গ্রামেও বেড়েছে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন, নেপথ্যে কী?
পাঁচ বছর বয়সী শিশু সুমাইয়া (ছদ্মনাম)। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করার সময় তাকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর (৪৫)। সেখানে তাকে ধর্ষণ করা হয়। শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাড়িতে ফিরে কান্নাকাটি শুরু করে। কারণ জানতে চাইলে মাকে ঘটনা খুলে বলে সে।
গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী শাকপুরা চৌমুহনী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বোয়ালখালী থানায় মামলা দায়ের হয়। অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পোমরা ইউনিয়নে ছয় বছরের শিশু ইসফাকে (ছদ্মনাম) ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে মো. জাহেদুল ইসলাম নামের এক তরুণের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিশুকে বাড়ির পাশের পেয়ারা বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে অভিযুক্ত তরুণ। শিশুটির চিৎকারে মা ছুটে এলে পালিয়ে যায় জাহেদ। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
আরও পড়ুন >> গ্রামাঞ্চলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১৯ শতাংশ শিশু
শিশু নির্যাতনের এমন ঘটনা এত দিন শহরে বেশি দেখা গেলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামেও। গত এক বছরে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে শতাধিক শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
ভুক্তভোগী এক শিশুর বাবা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মেয়ে এখনও ঘুমের মধ্যে ভয় পায়। মাঝ রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার দিয়ে বলে, ‘জাহেদ আসছে…’ । জাহেদ এলাকায় আরও ১০/১৫ বার একই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। প্রতিবার এলাকায় সালিশ হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোনো বিচার হয় না। আমার মেয়েকে ধর্ষণের পরও এলাকায় সালিশ হয়েছে। তাকে ১০০ বেত্রাঘাতের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তার পরিবার এটা মানেনি। পরে আমরা সমাজের সবার সঙ্গে পরামর্শ করে মামলা করি।
এখন তারা আমাদের মামলা তুলে নিতে বলছে। নানা রকম হুমকি দিচ্ছে— অভিযোগ ভুক্তভোগী শিশুর বাবার।
এদিকে, চট্টগ্রামের আদালতে জেলা পুলিশের প্রসিকিউশন শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে জেলার বিভিন্ন থানায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সময় পর্যন্ত ১৩ মাসে মোট ১৩১টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক মামলার ভুক্তভোগী শিশু।
২০২১ সালে সারা দেশে ৭৭৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। একই বছর ১৮৫ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। ২০২২ সালে ৫৬১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয় এবং ১০১ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ২৩ শিশুকে ধর্ষণ করা হয় এবং চার শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। মোট ২৫ মাসে সবমিলিয়ে এক হাজার ৬৪৮ শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়। ভুক্তভোগী সবাই কন্যাশিশু
বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) এসআই মল্লিকা দাশ রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক বছর ধরে আমি আদালতের এ শাখায় কর্মরত। এখানে ধর্ষণের ঘটনার যত মামলা রেকর্ড হয়েছে সেগুলোর ভুক্তভোগী বেশির ভাগই শিশু।
এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে ৭৭৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। একই বছর ১৮৫ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। ২০২২ সালে ৫৬১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয় এবং ১০১ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ২৩ শিশুকে ধর্ষণ করা হয় এবং চার শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। মোট ২৫ মাসে সবমিলিয়ে এক হাজার ৬৪৮ শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়। ভুক্তভোগী সবাই কন্যাশিশু।
এ প্রসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রাম-৭-এর বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খন্দকার আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। এটা বলা কঠিন, কোথায় কী হচ্ছে? গ্রাম আর শহর বলেন, প্রত্যেকটা ঘটনাই আলাদা। মন্দ লোক গ্রামেও থাকতে পারে, শহরেও থাকতে পারে। তবে বলতে পারেন গ্রামে আগে একটু কম ছিল। আমরা নোটিশ করতাম না, অগোচরে হতো। তবে এখন মামলা হচ্ছে।
আরও পড়ুন >> ধর্ষণের দায়ে যুবকের যাবজ্জীবন, তার পরিচয়ে বড় হবে সন্তান
‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এখন মৃত্যুদণ্ড। সাজা বড় বলে এখন অনেকে কোর্টের বাইরে আপস করে ফেলছেন। জান বাঁচানোর জন্য ৮০ বছরের পুরুষের সঙ্গে ১৫ বছরের শিশুর বিয়ে দিচ্ছেন। বাড়িঘর বিক্রি করে সম্পদ দিয়ে হলেও ম্যানেজ করে ফেলছেন। অনেক সময় জ্ঞানের অভাবে আলামত নষ্ট করে ফেলে। অনেকে জেনেবুঝে আলামত নষ্ট করে ফেলেন। সালিশের নামে সময়ক্ষেপণ করেন। আবার পুলিশ ভালোভাবে তদন্ত করতে চাইলেও বাদীপক্ষের সহযোগিতা পান না। এসব কারণে অনেক মামলা সাজার মুখ দেখে না। আইনজীবী, বিচারক, পুলিশ— সবাই ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিরোধে সচেষ্ট। আমি আমার ট্রাইব্যুনালে তিনজন বিচারককে পেয়েছি, ওনারা কেউ এ বিষয়ে শিথিলতা দেখান না।’
সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, বর্তমান সময়ে ডিজিটাল প্লাটফর্মের একটা নেতিবাচক দিক হলো অনলাইনে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে পর্নোগ্রাফি ভিডিও ও কনটেন্ট। এসব দেখে ও পড়ে তরুণদের মধ্যে বিকৃত মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে বয়স্ক পুরুষরাও এগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে, শিশুদের সহজেই প্ররোচিত করা যায়। ফলে সামান্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ধর্ষণ করে বিকৃত মনের পুরুষরা। এক্ষেত্রে তরুণ-যুবকদের অভিভাবকদের অসচেতনতাও দায়ী বলে মনে করেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা যতটা প্রকাশ্যে আসে তার চেয়ে বেশি আড়ালে থেকে যায়। কোনো কোনো পরিবার ‘বদনামে’র ভয়ে শিশুর ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আনে না।
আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা পুলিশ দায়সারা তদন্ত করে। আবার যথাযথ তদন্ত করলেও বিচারের সময় সাক্ষীর অভাবে অনেক আসামি খালাস পেয়ে যায়।
আরও পড়ুন >> দশ মাসে ধর্ষণের শিকার ৮৩০ জন নারী, ঢাকায় সর্বাধিক
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনলাইনে অশ্লীল ছবির ছড়াছড়ি। এসব দেখে মানুষ বিকৃত উপায়ে যৌন আচরণ করে। অনেক মামলার আসামি এটা স্বীকার করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশী কিংবা নিকটাত্মীয় দ্বারাও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে।
‘ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময় অভিভাবকরা লজ্জায় সামনে আনেন না। তারা মামলা করতে চান না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে না। কখনও আবার সাক্ষীর অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যায়। এসব কারণে এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের প্রথাগত শাস্তির পাশাপাশি সামাজিকভাবেও শাস্তি দিতে হবে। তাদের চিহ্নিত করে সমাজ থেকে বয়কট করতে হবে। উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে বিচারপ্রাপ্তির আস্থা বাড়াতে হবে। এছাড়া শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণবিরোধী প্রচারণা বাড়াতে হবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কমিটি করে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে হবে।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) সুদীপ্ত সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি একটি সামাজিক অবক্ষয়। পুলিশের একার পক্ষে এ অবক্ষয় সামলানো কঠিন। নৈতিকতার শিক্ষা পরিবার থেকেই দেওয়া উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জেন্ডার ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া দরকার। একযোগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রচারণা বাড়াতে হবে।
আরও পড়ুন >> নিষিদ্ধ শিশুশ্রমে ‘নীল’ ওদের শৈশব
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশুদের সহজেই প্ররোচিত করা যায়। তাই তারা বেশি বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা কমাতে অভিযুক্তদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও শাস্তি দিতে হবে। যেন তারা ‘চিহ্নিত অপরাধী’ হিসেবে সবার ঘৃণার পাত্র হয়।
প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষ কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়ে ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। এছাড়া মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রচারণা বাড়াতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৌমিতা পাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশু ধর্ষণের ঘটনা আগেও হতো, বর্তমানেও হচ্ছে। তবে গ্রামাঞ্চলের ঘটনা আগে প্রকাশ পেত না। এখন প্রযুক্তির কারণে প্রকাশ হচ্ছে। আগে এসব ঘটনা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যেত। গ্রামের মানুষ এখনও পাশাপাশি থাকে। তারা একে অপরের পরিচিত। এজন্য লোকলজ্জার কারণে তারা মামলায় যেতে চান না। তাছাড়া সাধারণ মানুষের অনেকের মধ্যে এখনও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কাজ করে।
ধর্ষণ মামলার আইন ও শাস্তি
এক সময় দণ্ডবিধি আইনে ধর্ষণের ঘটনার বিচার হতো। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশদের প্রণয়ন করা এ আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে- ‘কোনো পুরুষ পাঁচটির যে কোনো অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করলে তিনি ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে।’
আরও পড়ুন >> ফতুল্লায় কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা, ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড
এগুলো হলো- ‘প্রথমত, নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত, নারীর সম্মতি ছাড়া; তৃতীয়ত নারীর সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করা হলে; চতুর্থত, নারীর সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানেন যে তিনি স্ত্রী লোকটির স্বামী নন এবং পুরুষ জানেন যে স্ত্রী লোকটি তাকে এমন অন্য একজন পুরুষ বলে ভুল করেছেন যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসম্মতভাবে বিয়ে হয়েছে বলে বিশ্বাস করেন; পঞ্চমত, নারীর সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যদি ভুক্তভোগীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়।’
এ আইনের ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি ধরা হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের অপরাধ করে, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন, যদি না ধর্ষিতা নারী তার নিজের স্ত্রী হয় এবং ১২ বছরের কম বয়সের না হয়। যদি এ রকম হয়, তবে ওই ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন।’
তবে বর্তমানে ২০০০ সালে প্রণয়ন করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের বিচার হয়। এখানে দণ্ডবিধি আইনে দেওয়া ধর্ষণের সংজ্ঞা বহাল রাখা হয়েছে। তবে আগে নির্দিষ্ট মেয়াদের কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন দণ্ড থাকলেও এ আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা এখন মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে।
এ আইন সর্বশেষ ২০২০ সালে সংশোধন করা হয়। বর্তমানে এ আইনের অধীনে ধর্ষণ মামলার বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।
এমআর/এমজে/এমএআর/ওএফ