হাজিদের সেবায় গিয়ে প্রমোদ ভ্রমণ, শোকজ দিয়ে দায় সারছে মন্ত্রণালয়!
বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না চলতি বছরের হজযাত্রায়। প্রথমে কাঙ্ক্ষিত হজযাত্রী না পাওয়া, পরে ফ্লাইট শুরু হলেও সৌদি আরব ও বাংলাদেশে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।
দেশে সময় মতো ভিসা না হওয়ায় টিকিট কাটায় ভোগান্তি, চুক্তি অনুসারে সৌদিতে নিদিষ্ট হোটেলে না ওঠানো এবং সর্বশেষ হজ ব্যবস্থাপনায় যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাজিদের সেবা না দিয়ে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাওয়ার মতো ঘটনা যেন এবারের হজযাত্রায় সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এতে ধর্ম মন্ত্রণালয় বিব্রত হলেও শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কেবল কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে দায় সারা হচ্ছে!
আরও পড়ুন : হজ পালনে সৌদি পৌঁছেছেন ১৯ হাজার যাত্রী
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২১ মে হজের প্রথম ফ্লাইট শুরু হওয়ার পর থেকে নানা অনিয়মের দায়ে এখন পর্যন্ত আট এজেন্সি ও আট ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি সৌদি রিয়াল রাখায় বাংলাদেশি হজ এজেন্সির দুই মালিককে সৌদি আরবে আটক করা হয়েছে। তাদের অধীনে ৮২৩ জনের যাত্রাও এখন অনিশ্চিত। এছাড়া আল হেলাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান হাজিদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও হজে পাঠাতে পারেনি। ফলে ৪৫ জন গত বছরের মতো এবারও হজে যেতে পারবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।
তবে, ধর্ম মন্ত্রণালয় শাস্তির দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো উদারনীতি দেখাচ্ছে না— দাবি করেন হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মতিউল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব এজেন্সি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি, তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। যেহেতু হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে তাই চাইলেই কাউকে নিষিদ্ধ করা বা প্রত্যাহার করা যায় না। এটা করলে এসব হজ এজেন্সির অধীনে থাকা হাজিরা বিপাকে পড়বেন। চূড়ান্ত শাস্তি হজ শেষ হওয়ার পর নেওয়া হবে।
প্রতারণায় দায়ে ৮ এজেন্সিকে শোকজ
টিকিট কাটায় ভোগান্তি, সৌদি পৌঁছেও বিড়ম্বনার শিকার, হজে যাওয়ার আগে যাত্রীদের এক হোটেলের কথা বলে অন্য হোটেলে ওঠানো— টানা ভ্রমণের পর নতুন করে ভোগান্তির শিকার হতে হওয়ায় আট হজ এজেন্সিকে শোকজ করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন : হজযাত্রীদের ভ্রমণ নিরাপদ করতে যে ৪ নির্দেশনা
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কাশেম মুহাম্মদ শাহীন গত ২৩ মে আল কাশেম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, ইউরো বেঙ্গল ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম, ইউরোপা ট্রাভেলস, কে আই ট্রাভেলস, এল আর ট্রাভেলস, এন জেড ফাউন্ডেশন অ্যান্ড হজ মিশন, সাকের ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ও সঞ্জরি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এজেন্সিকে শোকজ পাঠান। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এসব এজেন্সি হজযাত্রীদের ভিসা যে হোটেলের ঠিকানায় করা হয়েছে সে হোটেলে না উঠিয়ে মক্কার বিভিন্ন ফিতরা করা হোটেলে তোলেন। মক্কার এসব হোটেলে হজযাত্রীদের রিসিভ করার জন্য এজেন্সির কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। ফলে হজযাত্রীরা তাদের জন্য নির্ধারিত হোটেল খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন। ভিসা অনুসারে হোটেল না হওয়ায় তাদের লাগেজ হোটেলে পৌঁছাতে সমস্যা হয়। পরে হজ মিশনের চেষ্টায় বিষয়টির সমাধান হলেও একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দায়ীদের আগামী তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়।
আল হেলাল এজেন্সির প্রতারণার শিকার ৪৫ হজযাত্রী
২০২২ সালে হজে পাঠানোর কথা বলে ৪৫ হজযাত্রীর কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা অগ্রিম নেয় আল হেলাল এয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি এজেন্সি। তারা এসব যাত্রীকে গত বছর হজে পাঠাতে পারেনি। ২০২৩ সালে তাদের হজে পাঠানো হবে— এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা আটকে রাখে। কিন্তু চলতি বছরও ওই ৪৫ জনকে হজে পাঠাতে পারেনি। এ অবস্থায় ওই এজেন্সি ও তাদের চারজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিমান সচিবকে চিঠি দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। শুক্রবার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কাশেম মুহাম্মদ শাহীন ওই চিঠি দেন। চিঠিতে প্রতিষ্ঠানের মালিক ইসমাইল হোসেন, ইকবাল হোসেন, ওবায়দুল্লাহ ও আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আল হেলাল এয়ার ইন্টারন্যাশনালের প্রতারণার কারণে ২০২২ সালে ৪৫ জন হজে যেতে পারেননি। হজে পাঠাতে না পারার পরও তাদের টাকা ফেরত দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৩ সালে তাদের হজে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি সাবিলুল জান্নাত এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও আল মামুন এয়ার ট্রাভেলসের হজযাত্রীদের ট্রান্সফার করে নিয়ে আসা হয়। আল হেলাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব প্যাডে চুক্তি করে এসব হজযাত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের মূল নিবন্ধন সম্পন্ন করে।
কিন্তু নিবন্ধনের ১০ দিন পর আকবর হজ গ্রুপ থেকে হাজিদের জানানো হয় যে তাদের কোনো টাকা জমা হয়নি। হজে যেতে চাইলে নতুন করে প্যাকেজের পুরো টাকা দিতে হবে, তা না হলে নিবন্ধন বাতিল করা হবে। পরে ভুক্তভোগী হজযাত্রীদের সম্মতি না নিয়ে মূল নিবন্ধন বাতিল করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন তারা। তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ওই এজেন্সির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালেও একইভাবে নিবন্ধন না করে দুই হাজার যাত্রীর কাছ থেকে নেওয়া প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে। যা সেই সময় ব্যাপক আলোচিত হয়।
মালিক আটক হওয়ায় হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় ৮৩৫ জন
নয় লাখ রিয়াল নিয়ে সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কোবা এয়ার ইন্ট্যারন্যাশনালের মালিক মো. মাহমুদুর রহমান এবং তার ছেলে ইউরো ও আহসানিয়া হজ মিশনের মালিক সাদ বিন মাহমুদ। তাদের অধীনে ৮২৩ হজযাত্রীর ১ জুন সৌদি আরবে যাওয়া কথা। মালিক আটক হওয়ায় ওই তিন হজ এজেন্সির অধীনে নিবন্ধিত ৮২৩ জনের হজ পালন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তবে, হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মধ্যস্থতায় এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।
শুক্রবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, ওই তিন এজেন্সির হজযাত্রীদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। হাব এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। আশা করি ১ জুনের আগেই সমাধান হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন : হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতগুলো কী কী?
এ বিষয়ে আশকোনা হজ অফিসের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, একসঙ্গে নয় লাখ রিয়াল উত্তোলন করায় সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। তাই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে, হজযাত্রীদের অনিশ্চয়তার কোনো কারণ নেই। দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করছি।
হাজিদের সেবায় গিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে ব্যস্ত তারা
হজযাত্রীদের সেবা দিতে এবার সৌদি গেছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মেডিক্যাল টিমের বিশাল এক বহর। অভিযোগ উঠেছে, তারা হাজিদের সেবা না দিয়ে সৌদির বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ নিয়ে ব্যস্ত। এমন এক ঘটনায় শুক্রবার সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছে সৌদি আরবের বাংলাদেশ হজ অফিস। অনুমতি ছাড়া তারা তায়েফ ভ্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত পৃথক নোটিশে বলা হয়, শুক্রবার সাতজনের দায়িত্ব পালনের জন্য খোঁজ করা হলে জানা যায় যে তারা কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে কর্মস্থলের বাইরে তায়েফে গেছেন। শোকজ খাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইদুর রহমান ও শাহানা খানম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লোক প্রশাসন কম্পিউটারকেন্দ্রের (পিএসিসি) রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী মো. লিয়াকত আলী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. নুর ইসলাম, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অফিস সহায়ক লাইজু আক্তার, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) রহিমা আক্তার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোছা. জাহান আরা বেগম।
এর আগে সৌদি আরবের বাংলাদেশ হজ অফিস এক আদেশে হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য সেবায় স্থাপিত মেডিকেল সেন্টারে সময় মতো উপস্থিত না থাকায় হজ প্রশাসনিক সহায়তাকারী বিল্লাল হোসেন নামের একজনকে শোকজ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গত ২২ মে বিকাল ৩টায় মদিনায় সমন্বিত হজ চিকিৎসক দলের দলনেতার নিকট রিপোর্ট করার নির্দেশনা থাকলেও তিনি তা করেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আশকোনা হজ অফিসের পরিচালক সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হজের মতো বড় কর্মযজ্ঞে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে, যারা বিশৃঙ্খলা করছে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এনএম/এমএআর