ঘুষ নিলেন, ভুক্তভোগীকে মামলায়ও ফাঁসালেন তিনি!
ব্রিজের অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণে মুনজুর আলীর ৪৫ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। স্বাভাবিক নিয়মে তার ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার (জরিপকারক) মুহাম্মদ সেরাজুল ইসলাম। ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে হলে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হবে তাকে!
অন্য কোনো উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত মুনজুর আলী সেরাজুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সফিকুল ইসলামের কথায় ১৫ শতাংশ কমিশনের টাকা দিতে রাজি হন। এরপরও ক্ষতিপূরণের টাকা মেলেনি। ক্ষতিপূরণের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর কমিশনের রেট ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ শতাংশে।
জমি অধিগ্রহণের মোট ক্ষতিপূরণ ২০ লাখ ৫৫ হাজার টাকার ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় লাখ টাকা দিতে হয় সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামকে। শুধু মুনজুর আলী নন, ক্ষতিগ্রস্ত অপর জমির মালিক সফিকুল ইসলামও সেরাজুল ইসলামের অনৈতিক অর্থ আদায়ের শিকার হন। তাকেও ছয় লাখ টাকা ঘুষ পরিশোধ করতে হয় ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে। এখানেই শেষ নয়
মোট ক্ষতিপূরণ ২০ লাখ ৫৫ হাজার টাকার ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় লাখ টাকা দিয়ে মেলে সেই অর্থ। শুধু মুনজুর আলী নন, ক্ষতিগ্রস্ত অপর জমির মালিক সফিকুল ইসলামও সেরাজুল ইসলামের অনৈতিক অর্থ আদায়ের শিকার হন। তাকেও ছয় লাখ টাকা ঘুষ পরিশোধ করতে হয় ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে। এখানেই শেষ নয়।
আরও পড়ুন >> কলেজ করণিকের হিসাবে ২৪ কোটি টাকা!
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় একই প্রকল্পের ভুক্তভোগী মুনজুর আলীর আরও ছয় শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ক্ষতিপূরণবাবদ তিন লাখ ৫৭ হাজার ২৪ টাকার চেক পান তিনি। এখানেও সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম ৩০ শতাংশ কমিশনবাবদ এক লাখ টাকা দাবি করে বসেন। কিন্তু এবার ঘুষ দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন মুনজুর আলী। সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি ও গ্রহণের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন।
শুরু হয় সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামের কূট কৌশল। ঘুষ লেনদেনের সময় সাদা কাগজে মুনজুর আলীর দেওয়া স্বাক্ষর কাজে লাগিয়ে সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম ছোট ভাই আতিকুর রহমানকে বাদী সাজিয়ে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। শুধু মামলা নয় নানা ধরনের ভয়ভীতি ও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে সেরাজুল ইসলাম ভুক্তভোগী মুনজুর আলীর মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করান।
মামলা প্রত্যাহার হলেও শেষ রক্ষা হয়নি সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামের। ধরা পড়েন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে। দুদকের নিজস্ব অনুসন্ধান ও তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রকৃত ঘটনা। তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক দেবব্রত মন্ডল উন্মোচন করেন ঘটনার পেছনের রহস্য। তথ্য-প্রমাণ মেলায় ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। গত ১৬ অক্টোবর চার্জশিটের (অভিযোগপত্র) অনুমোদন দেয় কমিশন।
ঘুষ লেনদেনের সময় সাদা কাগজে মুনজুর আলীর দেওয়া স্বাক্ষর কাজে লাগিয়ে সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম ছোট ভাই আতিকুর রহমানকে বাদী সাজিয়ে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলা দায়ের করেন। শুধু মামলা নয় নানা ধরনের ভয়ভীতি ও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে সেরাজুল ইসলাম ভুক্তভোগী মুনজুর আলীর মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করান
চার্জশিটে সেরাজুল ইসলামের পাশাপাশি আসামি করা হয়েছে তার ছোট ভাই আতিকুর রহমান, তার সিন্ডিকেটের সহযোগী মো. সফিকুল ইসলাম ওরফে রিপন এবং তার ভাই ফরকানুল আলমকে। শিগগিরই চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক ও তদন্ত কর্মকর্তা দেবব্রত মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্তে সত্যতা মেলায় অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে চার্জশিটের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। শিগগিরই তা আদালতে জমা দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন >> দেশে এত দুর্নীতি কেন?
অন্যদিকে, সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম সব অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে কোনো ঘুষ নিইনি। মুনজুর আলী ও তার আত্মীয়দের মধ্যে কলহ ছিল। সে কারণে কিছুদিন টাকা আমার কাছে ছিল। আমি কোনো ঘুষ নিইনি।
ছোট ভাইয়ের দায়ের করা মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। কিন্তু ফেরত দেয়নি। এ কারণে মামলা করেছে। মামলার সঙ্গে ওই ঘটনার কোনো যোগসূত্র নেই।’
যেখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বরিশাল জেলার গ্রামীণ যোগাযোগ ও হাট-বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন (বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা ও ঝালকাঠি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাকেরগঞ্জ উপজেলার গারুরিয়া-গোবিন্দপুর রাস্তায় ১১৫৩ মিটার চেইনগেজে তুলাতুলি নদীর ওপর ৪৪০ মিটার দীর্ঘ পিসি গার্ডার ব্রিজের অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ওই অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণে এলাকার বাসিন্দা মো. মুনজুর আলী হাওলাদার ও তার স্ত্রী তহমিনা বেগমের ৪৫ শতাংশ জমি এবং তাদের আত্মীয় সফিকুল ইসলামেরও ৪৫ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জমি অধিগ্রহণ কাজের দায়িত্বে ছিলেন বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মো. সেরাজুল ইসলামের ওপর। কাজের সূত্র ধরে সফিকুল ইসলাম ও মুনজুর আলীর সঙ্গে সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামের পরিচয় হয়। সেরাজুল ইসলাম তখন মুনজুর আলীকে জানান, অধিগ্রহণের সব কাজ তিনি করে দেবেন। বিনিময়ে তাকে প্রাপ্ত অর্থের ১৫ শতাংশ দিতে হবে। ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার অন্য কোনো উপায় না থাকায় তিনি সেরাজুল ইসলামের শর্তে রাজি হন।
আরও পড়ুন >> দর-কষাকষি করে ঘুষ নেন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, ভিডিও ভাইরাল
সার্ভেয়ার সিরাজুল ইসলাম মুনজুর আলীর সব রেকর্ডপত্র নেন। বিভিন্ন কাগজে তার স্বাক্ষরও নেন। এরপর শুরু হয় তার অনৈতিক কর্মকাণ্ড!
মুনজুর আলী হাওলাদারের মালিকানাধীন ৪৫ শতক জমির ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ২০ লাখ ৫৫ হাজার ৬৪৫ টাকা। যেখানে ২ শতাংশ হারে উৎসে কর আসে ৪১ হাজার ১১৩ টাকা। তাহলে প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ লাখ ১৪ হাজার ৫৩২ টাকা। প্রাপ্য অনুসারে চেকও (চেক নং- ০০১০৬৩ ও এল এ চেক নং- ০০১০৬৪) তৈরি হয়। এরপরই সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম ক্ষতিপূরণবাবদ প্রাপ্য অর্থের ৩০ শতাংশ দাবি করেন। ওই অর্থ না দিলে চেক দেবেন না বলে জানান।
আরও পড়ুন >> দুদকের দৃষ্টিতে সব দুর্নীতিবাজই সমান, প্রভাবশালী কেউ নয়
বাধ্য হয়ে সেরাজুল ইসলামের কথায় রাজি হয়ে চেক গ্রহণ করেন মুনজুর আলী। বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের বরিশাল শাখায় মুনজুর আলীর হিসাবে ২০১৬ সালের ৮ জুলাই পিতার সম্পত্তি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা জমা হয়। পরে সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম নগদে ছয় লাখ টাকা গ্রহণ করেন। বাকি টাকা ওই বছরের ১৪ জুলাই মুনজুর আলীর বাকেরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে (হিসাব নং- ০৩০২১০০০১৬৩৯০) জমা হয়।
একইভাবে ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া অপর জমির মালিক সফিকুল ইসলামের কাছ থেকেও ঘুষ হিসাবে ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেন সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম।
সেরাজুলের কূট কৌশল
ভুক্তভোগী মুনজুর আলী হাওলাদার ও তার স্ত্রী তহমিনা বেগমের মালিকানাধীন বাকেরগঞ্জ থানার চর রঙ্গশী মৌজায় একই প্রকল্পের আরও ছয় শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমির ক্ষতিপূরণবাবদ মুনজুর আলী তিন লাখ ৫৭ হাজার ২৪ টাকার চেক পান। সেখানেও সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম ৩০ শতাংশ হিসাবে এক লাখ টাকা দাবি করেন। এবার মুনজুর আলী ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু সেরাজুল ইসলাম ও সফিকুল ইসলাম চাপ সৃষ্টি করেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে মুনজুর আলী সেরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ আদালতে নালিশি দরখাস্ত ( নং- ৭৬/২০১৮) বা মামলা দায়ের করেন। এরপর সেরাজুল মুনজুর আলীকে আপসের জন্য বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো শুরু করেন।
ভয়ভীতিতে কাজ না হওয়ায় সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলাম তার আপন ছোট ভাই মো. আতিকুর রহমানকে বাদী সাজিয়ে মুনজুর আলীর বিরুদ্ধে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০১৮ সালের ১৭ মে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় সাক্ষী করা হয় সফিকুল ইসলামকে।
মামলায় যা উল্লেখ আছে
মামলার বিবরণে বলা হয়, মুনজুর আলী ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে সেরাজুল ইসলামের ছোট ভাই আতিকুর রহমানের নিকট হতে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা ধার হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু টাকা গ্রহণের পর পরবর্তীতে বিষয়টি অস্বীকার করেন মুনজুর আলী।
আরও পড়ুন >> ঢাকায় ৯ ফ্ল্যাট ২ প্লট পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালকের
সাজানো মামলার পর মুনজুর আলী সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন। মুনজুর আলী ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সেরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে বরিশাল জজ আদালতে নালিশি দরখাস্ত প্রত্যাহারের আবেদন করেন। আতিকুর রহমানও ওই বছরের ১৩ মার্চ আদালতে গিয়ে মুনজুর আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেন।
দুদকের তদন্তে যা মিলল
মুনজুর আলীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার হলেও এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। ওই মামলার সূত্র ধরে দুদকের তদন্ত শুরু হয়। তদন্তকালে সিরাজুল ইসলামের ভাই আতিকুর রহমানের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। তিনি সাড়ে চার লাখ টাকার কোনো উৎস প্রদর্শন করতে পারেননি। তিনি চাকরি থেকে ওই অর্থ আয় করেছেন বলে দাবি করলেও চাকরির নিয়োগ বা যোগদানসংশ্লিষ্ট কোনো রেকর্ডপত্র, আইডি কার্ড, ব্যাংক হিসাব-বিবরণী— কিছুই দুদককে দেখাতে পারেননি। ফলে মুনজুর আলীর বিরুদ্ধে তার আনা অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগ সত্য নয় বলে দুদকের কাছে প্রমাণিত হয়।
আসামি সফিকুল ইসলাম ও তার আপন ভাই ফোরকানুল আলম এবং সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামের ব্যাংক হিসাবের তথ্য যাচাই করে ঘুষের টাকার লেনদেনের প্রকৃত তথ্য বের করে আনেন তদন্ত কর্মকর্তা। ঘুষ গ্রহণ ও সহযোগিতার অভিযোগ এনে দণ্ডবিধি ১৬১, ১৬৫ (ক) ও ৪২০ সহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে চার্জশিটের অনুমোদন দেয় দুদক
ভূমি অধিগ্রহণের সময় সেরাজুল ইসলাম প্রতারণার মাধ্যমে স্ট্যাম্পে মুনজুর আলীর স্বাক্ষর রেখে দেন। পরে সেটি ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন— এমন তথ্য বেরিয়ে আসে দুদকের তদন্তে।
আরও পড়ুন >> ঘুষসহ শিক্ষা কর্মকর্তাকে ধরিয়ে দিয়ে বিপাকে অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষিকা
অন্যদিকে, আসামি সফিকুল ইসলাম ও তার আপন ভাই ফোরকানুল আলম এবং সার্ভেয়ার সেরাজুল ইসলামের ব্যাংক হিসাবের তথ্য যাচাই করে ঘুষের টাকার লেনদেনের প্রকৃত তথ্য বের করে আনেন তদন্ত কর্মকর্তা। ঘুষ গ্রহণ ও সহযোগিতার অভিযোগ এনে দণ্ডবিধি ১৬১, ১৬৫ (ক) ও ৪২০ সহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে চার্জশিটের অনুমোদন দেয় দুদক।
আরএম/এমএআর/