শাহজালাল যেন ‘সোনার খনি’, চোরাচালানের এত সোনা যায় কোথায়?
উড়োজাহাজের সিট-টয়লেট, বিমানবন্দরের ডাস্টবিন, যাত্রীর পকেট-শরীর, সীমান্তের ধানক্ষেত, বাজারের ব্যাগ কিংবা মোটরসাইকেল- এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে স্বর্ণের চোরাচালান আটক করে না বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিছুদিন পরপর বিমানবন্দর বা সীমান্তে ধরা পড়ছে ঝকঝকে সোনার চালান। অবস্থা এমন, অনেকে এখন শাহজালাল বিমানবন্দরকে ‘সোনার খনি’ ডাকা শুরু করেছেন! কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না সোনা চোরাচালান।
সোনা চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করে এমন বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এ দেশের সোনার দামের তারতম্য রয়েছে। চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা আনলে অনেক বেশি লাভ করা যায়। তাই দিন দিন চোরাচালান বাড়ছে। নীতিগত জায়গায় পরিবর্তন না আনলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। পাশাপাশি সোনা উদ্ধারের ঘটনায় আসামিদের বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত ১০ বছরে (২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত) সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করা হয়েছে। এসব অভিযানে অংশ নেয় শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, বিজিবি ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন। তবে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার পরও বন্ধ হচ্ছে না চোরাচালান।
দেশে সোনা আসে যেভাবে
বাংলাদেশে স্বর্ণ আসার প্রক্রিয়া জানতে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ী, ব্রোকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক বাহিনীর সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট।
তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডসহ হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অল্পকিছু সোনা বৈধভাবে আমদানি করে। বাকি সব আসে অবৈধ উপায়ে। এই সোনা দুই ভাগে বিভক্ত হয়। অর্ধেক স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছ যায়। বাকি অর্ধেক চলে যায় ভারতে। অনেক জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানও প্রবাসীদের দিয়ে অবৈধভাবে স্বর্ণের বার আনায়।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এ দেশের সোনার দামের তারতম্য রয়েছে। চোরাচালানের মাধ্যমে সোনা আনলে অনেক বেশি লাভ করা যায়। তাই দিন দিন চোরাচালান বাড়ছে। নীতিগত জায়গায় পরিবর্তন না আনলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, দেশের স্বর্ণ বেচাকেনার প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে মাত্র ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান দুবাই ও সৌদি আরবের স্বর্ণের দোকানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে স্বর্ণ কেনে। তারা স্বর্ণের বারগুলো দেশে পাঠানোর জন্য নিজেদের ব্রোকারকে দিয়ে বাহক খোঁজে। বাহকদের সঙ্গে দর কষাকষি করে দেশে স্বর্ণ পাঠায়। বাহকদের অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিক। তাদের বারপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসা বারগুলো প্রধানত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। যেসব বাংলাদেশি স্বর্ণ বহন করেন দুবাই থেকেই তাদের ও তাদের একজন স্বজনের ফোন নম্বর, পাসপোর্টের কপি, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, এনআইডির ফটোকপি রেখে দেওয়া হয়। প্রবাসীরা প্লেন থেকে নামার পর প্রথমে যান কাস্টম কর্তৃপক্ষের কাউন্টারে। সেখানে গিয়ে বারের ট্যাক্স দিয়ে রসিদ নেন। বার বৈধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশি ডিলারের প্রতিনিধি বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা থেকে রশিদসহ স্বর্ণ বুঝে নেন।
এ তো গেল বৈধ উপায়ে বাহকের মাধ্যমে স্বর্ণ আনার প্রক্রিয়া। সোনা মূলত বেশি আসে অবৈধ উপায়ে।
অবৈধভাবে কতটুকু সোনা দেশে আসে এ বিষয়ে কোনো হিসাব নেই বিমানবন্দরে কর্মরত কোনো সংস্থার কাছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছে, দেশে যারা বৈধভাবে কর দিয়ে সোনা আমদানি করে তারাই আবার লুকিয়ে অতিরিক্ত বার নিয়ে আসে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে বা ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকলে তারা বিমানবন্দরে সোনা ফেলে রেখে চলে যায়।
অবৈধভাবে কতটুকু সোনা দেশে আসে এ বিষয়ে কোনো হিসাব নেই বিমানবন্দরে কর্মরত কোনো সংস্থার কাছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছে, দেশে যারা বৈধভাবে কর দিয়ে সোনা আমদানি করে তারাই আবার লুকিয়ে অতিরিক্ত বার নিয়ে আসে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে বা ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকলে তারা বিমানবন্দরে সোনা ফেলে রেখে চলে যায়
সোনা চোরাচালানের বেশ কয়েকটি মামলা তদন্ত করেছেন বিমানবন্দর থানার সাবেক এসআই খোরশেদ আলম সাগর (বর্তমানে আরএমপিতে কর্মরত)। চোরাচালানের বিষয়ে বিভিন্ন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অধিকাংশ মামলায় চোরাচালানের মূলহোতাকে পাওয়া যায় না। বিমানবন্দর থেকে সোনাসহ গ্রেপ্তার করা হয় বাহককে। তাদের অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা অল্পকিছু টাকার লোভে সোনা বহন করে নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, কিছু আসামি পেয়েছি যারা চোরাচালানের সঙ্গে নিয়মিতভাবে জড়িত ছিল। তারা সোনা ব্যবসায়ীদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। তারা জানিয়েছে, ব্যবসায়ীরা সোনার বার আনার জন্য অর্ডার দিত। প্রতি ফ্লাইটে কমপক্ষে ১৫-২০ জন প্রবাসীকে টার্গেট করে সোনার বার দেওয়া হতো। যে ফ্লাইটে ১৫ জনকে টার্গেট করে সোনা দেওয়া হতো, সেখানে ১২ জনকে ২টি করে বার (যখন দুটি বার আনা বৈধ ছিল) এবং করের টাকা দেওয়া হতো। বাকি কয়েকজনের কাছে সোনার বড় চালান দেওয়া হয়। তাদের একেকজনের কাছে ৮-১০টি বা ১২টি করে বার দেওয়া হয়। নিয়মিত বার আনা-নেওয়া করে এমন লোকজনের কাছে আরও বেশি বার দেওয়া হয়। ওইসব যাত্রী দেশে নেমে আগে কাস্টম কাউন্টারে গিয়ে ট্যাক্স জমা দিয়ে ২টি বার বৈধ করায়। বাকিগুলো শরীরে বা মালপত্রের সঙ্গে গোপন করে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় বিমানবন্দরে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে গোপন তথ্য থাকে। তখন চোরাচালানকারীকে আটক করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ট্যাক্স দেওয়ার পর তাদের আর তল্লাশি করা হয় না। ট্যাক্স দিয়ে তারা সাধারণ যাত্রীদের মতো গ্রিন চ্যানেল হয়ে বেরিয়ে যায় এবং এজেন্টের কাছে সোনা পৌঁছে দেয়।
বৈধভাবে ট্যাক্স দিয়ে আনা স্বর্ণের পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-এর শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সোনা আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪৮ কেজির মতো। অথচ বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এক বছরে সোনার চাহিদা প্রায় ২০ থেকে ৩০ টন। তাহলে বাকি সোনার চাহিদা কীভাবে মেটানো হয়?
অবৈধ সোনার চালান ধরা এয়ারপোর্ট এপিবিএনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণত অবৈধ চালানগুলো যাদের কাছে থাকে তারা প্রত্যেকেই ২টি করে বারের কর পরিশোধ করে। বাকিগুলো নিয়ে চলে যায়। আমরা কয়েকটি সংবেদনশীল স্পটে গোয়েন্দা নজরদারি করি। কর প্রদান করা প্রবাসীরা কোথায় যায় তাদের ফলো করা হয়। এভাবে আমরা কয়েকজনকে অবৈধ বারসহ গ্রেপ্তার করেছি।
‘তবে এ ধরনের প্রবাসীরা একটু অভিজ্ঞ ও চতুর হয়, তারা আমাদের গোয়েন্দা নজরদারির কথা টের পেলে সোনার চালান ডাস্টবিন বা টয়লেটে ফেলে চলে যায়’— যুক্ত করেন তিনি।
কতটুকু স্বর্ণ আনা বৈধ, প্রকৃত চিত্র কী
বাংলাদেশ কাস্টম হাউসের ব্যাগেজ রুল (সংশোধিত ২০২৩-২৪) অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ ১১৭ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণের বার আনতে পারবেন। সাধারণত একটি স্বর্ণের বার ১০০ গ্রামের হয়ে থাকে (কিছু বড় হয়)। সেক্ষেত্রে একটি বার আনা বৈধ।
সংশ্লিষ্ট বাহককে বিমানবন্দরে নামার আগে প্লেনে দেওয়া নির্দিষ্ট ফরমে স্বর্ণের বার থাকার ঘোষণা (ডিক্লারেশন) দিতে হয়। পাশাপাশি বিমানবন্দরে নেমে কাস্টম অফিসারের কাছে গিয়ে ট্যাক্স পরিশোধ করতে হবে। প্রতি ১১ দশমিক ৬৭ গ্রাম বা এক ভরির জন্য ৪ হাজার করে প্রতিটি বারের জন্য ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। দুটি বারের বেশি স্বর্ণ আনলে সেটি জব্দ করে বহনকারীকে আটক রসিদ (ডিটেনশন মেম) দেয় কাস্টম কর্তৃপক্ষ। জব্দকৃত স্বর্ণের বার পরবর্তীতে আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রক দপ্তর ছাড়পত্র, শুল্ক-কর ও অর্থদণ্ড পরিশোধ করে ফেরত পাওয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে স্বর্ণের ট্যাক্সের ১০ গুণ পর্যন্ত জরিমানা আদায় করা হতে পারে। একটি বারের জন্য সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যায়।
এভাবে বৈধভাবে ট্যাক্স দিয়ে আনা স্বর্ণের পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-এর শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সোনা আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪৮ কেজির মতো। অথচ বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এক বছরে সোনার চাহিদা প্রায় ২০ থেকে ৩০ টন। তাহলে বাকি সোনার চাহিদা কীভাবে মেটানো হয়? এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেন না স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। তারা নানা রকম গল্প বলেন। চোরাচালানের সোনা কাজে লাগানো হয় কি না, এ বিষয়েও কোনো মন্তব্য নেই তাদের।
যে কারণে কমছে না চোরাচালান
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মতে, বিদেশ থেকে স্বর্ণ দেশে আসার পর মূলত দুটি জায়গায় যায়। প্রথমত, বাংলাদেশের সোনা ব্যবসায়ীরা এটা কিনে নেন। দ্বিতীয়ত, ভারতে পাচার করা হয়। বিশ্বে স্বর্ণের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ ভারত। দেশটি প্রতি বছর বৈধ পথেই প্রায় ৭০০ টন সোনা আমদানি করে।
বাংলাদেশের সোনা ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের সোনা আমদানির প্রধান উৎস দুবাই। কিন্তু দুবাই থেকে আনতে যে খরচ তার চেয়ে অনেক কমে বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ কিনতে পারে তারা। দুবাই থেকে ভারতে সোনা আমদানি করতে শুল্ক, ইনস্যুরেন্স, ভাড়া ও করসহ প্রতি ভরিতে খরচ হয় প্রায় ৭ হাজার টাকা। বাংলাদেশে ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আনলে ভরিপ্রতি কর মাত্র ৪ হাজার টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ ভরিতে সর্বোচ্চ ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। এ কারণে বাংলাদেশি যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করে স্বর্ণ কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ভারতীয়রা।
এদিকে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ বাণিজ্যিকভাবে বৈধ উপায়ে সোনা আমদানিতে অনাগ্রহী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সোনা ব্যবসায়ী বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী এলসি না খুলে ব্যাগেজ রুলে (লাগেজ পার্টি) সোনার বার আনায়। এতে লাভ অনেক বেশি থাকে।
সোনা আমদানির অনুমতিপ্রাপ্ত একজন ব্যবসায়ীকে বৈধভাবে সোনা আনতে হলে প্রথমত এলসি খুলতে হয়। এরপর সোনার ক্রয়মূল্য, আমদানি শুল্ক, ইন্স্যুরেন্স ফি, ফ্রেইট চার্জ, এলসির কমিশনসহ সবমিলিয়ে প্রতি ভরিতে প্রায় সাড়ে চার থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। একটি বার (১০০ গ্রাম ওজন) আনলে ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু ব্যাগেজ রুলসের আওতায় প্রতি ভরি সোনা আনার খরচ ৪ হাজার টাকা। পাশাপাশি ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার আনতে কোনো শুল্ক লাগে না। এ কারণে ব্যাগেজ রুলে স্বর্ণ আনতে আগ্রহী ব্যবসায়ীরা।
স্বর্ণ চোরাচালান কেন বন্ধ হচ্ছে না- জানতে চাইলে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে কাস্টম ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। এটা কেন বন্ধ হচ্ছে না তা তারাই বলতে পারবেন। আর এটা বন্ধ করতে কোনো উদ্যোগ নিতে হলেও তাদেরই নিতে হবে।
তিনি বলেন, একজন যাত্রী বিদেশ থেকে আসার সময় অবৈধভাবে স্বর্ণ নিয়ে এলে তাকে কীভাবে শনাক্ত করা হবে, এটা তাদের কৌশলের বিষয়। সংস্থাগুলো অবৈধ সোনা তল্লাশি করে বের করবে নাকি স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানিং পদ্ধতিতে বের করবে এটা তারাই ঠিক করবে। যেহেতু ব্যবসায়ীরা এসব অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তাই এখানে তাদের কোনো কিছু করার বা বলার নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্থাগুলো যত সতর্ক হবে স্বর্ণ চোরাচালান তত কমে আসবে।
স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে অসংখ্য সফল অভিযান পরিচালনা করেছেন এয়ারপোর্ট এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক জিয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান একটা লাভজনক বিষয়। স্বর্ণ বৈধভাবে আনলে মোটা অঙ্কের ট্যাক্স লাগে। সেই ট্যাক্সটা ফাঁকি দেওয়ার জন্য নিয়মিত চোরাচালান হয়। খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশ সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার দেশে ব্যবহারের জন্যও আসে। সবমিলিয়ে এটা লাভজনক; তাই এত সোনা উদ্ধারের পরও চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না।
বিচার শেষ হয় না, শাস্তিও হয় না
সোনা চোরাচালান নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য ঢাকা পোস্টকে জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূল অভিযুক্তরা ধরা পড়েন না, শুধু বাহকরা ধরা পড়েন। তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবুও চোরাচালানে নিরুৎসাহিত করতে তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা জামিন পেয়ে যান। আর সোনা চোরাচালানের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক কোনো বিচার হয়নি, শাস্তিও হয়নি। দৃষ্টান্ত স্থাপন হলে এমন হতো না।
২০১৩ সালের ২৪ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনা চোরাচালান আটক করেছিল তারা। এদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজের কার্গো হোল্ড থেকে ১২৪ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। উদ্ধারের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে ওই বছর বিমানের ১০ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গত ১০ বছরেও এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। আসামিরাও বর্তমানে জামিনে রয়েছেন
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জানায়, ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনা চোরাচালান আটক করেছিল তারা। এদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজের কার্গো হোল্ড থেকে ১২৪ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। উদ্ধারের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। তদন্ত শেষে ওই বছর বিমানের ১০ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গত ১০ বছরেও এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি। আসামিরাও বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
২০১৪ সালেও বিমানের এক ফ্লাইটের টয়লেটে লুকিয়ে রাখা ১০৬ কেজি সোনা জব্দ করা হয়। এটা ছিল জব্দ হওয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনার চালান। এ ঘটনার ৩ বছর পর আদালতে চার্জশিট জমা দেয় ডিবি। তবে এখনও শাস্তি হয়নি কারও। শুধু এই দুটি নয়, নিম্ন আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সোনা জব্দের ঘটনায় হওয়া ১৮৭টি মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তাপস কুমার পাল বলেন, একটি মামলায় পুলিশ ও সাধারণ জনগণ উভয়েই সাক্ষী থাকেন। বিচার চলাকালে সেসব সাক্ষী পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। মামলার সময় তারা যেসব মোবাইল নম্বর দেয় সেগুলো বদলে ফেলে। আবার বাসার ঠিকানায়ও পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, মামলায় সাক্ষী হিসেবে শুধু পুলিশ থাকলে নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠে। তাই যেকোনো মামলায় জনগণ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত হন। তাদের খুঁজে না পাওয়া এবং অনুপস্থিতির কারণে স্বর্ণের মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমে দেরি হয়।
সীমান্তে গ্রেপ্তার হলেই বদলে যায় কৌশল
বিজিবির হিসাব অনুযায়ী, সীমান্তে গত চার বছরে প্রায় ৪০০ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল এ এম জাহিদ পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি সবসময় তৎপর। সীমান্তে বিজিবির সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতায় বিভিন্ন সময় আসামিসহ অথবা আসামি ছাড়া (পরিত্যক্ত অবস্থায়) বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় কোনো আসামি গ্রেপ্তার হলে চক্রের অন্য সদস্যরা গা ঢাকা দেয়। কিছুদিন পর নতুন কৌশলে আবারও একই কাজ শুরু করে তারা।
চোরাচালান প্রতিরোধে কতটা সক্ষম বাংলাদেশ?
বাংলাদেশে মূলত সীমান্ত ও বিমানবন্দর দিয়ে সোনা প্রবেশ করে। এসব পথে চোরাচালান বন্ধের সক্ষমতা কতটুকু?
জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিমানবন্দরে চোরাচালান বন্ধে কাস্টম হাউস, কাস্টম ইন্টেলিজেন্স, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), এপিবিএনসহ ২৪টি সরকারি সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সকল সংস্থা সোনার চোরাচালান বন্ধসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণে এক যোগে কাজ করছে। সন্দেহজনক যাত্রীদের অধিকতর স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। ফলে চোরাচালান করা প্রচুর সোনা উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের জন্য মেটাল ডিটেক্টর, হ্যান্ড-হেল্ড মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে, বডি স্ক্যানার মেশিন রয়েছে। চোরাচালান প্রতিরোধে একটি উন্নত দেশের বিমানবন্দরের মতো সবধরনের রিসোর্স আমাদের রয়েছে। বিমানবন্দরে কর্মরত সকল সংস্থা এর সুফল পাচ্ছে। সোনা উদ্ধারের ফলে একদিকে যেমন চোরাচালান কমছে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
বিমানবন্দর এপিবিএনের কর্মকর্তা জিয়াউল হক জিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, চোরাচালান বন্ধে যে সক্ষমতা প্রয়োজন তা আমাদের রয়েছে। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সদিচ্ছাও আছে। ভবিষ্যতে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে। স্বর্ণের ঘ্রাণ বুঝতে পারে এমন ডগ স্কোয়াড টিম প্রস্তুতের ভাবনা রয়েছে আমাদের। এ স্কোয়াড বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে এটা হবে।
সীমান্তের সক্ষমতা নিয়ে জানতে চাইলে বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল এ এম জাহিদ পারভেজ বলেন, সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালানসহ যেকোনো ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় বিজিবির সক্ষমতা রয়েছে। একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে বিজিবি হেলিকপ্টার, স্পিডবোট, টহলের জন্য অত্যাধুনিক বাহন, ডগ স্কোয়াড, সার্ভেইলেন্স সরঞ্জামসহ অন্যান্য অনেক অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিজিবি।
এআর/ওএফ/জেএস