ঘটনা সত্য, তারপরও তারা ‘দায়মুক্ত’!
অবৈধভাবে ২২টি গ্যাসের চুলা সংযোগ দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ না করে ‘পাঁচটি কারণ’ দেখিয়ে অব্যাহতি দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। একই সঙ্গে এফআরটি (চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য) দাখিলেরও কথা বলা হয়েছে।
এদিকে, দুদক সচিব কেজিডিসিএল-এর অভিযুক্ত ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছেন।
এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ‘ঘটনা সত্য’ কিন্তু ‘আসামিরা নির্দোষ’— এটা কীভাবে সম্ভব! অন্যদিকে, দুদকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘আমরা সঠিক পথেই রয়েছি।’
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে কেজিডিসিএল-এর ওই ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চুলা হস্তান্তরে ‘দায়িত্ব অবহেলা ও অদক্ষতার’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ গ্যাসের চুলা সংযোগ দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ১২ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা মিলেছে
আদালতে দাখিল করা দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বরাবর দুদক সচিবের চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ঢাকা পোস্টের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন ও চিঠির কপি সংরক্ষিত আছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, উন্নয়ন- ২ অধিশাখার ২০১৪ সালের ৫ আগস্টের প্রজ্ঞাপন মোতাবেক গ্যাস বিপণন নীতিমালা (গৃহস্থালি)- ২০১৪ এর বিধি ৯.৩ (১) (২) (৩) অনুযায়ী, কোনো গ্রাহকের জন্য বরাদ্দকৃত গ্যাস লোড অন্য কোনো গ্রাহকের নিকট হস্তান্তর করা যাবে না। তা সত্ত্বেও উক্ত গ্যাস সংযোগে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে লাভবান হয়ে বা অপরকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য গ্রাহক নূরজাহান সালামের নামে ভুয়া স্বাক্ষর প্রদান করে কেজিডিসিএল-এর চুলা হস্তান্তরের ভুয়া আবেদন ও সম্পাদনের পর তা খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে তার নামের ১২টি দ্বৈত চুলা আসামি গ্রাহক মুজিবুর রহমানের নামে ‘নতুন সংযোগ’ হিসেবে স্থানান্তরের অনুমোদন দিয়ে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে।”
আরও পড়ুন >> পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির ৫ কারণ, ব্যবস্থা চায় দুদক
এরপরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র না দিয়ে পাঁচটি কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দিয়েছে দুদক।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে কেজিডিসিএল-এর ওই ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চুলা হস্তান্তরে ‘দায়িত্ব অবহেলা ও অদক্ষতার’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ গ্যাসের চুলা সংযোগ দেওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ১২ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা মিলেছে।
অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- নূরজাহান সালামের কোনো অভিযোগ না থাকা, গ্যাস সংযোগ প্রদানে নির্ধারিত সকল সরকারি ফি পরিশোধিত হওয়া, পরবর্তীতে সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা, সরকারের কোনো আর্থিক ক্ষতিসাধিত না হওয়া এবং ওইসব সংযোগ হস্তান্তরে আসামিগণ কর্তৃক অবৈধ পারিতোষিক বা ঘুষ লেনদেনের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় মামলাটিতে কমিশনের আইন অনুবিভাগের মতামত-সাপেক্ষে এফআরটি (চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য) দাখিলের কথা বলা হয়েছে
প্রতিবেদনে যে ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তারা হলেন- কেজিডিসিএল-এর সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়-দক্ষিণ) প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সহকারী পরিচালক হেলাল উদ্দিন, উপ-মহাব্যবস্থাপক শামসুল করিম, ব্যবস্থাপক প্রজিত বড়ুয়া, মহাব্যবস্থাপক মু. রইস উদ্দিন আহমেদ, উপ-প্রকল্প পরিচালক/ব্যবস্থাপক মো. শহিদুল ইসলাম, উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মুবিনুল আলম, ব্যবস্থাপক (আরসিসিডি) অপূর্ব কুমার বণিক, উপ-ব্যবস্থাপক (কমন সার্ভিস) মো. জহুরুল ইসলাম, বিক্রয় সহকারী মানজুর মান্নান, মহাব্যবস্থাপক (বিপণন দক্ষিণ) মো. আমিনুর রহমান ও প্ল্যান্ট অপারেটর (সার্ভেয়ার) আবদুল গাফফার।
অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- নূরজাহান সালামের কোনো অভিযোগ না থাকা, গ্যাস সংযোগ প্রদানে নির্ধারিত সকল সরকারি ফি পরিশোধিত হওয়া, পরবর্তীতে সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা, সরকারের কোনো আর্থিক ক্ষতিসাধিত না হওয়া এবং ওইসব সংযোগ হস্তান্তরে আসামিগণ কর্তৃক অবৈধ পারিতোষিক বা ঘুষ লেনদেনের কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় মামলাটিতে কমিশনের আইন অনুবিভাগের মতামত-সাপেক্ষে এফআরটি (চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য) দাখিলের কথা বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন >> দুদকের জাল ছিঁড়ে মুক্ত ৮৪ সরকারি কর্মকর্তা!
সরকারি আদেশে আবাসিক খাতে নতুন ও বর্ধিত গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকা অবস্থায় কেজিডিসিএল-এর আবাসিক গ্রাহক নূরজাহানের ১২টি গ্যাসের দ্বৈত চুলা ভিন্ন ভিন্ন দলিলের মাধ্যমে আবাসিক ভবনে নতুন রাইজার নির্মাণের কথা বলে জালিয়াতির মাধ্যমে নতুন গ্রাহক মুজিবুর রহমানকে দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় ২০২১ সালের ১০ জুন পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন চাকরিচ্যুত দুদকের তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।
আসামি করা হয় কেজিডিসিএল-এর তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস) প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, বিক্রয় বিভাগের টেকনিশিয়ান (সি-গ্রেড) মো. দিদারুল আলম ও গ্রাহক মুজিবুর রহমানকে।
ওই মামলা দায়েরের তিন দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৩ জুন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার সানোয়ারা আবাসিক এলাকার ২২টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কেজিডিসিএল-এর একটি অভিযানিক দল। এর মধ্যে তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে দুদক। তারা হলেন- সারওয়ার হোসেন, মজিবুর রহমান ও দিদারুল আলম।
আরও পড়ুন >> পৌনে ৩ কোটি টাকার সম্পদে ফাঁসলেন স্ত্রীসহ পুলিশ কর্মকর্তা
শুরুতে মামলার বাদী শরীফ মামলাটি তদন্ত করলেও পরবর্তীতে তাকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি এবং চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর মামলাটি নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব পান দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মুহা. মাহবুবুল আলম। তিনিও আংশিক তদন্ত শেষে বদলি হয়ে যান। গত বছরের ১০ মার্চ নতুন করে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়- ২ এর উপ-পরিচালক মো. আতিকুল আলম।
ওই কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলার সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য (এফআরটি) বলে অনুমোদন দেয় দুদক কমিশন।
দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হকের স্বাক্ষরে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলা হয়, ‘তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দাখিলকৃত সাক্ষ্য-স্মারক ও অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনা করিয়া উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় কমিশন কর্তৃক পরিতুষ্ট হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন- ২০০৪ এর ৩২ ধারা এবং দুদক বিধিমালা- ২০০৭ এর বিধি ১৫ উপবিধি ১-এর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এফআরটি দাখিলের অনুমোদন দেওয়া হলো।’
এদিকে, গত ২০ মার্চ দুদক সচিব কেজিডিসিএল-এর ওই ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দেন। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক।
তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের দুদকের প্যানেল আইনজীবী মাহমুদুল হক বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি চিঠি আদালতে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়নি।’
আরও পড়ুন >> ঢাকা ওয়াসায় সমিতির ৩৫৫ কোটি টাকা নয়-ছয়!
প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘আমরা যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, পরবর্তীতে প্রয়োজন পড়লে আমরা এর রিভিউও করতে পারি। সেটা নিয়ে নিজেরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কি না। যদি পর্যালোচনায় মনে হয় ছোটখাটো ভুল হয়েছে তাহলে এর সংশোধনের সুযোগ আছে। এমনকি চার্জশিট দাখিলের পরও সে সুযোগ থাকে।’
দুদকের এফআরটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনুসন্ধান পর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তা অপরাধের বিষয়টি পাওয়ার পর মামলা করেন। কিন্তু তদন্ত পর্যায়ে অনেক সময় অপরাধের পক্ষে যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। এফআরটি যখন দেওয়া হয় তখন বিচার বিভাগের দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত লিগ্যাল উইংয়ের যথাযথ মতামত নিয়ে আদালতে দাখিল করা হয়। অর্থাৎ অত্যন্ত নিখুঁত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
‘আমরা মনে করি, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার চেয়ে এফআরটি দেওয়া অধিকতর যৌক্তিক। এখানে অন্য কোনো প্রশ্ন নিতে চাই না। আমি মনে করি, আমরা সঠিক পথেই রয়েছি।’
আরএম/এমএআর/ওএফ