হঠাৎ নজর কেন চেম্বারে?
নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে নিজ কর্মস্থলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন (ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস) সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। আগামী মার্চ থেকে ২০টি জেলা হাসপাতাল এবং পাঁচটি মেডিকেল কলেজে এ কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া কী হবে— এসবের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে চিকিৎসক সমাজে। বিষয়টি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত ‘আইওয়াশ’ মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জেলা-উপজেলা সরকারি হাসপাতালগুলোতে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয় না। ফলে রোগীদের বাধ্য হয়ে যেতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে। এছাড়া চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংকটে প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবার বেহাল অবস্থা। লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ওষুধের দাম।
নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা নিজ কর্মস্থলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন। তবে প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে হতে পারে দু-এক দিন। এক্ষেত্রে রোগী দেখার জন্য আলাদা সম্মানীর ব্যবস্থা রাখা হবে। চিকিৎসকের মান অনুযায়ী এ সম্মানী হতে পারে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা
আরও পড়ুন >> টাকা-উপহারে ‘বিক্রি হচ্ছেন’ চিকিৎসক, বাড়ছে ব্যয়!
অন্যদিকে, রাজধানীসহ সারাদেশে লাগামহীনভাবে রোগীদের পকেট কাটছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। এত সমস্যায় যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন সমস্যা সমাধানে কার্যকর তেমন কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই চিকিৎসকদের লাগাম টানছে সরকার— বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা নিজ কর্মস্থলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন। তবে প্রতিদিন নয়, সপ্তাহে হতে পারে দু-এক দিন। এক্ষেত্রে রোগী দেখার জন্য আলাদা সম্মানীর ব্যবস্থা রাখা হবে। চিকিৎসকের মান অনুযায়ী এ সম্মানী হতে পারে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা।
হাসপাতালগুলোতে নেই পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা
একজন রোগী যখন কোনো সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে যান, চিকিৎসকরা তখন রোগ নির্ণয়ে প্রথমেই আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি ও রক্ত পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় কিছু পরীক্ষা দেন। অথচ দেশের জেলা-উপজেলা সদর হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ এই সেবাবিহীন অবস্থায় চলছে।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ জেলা এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি ৮৯ শতাংশ উপজেলা এবং ৫৬ শতাংশ জেলাতে আলট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা নেই। ইসিজি পরীক্ষা নেই ১২ শতাংশ জেলা এবং ২৪ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে। এছাড়া ৪১ দশমিক ২ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা থাকলেও বাকি ৫৯ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে নেই রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা।
জনবল সংকটে প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবার বেহাল অবস্থা
বিএসএমএমইউয়ের গবেষণা আরও বলছে, জেলা হাসপাতালগুলোতে শতকরা ৩০ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৬৩ ভাগ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৭৭ ভাগ জুনিয়র/ সিনিয়র কনসালটেন্টের পদ শূন্য। এছাড়া জেলা হাসপাতালে শতকরা ৬৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৩৮ ভাগ মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন পদ শূন্য।
বিএসএমএমইউয়ের গবেষণা বলছে, জেলা হাসপাতালগুলোতে শতকরা ৩০ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৬৩ ভাগ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৭৭ ভাগ জুনিয়র/ সিনিয়র কনসালটেন্টের পদ শূন্য। এছাড়া জেলা হাসপাতালে শতকরা ৬৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৩৮ ভাগ মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন পদ শূন্য
গবেষণায় শুধু চিকিৎসক পদই নয়, নার্সিং স্টাফ/মিডওয়াইফ পদের ক্ষেত্রেও জেলা হাসপাতালে শতভাগ ১৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ২৫ ভাগ পদ শূন্য পাওয়া গেছে। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৪২ ভাগ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট/টেকনিশিয়ান পদ শূন্য। সেখানে নেই পর্যাপ্ত ক্লিনার, নিরাপত্তাপ্রহরীও।
ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস ‘আইওয়াশ’ মাত্র : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আবদুস সবুর খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় এত সমস্যা, কিন্তু সবকিছু রেখে মন্ত্রী এটি কেন করতে চাইলেন আমার বুঝে আসছে না। আমার যতটুকু ধারণা, ঢাকার দু-চারটি হাসপাতালে কোনোরকম শুরু করে একটু আইওয়াশ করবে। এর বাইরে কিছু না। শুরু হওয়া দু-একটি হাসপাতালের পেছনে যদি আপনারা কিছুদিন লেগে থাকেন তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আসবে।
আরও পড়ুন >> প্রতিরোধে মনোযোগ নেই, শুধু ওষুধ আর ওষুধ
তিনি বলেন, সরকার যদি সিদ্ধান্ত নিত সরকারি হাসপাতালগুলোতে ২৪ ঘণ্টা প্যাথলজি খোলা থাকবে, এতে বরং রোগীরা বেশি উপকৃত হতেন। কারণ, একজন চিকিৎসক রোগী থেকে কত টাকা ফি নেন, তার চেয়ে তিন/চার গুণ টাকা তো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনেই রোগীদের খরচ করতে হয়।
ডা. সবুর খান বলেন, আমাদের দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ লাগামছাড়া। এক পরীক্ষাতেই একেক প্রাইভেট হাসপাতালের খরচ একেক রকম। সে জায়গাগুলোতে রোগীদের পকেট কাটা হচ্ছে। চিকিৎসকদের পেছনে না লেগে সেই জায়গাগুলোতে হাত দিলে রোগীদের জন্য ভালো হতো।
‘মন্ত্রী যেভাবে বললেন, ১ মার্চ থেকে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস শুরু হবে, কিন্তু কোথায় কোথায় শুরু হবে সেটি স্পষ্ট করে বলেননি। গল্পগুলো বলতে যতটুকু না ভালো লাগে, বাস্তব প্রয়োগ খুবই কঠিন’— যোগ করেন এ বিশেষজ্ঞ।
হঠাৎ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ এজেন্ডা কেন, প্রশ্ন সাবেক বিএমএ সভাপতির
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, আমি জানি না সরকার আসলে কী চাচ্ছে বা তারা এটাকে কীভাবে অর্গানাইজ করবে? আমাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসায় অনেক অব্যবস্থাপনা আছে। এসবের সমাধান জনগণও চান, চিকিৎসকরাও চান। সরকার এ এজেন্ডা এখন নিয়ে আসছে কেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো গত চার বছর ধরে মন্ত্রী হিসেবে আছেন, আগে কেন চেষ্টাটা করেননি? তবুও আমি মন্দের ভালো হিসেবে বলব, তারা একটা চিন্তা অন্তত করেছে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান প্রয়োজন।
তিনি বলেন, এখন একটা পরিপত্র দিয়েই যদি চিকিৎসাটা করা যেত, তাহলেই খুব খুশি হতাম। কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব কি না, জানি না। কারণ, একেকটা হাসপাতালে যত স্পেশালিস্ট আছেন, তাদের বসার জায়গা কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে? এটা তো এমন না যে অহি নাজিল করলাম আর হয়ে গেল। এতে জনগণ আরও আতঙ্কিত হচ্ছেন।
ডা. রশিদ-ই মাহবুব আরও বলেন, প্রতিটি হাসপাতালের একেকটি বিভাগে যে পরিমাণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, সেখানে ততগুলো বসার রুমও নাই। এছাড়া তাদের লজিস্টিক সাপ্লাই, প্যাথলজি টুলস ও অর্থ কি প্রাইভেট হাসপাতালের মতো এখানে পাবে? চিকিৎসা মানেই শুধু চেম্বার নয়, এখানে সার্বিকতা রয়েছে। এখন এই চিকিৎসকরা যদি প্রতিষ্ঠানেও চেম্বার করে আবার বাইরেও চেম্বার করে, তাহলে জনগণের কী লাভ হবে আমি বুঝতে পারছি না। চিকিৎসকরা কি তাহলে এখানে রোগী ধরার জন্য আসবেন? এখান থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা করবেন?
ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ল্যাব সার্ভিস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ল্যাব সার্ভিস। কিন্তু আমাদের হাসপাতালগুলোর ল্যাব সার্ভিসের অবস্থাই তো নাজুক। ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস শুরু হলে অবশ্যই সবার আগে ল্যাব সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে। ল্যাব সার্ভিস ফাংশনাল না হলে এ কার্যক্রমে খুব বেশি লাভ হবে না। কারণ, চিকিৎসা সেবায় কনসালটেন্ট ফি তো সামান্য টাকা। একজন চিকিৎসক সর্বোচ্চ ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন। কিন্তু তার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় চলে যাচ্ছে চার-পাঁচ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন >> নিয়ন্ত্রণহীন ই-সিগারেট, টার্গেট তরুণ প্রজন্ম
তিনি বলেন, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস যদি মেডিকেল কলেজ পর্যায়ে চালু হয়, তাহলে ঠিক আছে। কারণ, সেখানে একই ডিসিপ্লিনের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। কিন্তু জেলা বা উপজেলা হাসপাতালে এটি সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষ সেখানে শুধু চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের জন্য যাবেন না, এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক সেবাগুলোও লাগবে।
সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, চিকিৎসায় বর্তমানে চিকিৎসক দেখানোর চেয়ে ব্যয়বহুল হলো ডায়াগনোসিস করা। জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোতে তো স্বাভাবিক সময়েই ঠিক মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। এজন্য এটি করতে হবে মেডিকেল কলেজে। এক্ষেত্রে পরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি থাকতে হবে। বিকেলে চিকিৎসক, নার্সসহ যারা কাজ করবেন তাদের কাজের ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসকের ভিজিট, পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা-পয়সার কী হবে, চিকিৎসক কত পাবেন, সহায়ক স্টাফরা কত পাবেন— সবকিছু কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা, ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণে জোর
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি ক্লিনিক্যাল গ্রুপের প্রত্যেকটিতে একটি করে জুনিয়র কনসালটেন্টের পদ থাকলেও অধিকাংশ পদ শূন্য রয়েছে। যেসব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকে প্রেষণে অন্যত্রে কর্মরত। অনেক চিকিৎসক নিয়মিত হাসপাতালে যান না। আবার সাধারণ চিকিৎসকদের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আয়া, ওয়ার্ড বয় ও নিরাপত্তারক্ষীসহ সহায়ক জনবলেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ল্যাব টেকনিশিয়ানসহ পর্যাপ্ত জনবল এবং ল্যাব সরঞ্জামের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ডায়াগনস্টিক সেবার কার্যক্রমও বেশ নাজুক। এসব অবস্থার উন্নতি না হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর কোনো সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে জেলা হাসপাতাল বা সদর হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা ১০০ থেকে ২৫০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেসব জেলা বা সদর হাসপাতালে একই ক্লিনিক্যাল গ্রুপের একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পর্যাপ্ত সহায়ক জনবল ও ডায়াগনস্টিক টেস্টের সম্পূর্ণ সুবিধা আছে সেসব জেলা হাসপাতালে এ প্র্যাকটিস চালুর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ২০০ থেকে ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালগুলো কিছুটা এগিয়ে রয়েছে।’
ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, অধিকাংশ বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালসমূহে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর সুযোগ আছে। তবে, এক্ষেত্রেও ডায়াগনস্টিক টেস্টের সুবিধা বাড়াতে হবে। এ ব্যবস্থা চালু হলে কর্মক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় চিকিৎসকদের উপস্থিতি কমতে পারে। ফলে নির্ধারিত কর্মঘণ্টায় সেবা নিতে আসা রোগীরা মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তবে, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কাঠামো শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে এ সমস্যা অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব।
চালু হলে জনগণ ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
এদিকে, ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু হলে জনগণ ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে প্র্যাকটিস শুরু হলে হাসপাতালে গিয়ে মানুষ চিকিৎসক পাবেন। যারা ভর্তি আছেন, তারাও চিকিৎসা পাবেন। একসঙ্গে অনেক চিকিৎসক পাওয়া যাবে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা থাকবে।
আরও পড়ুন >> অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার
মন্ত্রী বলেন, বাইরে চিকিৎসক দেখাতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কমে এ সেবা পাওয়া যাবে। এটি আমাদের উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সহযোগিতা আমরা চাই।
কবে থেকে শুরু হবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আশা করছি, আমাদের স্বাধীনতার মাস মার্চ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস শুরু করতে পারব। পর্যায়ক্রমে আমাদের এ সংক্রান্ত পাইলট প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শুরু হবে। এটি একেবারে ছোট না। ৫০টি উপজেলা থাকবে, ২০টি জেলা ও পাঁচটি মেডিকেল কলেজ থাকবে। এ নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি। চিকিৎসকরা কোথায় বসবেন, তাদের ফি কত হবে এবং কারা কারা রোগী দেখবেন, কতক্ষণ দেখবেন— সব বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে, টিম গঠন করে দেওয়া হয়েছে।’
বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত অর্থ আদায় প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ক্যাটাগরি অনুযায়ী চিকিৎসার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে, তারা কাজ করছে। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে কার্যকর হবে।’
‘দেশের একেক (বেসরকারি) হাসপাতাল ও অন্যান্য সেবা খাতের একেক রকমের চার্জ। ভিন্ন ভিন্ন টেস্ট ফি সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারিভাবে একটি গাইডলাইন তৈরি করে হাসপাতালগুলোর মান অনুযায়ী ক্যাটাগরি তৈরি করে দিয়ে সেই ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এ সংক্রান্ত একটি কমিটি করে এক মাসের মধ্যেই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হব আমরা। এতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাবে, যত্রতত্র ফি দিয়ে দেশের জনগণের অযাচিত অর্থ ব্যয় হবে না।’
ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের নীতিমালা প্রণয়নে বিভিন্ন সুপারিশ
গত ২২ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়ে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ১৭ জানুয়ারি ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস নীতিমালা প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করে কতিপয় সুপারিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। সুপারিশে শূন্য পদসমূহ পূরণ করা, ল্যাবরেটরি সার্ভিস উন্নত করা, যেসব চিকিৎসক ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস করবেন তাদের ইনসেনটিভ প্রদানের ব্যবস্থা করা, সহায়ক কর্মকর্তা বিশেষ করে নার্স, কর্মচারীর শূন্য পদ পূরণসহ নানা পরামর্শ এসেছে।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, উন্নত দেশসমূহে বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্টগণ আউটডোরে রোগীর চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকাতেও অ্যাকাডেমিশিয়ানগণ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু হলে জনগণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা পাবেন। পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন- ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কীভাবে এ পদ্ধতি চলছে তা পর্যবেক্ষণ করে ধাপে ধাপে সরকারিভাবে মেডিকেল কলেজ এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন >> সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল নিজেই যেন ‘রোগী’
সুপারিশ-
>> ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস বাস্তবায়ন করতে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
>> বর্তমানে চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার কাজ যেভাবে চলছে তা কোনো ক্রমেই বিঘ্ন ঘটানো যাবে না।
>> প্রথমে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে শুধুমাত্র সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালু করা এবং এর অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীতে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা হাসপাতালে পর্যায়ক্রমে চালু করা যেতে পারে।
>> মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হতে অধ্যাপক পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক বৈকালিক রোস্টার চালু করা যেতে পারে।
>> ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের আয়-ব্যয়ের ক্ষমতা স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর অবশ্যই ন্যস্ত থাকবে। যা একটি নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। বৈকালিক প্র্যাকটিস করার জন্য বহির্বিভাগে রোগী দেখা ও বসার স্থান আধুনিকায়ন করতে হবে। রোস্টার করে নার্স ও সহায়ক জনবলের দায়িত্ব দিতে হবে এবং এ জন্য উৎসাহ ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।
>> বিকেলের রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্রুততম করা এবং দ্রুততম সময়ে রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
>> বৈকালিক রোগীদের ভর্তির জন্য পৃথক বিছানা বরাদ্দ ও অপারেশন থিয়েটার চালু করা যেতে পারে।
>> ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস থেকে যা আয় হবে তা থেকে ১০ শতাংশ আয়কর প্রদান-সাপেক্ষে ৬০ শতাংশ কনসালটেন্ট ও ৪০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা সহায়তাকারীদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে আর্থিক ও আইনগত বিষয় বিবেচনা করে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আরও পড়ুন >> ‘অটো পাস’ ‘কোভিড ব্যাচ’ বলে শিশুর ক্ষতি করছেন না তো?
>> ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসরত কনসালটেন্টগণ জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সহযোগিতা করবেন এবং বৈকালিক শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কনসালটেন্টদের পরিবহন সুবিধা দিতে হবে।
>> নতুন নিয়োগকৃত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের ব্যাপারে অঙ্গীকারনামা নেওয়া যেতে পারে। অংশগ্রহণকারী চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে আচরণগত যেন কোনো অসন্তোষ বিরাজ না করে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
>> ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস সফল করতে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও আর্থিক সঙ্গতির কথা বিবেচনা করে সময় নিয়ে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস পর্যায়ক্রমে চালু করা যেতে পারে।
>> উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে টারশিয়ারি লেভেলের (তৃতীয় পর্যায়ের) হাসপাতাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
টিআই/এমএআর/