হয়। এখানে ভর্তির চেয়ে অ-ভর্তি রোগী বেশি। তাদের সবাইকেই আমাদের চিকিৎসা দিতে হয়। সকাল থেকে আমি নিজে ৬০/৭০ জন রোগীকে হ্যান্ডেল করেছি। সব মিলিয়ে বেসামাল অবস্থা। অনেক রোগীকে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
'অবস্থা বুঝে যেসব রোগী ভর্তি নেওয়া প্রয়োজন শুধু সেসব রোগীই ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে যাদের অবস্থা তুলনামূলক ভাল তাদের রিলিজ দিয়ে নতুন রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে'- বলেন এ চিকিৎসক।
ডেঙ্গু : আগস্ট-সেপ্টেম্বর নিয়েও ভয়
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ডেঙ্গুর জন্য বিশেষ কোনো ইউনিট বা কর্নার করিনি, কোনো পরিকল্পনাও নেই। মেডিসিন রোগীদের সঙ্গেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা চলবে।’
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন আলাদা কর্নার করছেন না, সরকার তো নির্দেশনা দিয়েছে; তাছাড়া মশার মাধ্যমে হাসপাতালেও তো ডেঙ্গু ছড়াতে পারে?
এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দেননি পরিচালক।
তিনি বলেন, বাসায় মশারি লাগানো দরকার, হাসপাতালে জরুরি নয়। আক্রান্ত হওয়ার পর মশারি দিয়ে কী হবে? তবে বেডে থাকা ডেঙ্গু রোগীদের মশারি লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য তো ডেডিকেটেড হাসপাতাল করেছে ডিএনসিসি, সেখানে যাক তারা?
জেইউ/জেএস