‘বেসিক ব্যাংক’ নামের গলার কাঁটা উপড়ে ফেলতে চায় দুদক
বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের প্রকৃত রহস্য উন্মোচন ও মূল হোতাদের পাকড়াও করতে মাঠে নামার পরও এক যুগ পেরিয়ে গেছে। সেই ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া অনুসন্ধান ও তদন্তের মারপ্যাঁচে চাপা পড়ে আছে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ফাইল। অগ্রগতি বলতে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে ৫৬ মামলা দায়ের। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের গ্যাঁড়াকলেও কেটে গেছে প্রায় আট বছর।
মাঝে কেলেঙ্কারির পেছনের কারিগরদের এড়িয়ে দুই মামলার চার্জশিট জমা হলেও অসম্পূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন হওয়ায় তা গ্রহণ করেননি আদালত। ফলে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ওই কাঁটা দুদকের গলায় আজও বিঁধে আছে। কমিশনের পর কমিশন পুনর্গঠিত হলেও দুর্নীতির সেই ফাইল নড়ছে না কিছুতেই!
এবার সেই ‘বেসিক ব্যাংক’ নামের গলার কাঁটা উপড়ে ফেলার নতুন নির্দেশনা এসেছে দুদকের কমিশন থেকে। আদালতের ধারাবাহিক চাপ ও গণমাধ্যমের বিব্রতকর প্রশ্নের জবাব দিতে তদন্ত কর্মকর্তাদের দ্রুত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে, সেই তদন্ত প্রতিবেদনে আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদের কেউ আসামি হচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে মুখ খুলছেন না দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
‘বেসিক ব্যাংক’ নামের গলার কাঁটা উপড়ে ফেলার নতুন নির্দেশনা এসেছে দুদকের কমিশন থেকে। আদালতের ধারাবাহিক চাপ ও গণমাধ্যমের বিব্রতকর প্রশ্নের জবাব দিতে তদন্ত কর্মকর্তাদের দ্রুত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে, সেই তদন্ত প্রতিবেদনে আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদের কেউ আসামি হচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে মুখ খুলছেন না দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা
দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশন থেকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা এসেছে। সেখানে মামলার ধারাবাহিকতায় চার্জশিটে নতুন কোনো আসামি অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না, সে বিষয়ে সরাসরি কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। শুধু এটুকু বলা হয়েছে যে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে। সেক্ষেত্রে আসামি যেই হোক না কেন।
আরও পড়ুন >> দুদকের গলার কাঁটা বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি
তিনি আরও বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন সভায় পুরো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করে কমিশন এমন বোঝা দ্রুত ছেঁটে ফেলতে চায়। কারণ, দিনের পর দিন এই একটি বিষয় নিয়ে দুদককে নানা ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২১ মার্চ দুদকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বেসিক ব্যাংক নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহকে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু ‘তদন্ত চলমান’ বলে বক্তব্য শেষে করেন। এর বাইরে কোনো ধরনের বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
অন্যদিকে, এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশন থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হলে জানতে পারবেন। এ মুহূর্তে আমার কাছে কোনো খবর নেই।
যদিও বিভিন্ন সময় ঋণের প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা পুনরুদ্ধারকে দুদকের সাফল্য বলে দাবি করার চেষ্টা করেছে রাষ্ট্রের দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত সংস্থাটি।
বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি প্রশ্নে ২০১৮ সালের ৩০ মে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট বিভাগ দুদকের ১০ তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করে ক্ষোভ, উষ্মা ও হতাশা প্রকাশ করেছিল। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিম সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ওই সময় প্রকৃত হোতাসহ দোষীদের আসামি করে তদন্ত শেষে করার নির্দেশনা দেন।
আরও পড়ুন >> বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি: কত টাকা উদ্ধার হয়েছে, জানতে চান হাইকোর্ট
কিন্তু এরপরও কেটে যায় চার বছর। সেই সময় বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলোচিত আবদুল হাই বাচ্চুকে পাঁচ দফা এবং বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বে থাকা পরিচালনাপর্ষদের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও মামলার চার্জশিট আর দেওয়া হয়নি।
মামলা তদন্তের একপর্যায়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তথ্য মেলে যে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির কিছু টাকা মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। সে বিষয়ে দুদকের পক্ষ থেকে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলআর) পাঠানো হলেও এখনও যথাযথ জবাব মেলেনি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত ঘটনা। তারপরও তদন্ত শেষ করতে দুদকের এত সময়ের কেন প্রয়োজন হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।
২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠার পরপরই অনুসন্ধানে নামে দুদক।
ঋণপত্র যাচাই না করে জামানত ছাড়া, জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণদানসহ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনাপর্ষদের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন >> আদায় অযোগ্য ঋণের ভারে ডুবছে ৮ ব্যাংক
প্রায় পাঁচ বছর অনুসন্ধান শেষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে টানা ৫৬টি মামলা হয়। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় দায়ের করা এসব মামলায় আসামি করা হয় ১২০ জনকে। এর মধ্যে ঋণগ্রহীতা ৮২ জন, ব্যাংকার ২৭ ও ভূমি জরিপকারী রয়েছেন ১১ জন।
অনিয়মের মাধ্যমে দুই হাজার ৬৫ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান শাখা থেকে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখা থেকে ৩৮৭ কোটি টাকা, প্রধান শাখা থেকে প্রায় ২৪৮ কোটি টাকা এবং দিলকুশা শাখা থেকে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। অভিযোগের বাকি অংশের অনুসন্ধান এখনও চলমান। এছাড়া বেসিক ব্যাংকসংক্রান্ত বিষয়ে আরও পৃথক চারটি মামলা করে দুদক।
আরও পড়ুন >> জনগণের টাকায় আনন্দ উল্লাস!
মামলায় ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই একাধিক মামলায় আসামি হয়েছেন। এর মধ্যে ব্যাংকের প্রাক্তন এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) কাজী ফখরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে ৪৮টি মামলায়। ডিএমডি ফজলুস সোবহান ৪৭টি, কনক কুমার পুরকায়স্থ ২৩টি, মো. সেলিম আটটি, বরখাস্ত হওয়া ডিএমডি এ মোনায়েম খান ৩৫টি মামলার আসামি।
প্রায় পাঁচ বছর অনুসন্ধান শেষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে টানা ৫৬টি মামলা হয়। তবে, কোনো মামলায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনাপর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। এ বিষয়ে দুদকের বরাবরই বক্তব্য ছিল, ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দালিলিকভাবে আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি
তবে, কোনো মামলায় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনাপর্ষদের কাউকে আসামি করা হয়নি। এ বিষয়ে দুদকের বরাবরই বক্তব্য ছিল, ‘ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দালিলিকভাবে আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।’
মামলা দায়েরের বেশ কিছুদিন পর ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ করা নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে অনিয়মিত ঋণ মঞ্জুর, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পরিচালনাপর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল।
আরও পড়ুন >> সাড়া দেয়নি কোনো পাচারকারীই, দেশে ফেরেনি এক পয়সাও
এমনকি দুদকের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে গণমাধ্যমের সামনে নিজের ভুল স্বীকার করে বেসিক ব্যাংকের এক সময়ের প্রতাপশালী চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু বলেছিলেন, ‘আমি যা করেছি সরল মনে করেছি। অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে। তবে, সব দায় আমার নয়। কারণ, বোর্ডের অনুমোদনের বাইরে আমি কিছুই করিনি।’
জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণের পর চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন।
আরএম/এমএআর/