‘ভুয়া’ সনদে ৪৭ কোটি টাকার কাজ ঠিকাদারের পকেটে!
• আপনি যাচাই-বাছাই করুন : অভিযুক্ত ঠিকাদার
• সনদ যাচাই এক্সিয়েন করেছেন : প্রকল্প পরিচালক
• আমার স্বাক্ষর জাল করেছের : সাবেক এক্সিয়েন
• ভুয়া সনদ ব্যবহার আইনের ৬৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ
• জড়িতদের বিরুদ্ধে হতে পারে বিভাগীয় মামলা
বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে ভুয়া সনদে ৪৭ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এম এস জিলানী ট্রেডার্স নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও এস্টিমেটরের (মূল্যনির্ধারক) বিরুদ্ধে নয়-ছয়েরও অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ‘৩০ পৌরসভায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রজেক্ট’-এ এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রকল্প পরিচালক মো. মীর শহীদ ও এস্টিমেটর মো. মনির হোসেনের মদদে কুমিল্লা ও জয়পুরহাটের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিলানী ট্রেডার্স। কাজ নেওয়ার জন্য তারা যে সার্টিফিকেট দেখিয়েছে তা ছিল ভুয়া।
দুটি টেন্ডারে মোট ৪৭ কোটি টাকার কাজ নিয়েছে এম এস জিলানী ট্রেডার্স। অভিযোগ উঠেছে, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১০ পার্সেন্ট (শতাংশ) বেশিতে কাজ পাইয়ে দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুই পার্সেন্ট কমিশন নিয়েছেন পিডি ও স্টিমেটর।
দুটি টেন্ডারে মোট ৪৭ কোটি টাকার কাজ নিয়েছে এম এস জিলানী ট্রেডার্স। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১০ পার্সেন্ট (শতাংশ) বেশিতে কাজ পাইয়ে দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুই পার্সেন্ট কমিশন নিয়েছেন পিডি ও স্টিমেটর।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ওই জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়ে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন মো. নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। সেই চিঠির একটি কপি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।
আরও পড়ুন >> অনিয়ম রোধের দায়িত্ব যার, তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ!
এ বিষয়ে খোঁজ রাখা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিকল্পিতভাবে কাজ দুটি জিলানী ট্রেডার্সকে দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। সহযোগিতা করেছেন স্টিমেটর মো. মনির হোসেন। জিলানী ঠিকাদার যে সনদে কাজ পেয়েছে সেটিও এক এক্সিয়েনের সই নকল করে সাবমিট করা হয়েছে।
প্রকল্পের কুমিল্লা ও জয়পুরহাটের কাজ দুটি পেতে নিয়ম অনুযায়ী জিলানী ট্রেডার্সকে কমপ্লিশন সার্টিফিকেট (কাজের সমাপনী সনদ) দাখিলের কথা থাকলেও তিনি জমা দেন বরগুনা পৌরসভার কাজের একটি ‘এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট’ (অভিজ্ঞতা সনদ)। যদিও বরগুনা পৌরসভার তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (এক্সিয়েন) এ টি এম মহিউদ্দিন খোন্দকার ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামানের সই করা ওই অভিজ্ঞতা সার্টিফিকেটটি ‘ভুয়া’ বলে জানা গেছে।
‘এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট’ নামে যে ডকুমেন্ট জিলানী ট্রেডার্স জমা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য এটি চাওয়া হয়নি। এখানে চাওয়া হয় ‘কমপ্লিশন সার্টিফিকেট’। অর্থাৎ কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার পর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যে সার্টিফিকেট দেয় সেটি চাওয়া হয়। ওই সার্টিফিকৈটে অন্তত পাঁচজনের সই লাগে। জিলানী ট্রেডার্স-এর পক্ষে উপস্থাপিত সার্টিফিকেটে মাত্র দুজনের সই ছিল।
কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে জিলানী ট্রেডার্সের এ ধরনের ছলচাতুরি জ্ঞাতসারেই চেপে গেছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ১০ পার্সেন্ট (শতাংশ) বেশি মূল্যে কাজ দেওয়া হয়েছে, যা প্রকিউরমেন্ট বিধির সরাসরি লঙ্ঘন।
সিপিটিইউয়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে যা বলা হয়েছে
২০২০ সালের ২ মার্চ ‘৩০ পৌরসভায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রজেক্ট’-এর কুমিল্লা বিভাগের দরপত্র আহ্বান করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (আইডি নং- ৪২৬৪২১)।
এ দরপত্রে কাজ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একক কাজ হিসেবে ১৫ কোটি টাকার ‘পাইপড ওয়াটার স্কিম’ সম্পাদনের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় অথবা দুই কন্ট্রাক্টে ১০ কোটি টাকার ‘পাইপড ওয়াটার স্কিম’ কাজের অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিলানী যদি ২০২০ সালের নভেম্বরে কমপ্লেশন সার্টিফিকেট পেয়ে থাকে, তাহলে ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারির টেন্ডারে কিভাবে কাজ পেল। এছাড়া ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির টেন্ডারে দাখিল করা ২০১৯ সালের ১০ জুনের সার্টিফিকেটটি কোথা থেকে পেল জিলানী ঠিকাদার
২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি প্রকল্পের জয়পুরহাট বিভাগের কাজের দরপত্র আহ্বান করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (আইডি নং- ৪০৮৯৬৯)।
এখানেও একক কাজ হিসেবে ১০ কোটি টাকার ‘পাইপড ওয়াটার স্কিম’ কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় অথবা দুই কন্ট্রাক্টে সাত কোটি টাকার ‘পাইপড ওয়াটার স্কিম’ কাজের অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়।
আরও পড়ুন >> নিজের লাভ হবে, তাই বিমানকে লোকসানে ফেললেন কর্মকর্তা
দরপত্রে অংশ নিয়ে মেসার্স জিলানী ট্রেডার্স কুমিল্লা ও জয়পুরহাটের কাজ দুটি পায়। কিন্তু কাজের জন্য জমা দেওয়া সার্টিফিকেটে চাহিদা অনুযায়ী অভিজ্ঞতা ছিল না। একইসঙ্গে যে কাজের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে ওই কাজটিও দরপত্র আহ্বানের সময় সমাপ্ত হয়নি।
টেন্ডার আহ্বান করার সময় যে সার্টিফিকেট আপলোড করা হয় সেটির কমপ্লিশন সময় দেওয়া ছিল ২০১৯ সালের ১০ জুন। পরবর্তীতে সেই সার্টিফিকেট পরিবর্তন করা হয়। পরে জমা দেওয়া সনদে কমপ্লিশন সময় দেওয়া আছে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর।
অর্থাৎ অভিজ্ঞতা হিসেবে যে কাজের সার্টিফিকেট জমা দেওয়া হয়েছে সেটি শেষ হয় দরপত্র আহ্বানের ১১ মাস পর।
এছাড়া জিলানীর আপলোড করা সার্টিফিকেটটি ‘পাইপড ওয়াটার স্কিম’ কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয়। এতে উল্লেখ আছে, ওভার হেড ট্যাংক ৬.১০ কোটি এবং এইচডিপি পাইপ লাইন ১১.০১ কোটি। এ হিসাবে কাজটি নন-রেসপনসিভ হয়।
সিপিটিইউতে পাঠানো চিঠিতে মো. নুরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, জিলানী ট্রেডার্সের জমা দেওয়া সার্টিফিকেটটি ভুয়া। ‘বানোয়াট’ সার্টিফিকেট দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে প্রকৃত ঠিকাদারকে কাজ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দরপত্র দুটি বাতিল করে জিলানী ট্রেডার্সের লাইসেন্স কালো তালিকাভুক্তির অনুরোধ করেন তিনি।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে
২০২০ সালের ২ মার্চ কুমিল্লা জেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতাধীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদুজ্জান ৩০ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করেন। কুমিল্লার ওই দরপত্রে একক কাজ হিসেবে ১৫ কোটি টাকা অথবা দুই কন্ট্রাকে ১০ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। কিন্তু কুমিল্লার কাজে সাবমিট করা সার্টিফিকেটে চাহিদা অনুযায়ী অভিজ্ঞতা ছিল না জিলানী ট্রেডার্সের।
যে সার্টিফিকেট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জমা দিয়েছিল সেটি বরগুনা পৌরসভায় কাজের অভিজ্ঞতার। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরগুনা পৌরসভার তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এ টি এম মহিউদ্দিন খন্দকার। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি নির্বাহী প্রকৌশলীর সই করা যে সার্টিফিকেট দাখিল করেছিল সেটি ভুয়া।
ঢাকা পোস্টের কাছেও ভুয়া এবং আসল সার্টিফিকেটের নথি এসেছে। সেখানে দেখা যায়, টেন্ডার আহ্বান করার সময় জিলানী ট্রেডার্সের যে সার্টিফিকেট আপলোড করা হয়েছিল সেটির কমপ্লিশন তারিখ দেওয়া ছিল ২০১৯ সালের ১০ জুন। সেখানে দুইজনের সই ছিল।
আর আসল সার্টিফিকেটে কমপ্লিশন তারিখ দেওয়া আছে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর। সেটিতে বরগুনা পৌরসভার মেয়র, তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ পাঁচজনের সই আছে।
অর্থাৎ জিলানী ট্রেডার্সের সাবমিট করা সার্টিফিকেটটি নকল বা ভুয়া ছিল।
এছাড়া ২০১৯ সালের সার্টিফিকেটে যে নির্বাহী প্রকৌশলীর সই ছিল, সেটি ভুয়া বলে ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন বরগুনা পৌরসভার তখনকার নির্বাহী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন খন্দকার। তিনি জানান, ওই সার্টিফিকেটটি আগের কোনো সার্টিফিকেট থেকে স্ক্যান করে বানানো।
আরও পড়ুন >> ঢাকা ওয়াসায় সমিতির ৩৫৫ কোটি টাকা নয়-ছয়!
এসব অভিযোগের বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিলানী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী কাজী মুহাম্মদ জিলানী হকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে কীভাবে কাজ পেয়েছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নটা আমি আপনাকেও করতে পারি। আমি কীভাবে কাজ পেলাম? আপনি যে ভুয়া বললেন, কীসের ভিত্তিতে? আমার সার্টিফিকেট যে প্রতিষ্ঠান ইস্যু করছে, আপনি সার্টিফিকেট নিয়ে সেখানে যান। তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন। আপনি আগে তদন্ত করে দেখুন। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতেই পারে। আমিও আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারি। কিন্তু এটা বললে তো হবে না। সিপিটিইউতে যে অভিযোগ আছে চাইলে সেটি তারা তদন্ত করে দেখতে পারে।’
নিজের সার্টিফিকেট সঠিক দাবি করে তিনি বলেন, ‘সার্টিফিকেট তো আমি দিইনি। সার্টিফিকেট যেহেতু প্রতিষ্ঠান দিয়েছে, সেহেতু সঠিক।’
এ বিষয়ে বরগুনা পৌরসভার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এ টি এম মহিউদ্দিন খন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি চাকরি থেকে অবসরে চলে এসেছি। আমার শরীরটাও ভালো নয়। আপনার পাঠানো সার্টিফিকেটটি আমি দেখেছি। সেখানে লেখা আছে এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট। এটা সম্ভবত স্ক্যান করা কপি। আপনি দেখেন, স্মারক নম্বরে অবলিক দিয়ে ওয়ান লাগানো। আমি এটাতে সই করিনি। ২০১৯ সালের সার্টিফিকেট স্ক্যান করে আমার সই নকল করা হয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে স্মারক নম্বরে অবলিক দিয়ে কখনও ওয়ান হয় না। কপি দিলে অবলিক দিয়ে স্মারক নম্বর হয়।’
‘দ্বিতীয় বিষয় হলো ওই সার্টিফিকেটের হেডলাইনে লেখা এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেট। কিন্তু আমরা যেটা দিয়েছি সেটাতে লেখা আছে কমপ্লিশন সার্টিফিকেট। কমপ্লিশন সার্টিফিকেট শত ভাগ ঠিক আছে। আগে যেটা দেখানো হয়েছে সেটা সম্ভবত স্ক্যান করা কপি। আমি আমার উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করেছি। উনি জানালেন, এটা সম্ভবত স্ক্যান করে সই নকল করা হয়েছে। আমি এক্সপেরিয়েন্স সার্টিফিকেটে কোনো সই করিনি, এটা নিশ্চিত।’
‘সার্টিফিকেট যাচাই করা ছাড়া কাজ দেওয়া সম্ভব নয়। যদি সন্দেহ হয়, তাহলে অবশ্যই লোক পাঠিয়ে যাচাই করতে হয়। বড় কাজ হলে যে অফিস থেকে ঠিকাদারের অভিজ্ঞতার সনদ দেয়, প্রয়োজনে সেই অফিসে লোক পাঠিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করে নিতে হয়। আর ভুয়া সার্টিফিকেটে যে তারিখ দেখানো হয়েছে আমি সেসময় মাত্র জয়েন করেছিলাম বরগুনাতে। ওই সময় তৎকালীন কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলীও আমার কাছে কোনো লোক পাঠাননি।’
‘প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকল্প পরিচালক ওই সার্টিফিকেটে কীভাবে কাজ দিলেন? তাদের তো সন্দেহ হওয়ার কথা ছিল। সন্দেহ হলে আমার কাছে লোক পাঠানোর কথা ছিল’— যোগ করেন সাবেক এ নির্বাহী প্রকৌশলী।
ওই সময়ে কুমিল্লাতে টেন্ডারটি আহ্বান করেন নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদুজ্জামান। বর্তমানে তিনি মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তাকে টানা দুদিন ফোন দিলেও পাওয়া যায়নি। তবে, তিনদিনের মাথায় ফোন রিসিভ করলেও টেন্ডারটির বিস্তারিত শুনে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি। পরে ফোন দিচ্ছি।’
এরপর তাকে ফোন দিয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালকের ব্যাখ্যা
অসদুপায়ে জিলানী ট্রেডার্সকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন প্রকল্প পরিচালক মীর শহীদ। সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তরও দেন তিনি।
আপনাদের চাহিদা অনুযায়ী কাজের অভিজ্ঞতা জিলানী ট্রেডার্সের ছিল কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক মীর শহীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ওই কাজ দুটির জন্য যে অভিজ্ঞতা চেয়েছিলাম ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি সেই অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দিয়েছিল। তাছাড়া, ওই সময়ে কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী জিলানী ট্রেডার্সের সার্টিফিকেট ভেরিফাই (যাচাই) করে আমাদের দিয়েছিল। আমরা যাচাই-বাছাইয়ের পর চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এলজিইডি মন্ত্রীর মাধ্যমে এর অনুমোদন হয়েছে। ওই সময় যদি কেউ আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে জানাত, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এখন তিন বছর পর আমরা কী করতে পারি? ওই সময় অভিযোগ আসলে আমরা আরও ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে পারতাম। এখন অভিযোগ আসলে আমরা কী করব? জিলানী আমাদের রিকোয়ারমেন্ট ফুলফিল করেছে বলেই আমরা সেটাকে ফরোয়ার্ড করেছি।’
‘আপনি দুই পারসেন্ট কমিশনে কাজ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে’— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বুঝলাম না তো! দুই পারসেন্ট নিয়েছি, সেটা মুখে বললেই তো হলো না। আমাদের যে রিকোয়ারমেন্ট ছিল সে অনুযায়ী আমরা সার্টিফিকেট পেয়েছি। পরবর্তীতে আমার কাছে কেউ কেউ অভিযোগ করেছে, জিলানীর ওই সার্টিফিকেট নাকি রানিং বিল ছিল। এটা আমার জানার বিষয় নয়, এটা রানিং বিল নাকি চূড়ান্ত বিল। তাছাড়া, আমি বাস্তবে তো আর সার্টিফিকেট যাচাই করতে যাইনি। যে সার্টিফিকেট আমাদের দেওয়া হয়েছিল সেটা যদি সংশ্লিষ্ট পৌরসভা ভুল দেয় তাহলে তো আমাদের কিছুই করার থাকে না। ওই সময় কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন করে সঠিক পেয়েছিল। এ কারণে আমাদের কাছে ফরোয়ার্ড করেছিল। আমরা নির্বাহী প্রকৌশলীর মূল্যায়ন প্রতিবেদনটা ঠিক মনে করে প্রধান প্রকৌশলী ও মন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছিলাম।’
১০ পারসেন্ট বেশিতে জিলানী ট্রেডার্স কীভাবে কাজ পেল— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী ‘এবোভ’ ও ‘লেস’-এ কাজ দেওয়ার বিধান রয়েছে। টেন্ডার ও রি-টেন্ডার করতে গেলে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ ছাড়া করা যায় না। আর যিনি টেন্ডার করেন সবকিছুর দায়িত্বও তার।’
আরও পড়ুন >> টাকা-উপহারে ‘বিক্রি হচ্ছেন’ চিকিৎসক, বাড়ছে ব্যয়!
ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে একইসঙ্গে কুমিল্লা ও জয়পুরহাটের একই ধরনের কাজ পাওয়ার অভিযোগ একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিষয়টি পরিকল্পিত কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে পিডি বলেন অন্যকিছু, ‘এখনও আমাদের দৃষ্টিতে ভুয়া কিছু দেখিনি এবং বাস্তবে ফিল্ডে কী কাজ হয়েছে বা না হয়েছে, এটা আপনি ফিল্ড যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারেন। পিপিআর ও বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন ফলো করেই কাজ করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে সিপিটিইউয়ের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মাসুদ আকতার খানকে ফোন দিলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার ডিজি স্যার বলতে পারবেন। আপনি ওনাকে ফোন দিন।’
সিপিটিইউয়ের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. শোহেলের রহমান চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
কোনো ঠিকাদার যদি ভুয়া সনদে কাজ পেয়ে থাকেন, তাহলে প্রকিউরমেন্ট আইন অনুযায়ী তার কী ধরনের শাস্তি হতে পারে— জানতে চেয়েছিলাম সিপিটিইউয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. ফারুক হোসেনের কাছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এটা প্রকিউরমেন্ট আইনের ৬৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ। এ অপরাধের দায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারিত (নিষিদ্ধ) বা ডেফার্ড (স্থগিত) করা যেতে পারে। বারিত করলে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।’
প্রকল্প কর্তৃপক্ষের যদি কেউ জড়িত থাকে তাহলে তাদের ক্ষেত্রে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারের ভুয়া সার্টিফিকেট যদি মূল্যায়ন কমিটি যাচাই করতে না পারে তাহলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেতে পারে। আইনে বলা আছে, সেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হতে পারে। আবার মামলা দুদকে হস্তান্তর করাও যেতে পারে।’
প্রসঙ্গত, পৌর এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সুবিধা দিতে ‘৩০ পৌরসভায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন’ নামের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। পৌরসভার সক্ষমতা বাড়ানোর এ প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের ১০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়। এর মাধ্যমে ছোট ছোট শহরের ছয় লাখ মানুষের নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার কথা।
এসআর/এমজে/এমএআর/