বড় মিলগুলোতে হয় না অভিযান, ফলে বাস্তবায়ন হচ্ছে না আইন
‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ অনুযায়ী ১৯টি পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। তবে, এ আইন মানছেন না অধিকাংশ মিলমালিক। এ বিষয়ে মাঝেমধ্যে কিছু ছোট মিলে অভিযান পরিচালনা করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে বড় মিলগুলো। এজন্য দীর্ঘ সময়েও এ আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, আইন অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুড়া, পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের মোড়কের ক্ষেত্রে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড কিংবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ অপরাধ পুনরায় সংঘটিত হলে সর্বোচ্চ দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত করারও বিধান রয়েছে।
বড় মিলগুলোতে হয় না অভিযান
আইন কার্যকর না হওয়ার ক্ষেত্রে বড় মিলগুলোতে অভিযান পরিচালনার ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের দু’জন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বলার পরও অনেক মিলমালিক আইন মানেন না। তাদের আইন মানাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা হয় না। মাঝেমধ্যে কিছু ছোট মিলে অভিযান চালানো হলেও অদৃশ্য কারণে বড় মিলগুলো থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আইন অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুড়া, পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের মোড়কের ক্ষেত্রে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড কিংবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ অপরাধ পুনরায় সংঘটিত হলে সর্বোচ্চ দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত করারও বিধান রয়েছে
তারা জানান, এসব বিষয়ে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে বলা হয়েছে। তারা যদি সুনজর দেন তাহলে এ আইন কার্যকর করা সম্ভব।
একই কথা বলেন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে একজন নেতা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দিনদিন প্লাস্টিকের বস্তা ও পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে। এটা মন্ত্রণালয় ও পাট অধিদপ্তর জানে। তবুও এ বিষয়ে জোরাল উদ্যোগ নেই। সেজন্য আইন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, ছোট ছোট কিছু মিলে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করা হয়। বড় মিলগুলোতে অভিযান চালানোই হয় না। কারণ, বড় মিলগুলো প্রভাবশালীদের। সেখানে অভিযান চালানোর জন্য তারা হয়তো সাহস পান না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিকের বস্তা বা পলিথিন
‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ কার্যকর করতে গত ১০ মে ও ১৩ জুন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাটের বস্তার ব্যবহারে শিথিলতার বিষয়টি উঠে আসে। সভায় সভাপতিত্ব করেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ।
সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সভার শুরুতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, ডাল, আটা, ময়দাসহ ১৯ ধরনের পণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও মোড়ক করার ক্ষেত্রে পাটের বস্তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে পাটের বস্তার ব্যবহারে শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বস্তা বা পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্লাস্টিকের বস্তা বা পলিথিন ব্যবহার করা হলে ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত এবং সব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান বাড়ানো এবং প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী জেল, জরিমানা ও উভয় দণ্ড কার্যকর করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও পাট অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন
ডিসিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের নির্দেশ
মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সংশ্লিষ্টদের বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও সমন্বয় করতে পাট অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান বাড়ানো এবং প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী জেল, জরিমানা ও উভয় দণ্ড কার্যকর করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও পাট অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া ছোট-বড় সব ধরনের অটো রাইস মিল ও চালের আড়তে নিরপেক্ষভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সভা থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট জেলার রাইস মিলমালিক ও বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে পাট অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভার আয়োজন, নওগাঁসহ যেসব জেলায় রাইস মিল বেশি বা যেসব জেলা থেকে সারাদেশে চাল সরবরাহ করা হয়, সেসব জেলার চালকলগুলোতে পাটের বস্তার ব্যবহার নিয়মিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার জন্যও সভা থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
পলিব্যাগের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চলছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। যেহেতু পলিব্যাগের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে, এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। কোনো কোনো জায়গায় আমরা ভালো অগ্রগতিও লক্ষ করছি।
অভিযোগ রয়েছে বড় মিলগুলোতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় না। ছোট-ছোট মিলগুলোতে পরিচালনা করা হয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সচিব বলেন, ‘আমি ১৩ জুন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। যেসব জায়গায় বড়-বড় মিল রয়েছে, স্পেসিফিক তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। জিজ্ঞেস করেছি যে বিগত দিনগুলোতে কোথায় কোথায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। সেখানে বড় মিলও ছিল। তবে, হতে পারে অনেক স্থানে কাজ করা হয়নি, যেহেতু আমাদের জনবলের সীমাবদ্ধতা আছে। এটা হতে পারে।’
‘তারপরও এ ধরনের সমস্যা থাকলে আমরা জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন করি অথবা গিয়ে বলে আসি বা চিঠি লিখি। আমরা কোনো গ্যাপ থাকলে বলি। আমাদের অফিসাররাও যদি কোনো সমস্যা পান, সেগুলো আমাদের বলেন।’
সচিব আরও বলেন, কোনো এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হলে তা জানানোর জন্য আমরা ইতোমধ্যে বলেও দিয়েছি। সেখানে যাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিষয়গুলো আমরা মনিটরিং করি এবং দেখি। সমস্যা আছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে, আমরা চেষ্টা করছি। আমরা আন্তরিক।
নেওয়া হবে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) বলেন, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ অনুযায়ী ১৯টি পণ্যে পাটের বস্তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। ফলে স্থানীয় বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, পাটচাষিদের পাটের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি পাটের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ এ শিল্প ও পরিবেশ রক্ষা পাবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পাটপণ্যকে ‘বর্ষপণ্য ২০২৩’ এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। বর্তমান টেকসই উন্নয়নের যুগে বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা কাজে লাগাতে চেষ্টা করছি। সেখানে দেশে পাটপণ্য ব্যবহারের শিথিলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। যা অনভিপ্রেত।
এসএইচআর/কেএ/এমএআর/