ইউজিসির চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী যারা
আগামী ২৫ মে অবসরে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ। তার অবসরে কে হবেন ইউজিসি চেয়ারম্যান— দুই মাস আগে থেকেই তা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সাতজন সাবেক উপাচার্যসহ এক ডজনের বেশি সিনিয়র শিক্ষক। নিজ নিজ চ্যানেলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করেছেন তারা। এ পদের নিয়োগ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে হওয়ায় সবাই চেষ্টা করছেন তার নজর কাড়তে।
জানা গেছে, নিয়োগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন-অর-রশিদের প্যানেলের মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। উভয়ই চাচ্ছে তাদের প্যানেল থেকে ইউজিসির চেয়ারম্যান নিয়োগ হোক। এ কারণে যে যার চ্যানেলে কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি একে অন্যের নিয়োগ ঠেকাতে মরিয়া দুই প্যানেল।
নিয়োগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের প্যানেলের মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। উভয়ই চাচ্ছে তাদের প্যানেল থেকে ইউজিসির চেয়ারম্যান নিয়োগ হোক
সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার চেয়ারম্যান পদটি সবার কাছে সম্মানের, একই সঙ্গে লোভনীয়; বিশেষ করে সাবেক উপাচার্য ও সিনিয়র শিক্ষকদের কাছে। জীবনের শেষ সময়ে এসে একবার হলেও এ পদে আসীন হতে চান অনেকে। এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে ইউজিসির চেয়ারম্যান হওয়ার নজির নেই। চার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা ও সাবেক উপাচার্যদের মধ্যে ১৩ জন চেয়ারম্যানকে (সাবেক) এ পদের জন্য বেছে নেওয়া হয়। তবে, চমক দেখাতে এবার ওই চার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও চেষ্টা করছেন।
জানতে চাইলে মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চেয়ারম্যানের নিয়োগটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে মাধ্যমে হয়। এখানে ইউজিসির কোনো হাত নেই।
স্নায়ুযুদ্ধ যেভাবে চলছে
আরেফিনপন্থি হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে জানান, ঢাকার বাইরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটা জানাজানি হওয়ার পর হারুন স্যারের লোকজন তা আটকে দেয়। আমার একজন শিক্ষক সম্প্রতি সরকারের সংবিধিবদ্ধ একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন। ওই দপ্তর থেকে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনওসি (অনাপত্তি সনদ) আনতে পারলে নিয়োগ দেওয়া যাবে।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য, উপ-উপাচার্য সবাই ঘোর আরেফিনবিরোধী। শেষ পর্যন্ত স্যার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তার মতে, আরেফিন ইউজিসির চেয়ারম্যান হবেন, এটা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঠেকাতে চাইবেন হারুনপন্থিরা। একইভাবে আরেফিনপন্থি শিক্ষক ও তার অনুসারীরা হারুনপন্থিদের নিয়োগ ঠেকাতে সবধরনের তৎপরতা চালাবেন।’
আলোচনায় যারা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য শীর্ষপদ ইউজিসির চেয়ারম্যান হতে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবারের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও অধ্যাপক ড. এম শাহ নওয়াজ আলী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সরকারি কর্ম-কমিশনের সাবেক সদস্য শরীফ এনামুল কবির।
এছাড়া এ পদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন কমিশনের বর্তমান তিনজন সদস্য। তারা হলেন- অধ্যাপক দিল আফরোজ বেগম, অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম. ওয়াহিদুজ্জামানও রয়েছেন এ দৌড়ে।
আলোচনায় এগিয়ে যারা
এক ডজনের বেশি শিক্ষক দৌড়ঝাঁপ করলেও চেয়ারম্যান পদের মূল আলোচনায় আছেন সাতজন। এর মধ্যে শীর্ষে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবারের ভিসি ও সাবেক শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আরেফিন সিদ্দিক। তিনি আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী ছাড়াও বঙ্গবন্ধু পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সরকারের যেকোনো দুঃসময়ে তিনি বিবৃতি, মানববন্ধন করে সামনে থাকেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চেয়ারম্যান আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কখনই কোনো পদের জন্য তদবির বা যোগাযোগ করি না। এবারও করব না। প্রধানমন্ত্রী চাইলে হবে, নতুবা না।
ইউজিসির চেয়ারম্যান হতে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবারের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও অধ্যাপক ড. এম শাহ নওয়াজ আলী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সরকারি কর্ম-কমিশনের সাবেক সদস্য শরীফ এনামুল কবির
এরপর আছেন এক-এগারোর সময় কারাভোগ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবারের সাবেক উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপ-উপাচার্য আওয়ামীপন্থি শিক্ষক নেতা ও বুদ্ধিজীবী। চেয়ারম্যান পদে লড়াইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা একান্ত প্রধানমন্ত্রীর বিষয়। আমি কোনো তদবিরের মধ্যে নেই। সরকার যদি মনে করে নিয়োগ দেবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবারের উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক মীজানুর রহমানও আলোচনায় এগিয়ে আছেন। যুবলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ছাড়াও তিনি আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত।
ইউজিসির প্রথম নারী চেয়ারম্যান হিসেবে আলোচনায় আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবারের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সরকারের শীর্ষমহলের সদয় দৃষ্টি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করা এ শিক্ষকের বড় ভাই স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের সাবেক মহাপরিচালক ও সেনাবাহিনীর সাবেক এক লেফটেন্যান্ট জেনারেল।
সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সেক্টর কমান্ডার ফোরামের চেয়ারম্যান এ কে খন্দকারের ভাই বজলুল হকও আছেন আলোচনায়। গতবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যে ছয়জনের তালিকা পাঠানো হয় সেখানে তার নামও ছিল। আলোচনায় আছেন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও ইউজিসির সাবেক সদস্য অধ্যাপক ড. এম শাহ নওয়াজ আলী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদও।
যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় চেয়ারম্যান
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের চেয়ারম্যান পদে আগ্রহী শিক্ষকরা তাদের বায়োগ্রাফি (জীবনবৃত্তান্ত) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জমা দেন। মন্ত্রণালয় থেকে সেই তালিকা ও জীবনবৃত্তান্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী সেই তালিকা যাচাই-বাছাই, গোয়েন্দা প্রতিবেদন, শিক্ষকতা জীবনে তিনি কোন মতাদর্শের ছিলেন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সততা— এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ে পাঠান। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর আবার তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে।
ইউজিসির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, চেয়ারম্যান পদটি হাইপ্রোফাইল একাডেমিক ও রাজনৈতিক পদ। এ পদে জোর তদবির চলে। এ তদবিরে যিনি এগিয়ে যান, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নজর কাড়তে পারেন, তিনিই এ পদে আসীন হন। এজন্য সবাই নিজস্ব লবিং দিয়ে চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকার বাইরে থেকেও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান নিয়োগে এমনটা হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবু ইউসুফ মিয়া বলেন, ইউজিসির বর্তমান চেয়ারম্যানের মেয়াদ আরও দুই মাস বাকি। এখনও এ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। কেউ ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষামন্ত্রী বা সচিবের কাছে জীবনবৃত্তান্ত দিতে পারেন।
এনএম/জেডএস