একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা, হুমকিতে অর্থনীতি
নতুন করে পোশাক তৈরির কার্যাদেশ নেই। তাই কারখানায় কাজও নেই। কাজ না থাকায় ঈদের পর বন্ধ হয়ে যায় আশুলিয়ার ডি কে নিটওয়্যার। একই কারণে বন্ধ হয় গাজীপুরে অবস্থিত ক্রসলাইন ফ্যাক্টরি।
প্রতিষ্ঠান দুটি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্য। কর্তৃপক্ষের দাবি, কাজ না থাকার পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ঈদের পর কারখানা দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের মতো চলতি বছরে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে চাকরি হারিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক।
নাম না প্রকাশের শর্তে কারখানা দুটির একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের আগে বেশকিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা আন্দোলন করেন। এমনকি ভাঙচুরও করেন তারা। একে তো অর্ডার নেই, অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে সমস্যা হলে আন্দোলন। এ আন্দোলনের ভয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে।
কাজ না থাকার পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ঈদের পর কারখানা দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের মতো চলতি বছরে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে চাকরি হারিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক— বলছে নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)
কারখানা বন্ধের কথা স্বীকার করেছেন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ঈদের পর দুটি কারখানা বন্ধ হয়েছে। আজ-কাল আরও কয়েকটি বন্ধ হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ নেই। এটাই মূল কারণ। আরেকটি কারণ শ্রমিক অসন্তোষ।
‘কথায় কথায় কাজ বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা। বহিরাগত শ্রমিক নেতাদের ইন্ধনে বেশকিছু কারখানার শ্রমিকরা মালিকদের কথা শুনতেন না। তারা নিজেদের ইচ্ছা মতো কাজ করেন। কিছু বললে নেতাদের ইন্ধনে আন্দোলন করেন। ঈদের আগে ডি কে নিটওয়্যার কোম্পানির এমডির কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি গত ২ মে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যে আরও কয়েকটি কারখানা বন্ধ হবে। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানা রয়েছে। সেখানেও শ্রমিক অসন্তোষ ছিল।’
বিকেএমইএ’র মতো তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের কারখানাও নতুন করে অর্ডার না পাওয়ায় বন্ধ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম। তিনি দাবি করেন,গত তিন মাস ধরে নতুন করে অর্ডার নেই। এ কারণে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন মালিকরা।
‘এখন অর্ডার অনেক কম। অর্ডার সংকটের কারণে এবারের ঈদে ১২ দিন পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হয়। আগে ঈদে যেখানে তিন দিন ছুটি দেওয়া যেত না, দম বের হয়ে যেত; সেখানে এবার ১২ দিন ছুটি, ভাবা যায়।’
বাংলাদেশ শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে দেশের মোট ৯৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলো বন্ধ হওয়ার কারণে ২০ হাজার ২৭৬ শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন।
কারখানাগুলোর মধ্যে বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত ১৭টি কারখানায় ছয় হাজার ৬৪৭ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বিকেএমইএ’র সাত কারখানায় এক হাজার ৪৮৬ জন, বিটিএমইএ’র তিন কারখানায় দুই হাজার ৮৭ জন, বেপজা’র দুই কারখানায় দুই হাজার ৪৫ জন এবং অন্যান্য ৬৮টি কারখানায় আরও আট হাজার ৩২ শ্রমিক বেকার হয়েছেন।
এপ্রিলে খুলনা ও সিলেট এলাকার আরও ১৮৯টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। সবমিলিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানায় কর্মরত ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন— বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সদস্যভুক্তসহ রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে খুব একটা সমস্যা হবে না। এগুলো কোনো না কোনোভাবে টিকে যাবে। হয়তো মালিকানা পরিবর্তন হবে কিংবা অন্য কোনো কোম্পানির অর্ডার নিয়ে কাজ করবে। সমস্যায় পড়বে গত চার মাসে খুলনা ও সিলেট অঞ্চলের যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানা এবং এখানে কর্মরত শ্রমিকদের বিষয়ে ভাবতে হবে। কারণ, সরকার রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে ছোট ছোট কারখানাগুলোকে। করোনার প্রকোপ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলায় এসব কারখানার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোতে অর্ডার কমেছে ঠিক, খুব বেশি কমেছে— এটা বলা যাবে না। কারণ, এখনও তাদের রপ্তানি গ্রোথ ভালো। তবে, গ্যাসের সংকট কিছুটা ছিল। এ সংকটও কাটিয়ে উঠছে। নতুন করে এলএমজি আমদানি হচ্ছে।’
সরকার রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। বঞ্চিত করা হয়েছে ছোট ছোট কারখানাগুলোকে। করোনার প্রকোপ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলায় এসব কারখানার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি
‘অভ্যন্তরীণ কারখানাগুলোতে গ্যাস সংকট থাকতে পারে। এ কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকার কারখানা বন্ধ হতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, কাঁচামাল আমদানিতে ডলারের সংকট। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ডলার দিতে পারছে না। তবে, এক্ষেত্রে সরকার রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরির কারখানার জন্য এলসি খুলে দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। অথচ দেশীয় শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। যারা এলসি খুলেছেন, তারা পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছেন না। হয়তো এক লাখ ডলার প্রয়োজন, সেখানে পাচ্ছেন ২০-৩০ হাজার ডলার। এতে ব্যয়ও বেড়েছে।’
‘তৃতীয় কারণ হচ্ছে, ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। যেহেতু জিনিসপত্রের (কাঁচামাল) দাম বেড়েছে, সেহেতু উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। অথচ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। তারা জিনিসপত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে স্থানীয় কারখানাগুলো যারা দেশীয় মার্কেটে পণ্য বিক্রি করে, তাদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।’
‘ছোট ছোট এসব কারখানার প্রতি সরকারে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। এখানে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়ে ভাবা উচিত’— মনে করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে সারাদেশে ৫১০টি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকায় ৯৬টি, গাজীপুরে ১৫৭টি, চট্টগ্রামে ৮০টি, নারায়ণগঞ্জে ২০টি, ময়মনসিংহে ছয়টি এবং খুলনায় বন্ধ হয় ১৫১টি কারখানা।
এমআই/এমএআর/