দুর্বল-ক্ষয়িষ্ণু আ. লীগ, চূড়া থেকে এবার তাদের পতনের পালা
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মাঠের রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে। কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামী ১৩ বছর পর রাজধানীতে সুযোগ পেয়ে বড় সমাবেশ করেছে। আরও আগে থেকে সক্রিয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ঠিক নির্বাচনের আগে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর এমন চাঙাভাব— চারদিকে সন্দেহের ডানা মেলেছে।
কেউ কেউ বলছেন, সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক কিংবা আঁতাতের অংশ হিসেবে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনকে।
যদিও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বড় ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নায়েবে আমির হামলার শিকার হয়েছেন। দলটির নেতারা বলছেন, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল ও সিইসির পদত্যাগ দাবি করেন তারা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোট গঠনের চিন্তা ও প্রক্রিয়া, জাতীয় সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন, নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানোর পক্ষে জনমত তৈরিসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিও দিয়েছে দলটি।
যদিও দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন সংসদ নির্বাচন আয়োজনে আগে থাকেই ঘোর বিরোধিতা করে আসছিল অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক কিংবা জাতীয় সরকার, যেখানে সরকারের কোনো প্রভাব থাকবে না। তবে, সরকার এখন পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন >> হাবিবুল আউয়ালের সিইসি হওয়ার যোগ্যতা নেই : চরমোনাই পীর
সম্প্রতি নির্বাচন ও বর্তমান রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই। তার দাবি, এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ২০১৮ আর ২০২৩ সালের নির্বাচন পরিস্থিতি এক নয়। ২০১৮ সালের শক্তিশালী আওয়ামী লীগ এবার ‘দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু’। জনগণকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়া থেকে এবার তাদের নামানোর পালা।
সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন।
ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বেশিরভাগ দলের। আপনারাও জাতীয় সরকারের কথা বলছেন। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন জরুরি বলে মনে করছেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণ না হলে নির্বাচনে যাবেন কি না?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হওয়া সম্ভব নয়। আমরা বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দেখেছি। স্থানীয় নির্বাচনও দেখলাম। বরিশাল সিটি নির্বাচনে আমি নিজেও প্রার্থী ছিলাম। যদিও জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন এক মনে করি না। স্থানীয় নির্বাচনগুলো সাধারণত যে সরকার থাকে তার অধীনে হয়। এক্ষেত্রে কোনো দল স্থানীয় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা জাতীয় সরকারের দাবি তোলেনি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এভাবে স্থানীয় নির্বাচন চলছিল। আমরাও অংশ নিয়েছি। কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেই দাবি তুলেছে যে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়। তবে, আমরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি আসলেই স্থানীয় কিংবা জাতীয় কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। ইসি যদিও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কী প্রমাণ হয়েছে? নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া তো দূরের কথা, প্রার্থীরাও নিরাপদ নয়।
ঢাকা পোস্ট : আলোচনা হচ্ছে, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হয়েছে। বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায় তবে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনকে নিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। সেই লক্ষ্যে কি আপনারা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : জামায়াতের বিষয়টি বলতে পারব না। তাদের রাজনীতি আলাদা। তাদের পরামর্শ পরিষদ কী ফয়সালা করে সেটা তাদের ব্যাপার। ধারণা ধারণাই। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সরকার বা অন্য দলের সঙ্গে কী সম্পর্ক তা জনগণের কাছে স্পষ্ট। ইসলাম, দেশ ও মানবতার কল্যাণ যেখানে, আমরা আছি সেখানে। রাজনৈতিক অনেক সিদ্ধান্ত অনেক দলের সঙ্গেই মিলে যেতে পারে। এটার মানে এই নয় যে সংযুক্ত হয়ে বা সমঝোতা করে সেটা হচ্ছে। যেমন- আমরা সিইসির আহ্বানে সাড়া দিইনি। তার মানে এই নয় যে বিএনপির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছি। আবার আমরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছি মানে এই নয় যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। হয়ত বা কখনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মিলে যেতে পারে। সমঝোতার কোনো বিষয় নয়। সমঝোতা বা আলোচনা এখনও হয়নি।
আরও পড়ুন >> চরমোনাই পীরের পাশে জামায়াতে ইসলামী
ঢাকা পোস্ট : জাতীয় সরকার বা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি যদি বর্তমান সরকার না মানে তবে আপনার দলের অবস্থান কী হবে? আপনারা কি নির্বাচনে যাবেন?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : আমি যদি পাল্টা প্রশ্ন করি, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সরিয়েছে। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি সরকারের থাকে তো আবারও করবে। কিন্তু সংবিধান তো ওহি নয়। সংবিধানে যা লেখা আছে জনগণের স্বার্থে তা সংযোজন-বিয়োজন করা যায়। অধিকাংশ মানুষ যদি জাতীয় সরকার চায় তবে সেটি গ্রহণ করে সরকারের উচিত সংবিধান সংশোধন করে জাতিকে বাঁচানো এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। যদি আওয়ামী লীগ সরকার তাতে ব্যর্থ হয় তবে জনগণ দাবি আদায়ে আন্দোলন করবেই।
ঢাকা পোস্ট : গত দুই জাতীয় নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। তখন আন্দোলন হয়েছে, দেশব্যাপী অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে। সরকার যদি না মানে সেক্ষেত্রে আপনারা আন্দোলন করবেন কি না? করলে কী উপায়ে?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : প্রত্যেকটা জিনিসের অবনতির সময় আসে। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর আর কি থাকে? নিচে নামা। এ সরকারের জুলুম, অত্যাচার, অবিচারও পর্বতের চূড়ায় পৌঁছে গেছে। এখন তারা ক্ষয়িষ্ণু, তাদের শক্তি আর আগের মতো নেই। ২০১৪ ও ২০১৮ আর ২০২৩/২৪ এক নয়। তখন সরকারে যারা ছিল, তারা শক্তিশালী ছিল। এখন বাইরে যারা তারা শক্তিশালী, সরকার দুর্বল। আমি মনে করি, জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামনে অগ্রসর হলে সরকারের পতন এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায় সম্ভব হবে।
ঢাকা পোস্ট : জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে রাজনৈতিক দলগুলো। আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক সমমনা দলগুলো নিয়ে জোটের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি না?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একটি নীতি আছে, পরামর্শশালা আছে। দলের মাশওয়ারা বা পরামর্শশালাই নির্ধারণ করবে আগামীতে কী করব? তবে, আমরা সমমনা ইসলামী দলগুলো নিয়ে জোট গঠনের চিন্তা ও চেষ্টা চালাচ্ছি।
ঢাকা পোস্ট : বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর আপনারা সিইসির পদত্যাগ চাইছেন কেন? নির্বাচনে আশানুরূপ ফল পাননি বলে, নাকি এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় বলে?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : চাঁদ যদি আকাশে ওঠে তবে তা গোপন করা যায় না। বরিশালের ইট-বালুকণাও জানে কী নির্বাচন হয়েছে? আসলে সিইসি ব্যক্তিগতভাবে আমার ওপর ক্ষিপ্ত। বরিশালে প্রার্থীদের সঙ্গে মিটিংয়ে বলেছিলাম, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আয়োজনে যদি ব্যর্থ হন তবে পদত্যাগ করবেন কি না? এমন বক্তব্যে তিনি হয়ত আমাকে মার্ক করেছেন, হয়ত চেয়েছেন আমার কিছু হোক। তাই তিনি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘তিনি কি ইন্তেকাল করেছেন নাকি’। তবে তার আশা পূরণ হয়নি, আল্লাহ আমাকে হেফাজত করেছেন।
আরও পড়ুন >> বিপুল ভোটে বরিশালে নৌকার জয়
যে সিইসি একজন প্রার্থীকে নিরাপত্তা দিতে পারেন না, তার অধীনে জনগণ ও নির্বাচন নিরাপদ কী করে হয়, নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হয়? আগে তো তার পদত্যাগ করা উচিত। তার পদত্যাগ আগে, তারপর অন্য বক্তব্য।
ঢাকা পোস্ট : জাতীয় নির্বাচনে বিদেশি শক্তির প্রভাব বা হস্তক্ষেপের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ড. ইউনুসকে প্রধান করে জাতীয় সরকারের আলোচনা। এমনটি হলে আপনারা মানবেন কি না?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ আমরা কোনো অবস্থাতেই কাম্য করি না। স্বাধীন দেশ, এখানে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। বিদেশি হস্তক্ষেপ চাই না। কিন্তু বিগত নির্বাচনে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা কোনো কোনো দলকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছে। সেই ইঙ্গিত আমি কোন দিকে দিয়েছি তা আপনারা বুঝতে পারছেন।
আমরা চাই এমন এক জাতীয় সরকার, যার ওপর উভয় দলের আস্থা থাকবে। সেখানে কেউ প্রশ্ন বা আপত্তি তুললে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হবে না। সেটি নিয়ে আবার আন্দোলন হতে পারে। কাজেই গ্রহণযোগ্য জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। এর রূপরেখা আমরা দেব।
ঢাকা পোস্ট : ভোটের হিসাবে ইসলামভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে অনেক বেশি এগিয়ে জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। যদি জোট করেন তবে জামায়াতের সঙ্গে করবেন কি না? জামায়াতকে সমমনা মনে করেন কি না? গুঞ্জন আছে, আপনারা জোট করতে যাচ্ছেন…
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : গুঞ্জন গুঞ্জনই, ধারণা ধারণাই। ধারণা আর বাস্তবতা আলাদা। জামায়াতের এক আদর্শ, আমাদের আরেক আদর্শ। তাদের পথ ভিন্ন, আমাদের পথ ভিন্ন। তাদের ও আমাদের মন ও মানসিকতা ভিন্ন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার বা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি নিয়ে যদি তারা রাস্তায় নামে আমরা কেন বাধা দেব? এ দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য তো আদর্শ বা নীতির দরকার নাই। যেমন- গণতন্ত্র মঞ্চ বা বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে তো আমাদের মিল বা ঐক্য নাই। তারা যদি এ দাবিতে রাস্তায় নামে তবে আমি তো বাধা দেব না।
আমরা মনে করি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ও জাতীয় সরকারের দাবিতে যারা রাস্তায় নামবে আমরাও তাদের সঙ্গে এক হয়ে যাব। এখানে ক্ষমতা, জোট, সরকার গঠনের বিষয়ে যে এক হতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। এখন আমাদের এক দফা, এক দাবি। সেটা হলো দলীয় সরকারের অধীনে নয়, নিরপেক্ষ সরকার যারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবে— এ দাবিতে কে আসছে সেটা দেখার বিষয় নয়, বিষয়টা হলো দাবি। এখানে জোট, ঐকমত্যের আলোচনা ভিত্তিহীন।
আরও পড়ুন >>ভোটকেন্দ্রে হাতপাখার প্রার্থীর ওপর হামলার অভিযোগ
ঢাকা পোস্ট : নির্বাচন কী প্রক্রিয়ায় হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে আপনাদের নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি আছে কি না?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : নির্বাচনকেন্দ্রিক সবধরনের প্রস্তুতি আমাদের আছে। কোথায়, কীভাবে নির্বাচন করব— সেটা সময় এলেই ঠিক করে ফেলব।
ঢাকা পোস্ট : কবে ঘোষণা করবেন জাতীয় সরকারের রূপরেখা?
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম : শিগগিরই আমরা জাতীয় সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করব।
জেইউ/এমএআর/