দুবাইয়ে বাংলাদেশি তরুণীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করছেন যারা
তাদের কেউ জেনে, না জেনে; আবার কেউ লোভ সামলাতে না পেরে এখানে এসেছেন। এসে দেখেন অন্ধকার জগৎ। না পারছেন সইতে, না পারছেন দেশে ফিরতে। বাধ্য হয়ে থেকে যাচ্ছেন অন্ধকার জগতে। এমন ১৫০০ বাংলাদেশি তরুণী বর্তমানে অবস্থান করছেন গ্ল্যামারাস আর ধনীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহর দুবাইয়ে।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) অন্ধকার জগতে বিচরণ করা কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণীর সঙ্গে। তাদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। ‘মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ পরিবেশনের নামে বাংলাদেশি এসব মেয়েকে দুবাই আসতে প্রলুব্ধ করা হয়। দেওয়া হয় আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ফিকে হতে বেশি সময় লাগে না। নাচের নামে তাদের কাজের সুযোগ হয় ড্যান্স বারে। কেউ কেউ সুযোগ পান ওয়েটার বারে অথবা ম্যাসাজ সেন্টারে। দিন শেষে তাদের ভাগ্যে নেমে আসে ভয়াল কালরাত।
দুবাইয়ে আটদিন অবস্থান করে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী বাংলাদেশি তরুণীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক। বাংলাদেশ থেকে কীভাবে মেয়েদের পাচার করে দুবাই আনা হয়, সেই প্রক্রিয়াসহ এর সঙ্গে কারা জড়িত; পাচারের পর বাংলাদেশি মেয়েদের কাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাদের দিয়ে কী কী কাজ করানো হয়, কাজ করতে না চাইলে কীভাবে নির্যাতন করা হয়—রোমহর্ষক সেসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা ফুটে উঠেছে ভুক্তভোগী, সংশ্লিষ্ট ব্রোকার (দালাল), দুবাইয়ে দীর্ঘদিন বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুখে। দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষটি।
পাচার ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে
ঢাকা পোস্টের দীর্ঘ অনুসন্ধানে দুবাইয়ে পাচার হওয়া কয়েকজন মেয়ে, হোটেল মালিক, ব্যবসায়ী, ব্রোকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনৈতিক এসব কর্মকাণ্ডের হোতা হিসেবে বাংলাদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ী তথা পাচারকারীর নাম জানা গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহিউদ্দিন। তিনি দুবাইয়ের পাম ডেরা হোটেল, সাপ্রান বুটিকম পনেসিয়া হোটেল এবং আবুধাবির হোটেল রিজেন্সির নিচে রেস্টুরেন্ট ভাড়া নিয়ে মুজরা পরিচালনা করছেন।
আরেকজন হলেন সজীব। তিনি দুবাইয়ের আল-রাজ, ডেরা ফরচুন, ফরচুন প্লাজা; ফুজিরা শহরের ক্লিপটন হোটেলে রেস্টুরেন্ট ভাড়া নিয়ে বাংলাদেশি মেয়েদের অনৈতিক কাজে লাগিয়েছেন।
তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহিউদ্দিন। তিনি দুবাইয়ের পাম ডেরা হোটেল, সাপ্রান বুটিকম পনেসিয়া হোটেল এবং আবুধাবির হোটেল রিজেন্সির নিচে রেস্টুরেন্ট ভাড়া নিয়ে মুজরা পরিচালনা করছেন
ব্যবসায়ী সেলিম দুবাইয়ে বেনতা নামের একটি হোটেলে এবং ওমান-ইউএই সীমান্তবর্তী হাত্তায় মুজরার আয়োজন করেন। এছাড়া তিনি আজমান শহরে রেডিসন ব্লু হোটেল, বৈশাখী; দুবাইয়ের ডেরায় ক্যালিফোর্নিয়া হোটেল এবং ইউএই’র রাসেল-কিমা শহরে বিন মুজিদ হোটেলে রেস্টুরেন্ট ভাড়া নিয়ে মুজরা পরিচালনা করছেন। সেলিমের অধীনে অন্তত ৭০ জন মেয়ে কাজ করছেন বলে জানা যায়।
দুবাইয়ে মেয়েদের নির্যাতন ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ওয়াসিম ও জসীম। তারা আপন দুই ভাই। তাদের অধীনে দুবাইয়ের প্যারিস হোটেল, রয়্যাল টোন হোটেল, ক্ল্যারিস হোটেল এবং আবুধাবির মিনা হোটেলে মুজরা অনুষ্ঠিত হয়।
দুবাইয়ে ওয়েটার বারের ডন বলা হয় বাংলাদেশের আক্তারকে। ওয়েটার বার বলতে যেসব বারে ওয়েটার (পরিচারক) হিসেবে বাংলাদেশি তরুণীরা কাজ করেন। এসব বারে আলাদা কেবিন থাকে। পরিবেশ থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন। আগতরা এখানে খুব সহজেই তরুণীদের সান্নিধ্য পান।
দুবাইয়ে মেয়েদের নির্যাতন ও পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ওয়াসিম ও জসীম। তারা আপন দুই ভাই। তাদের অধীনে দুবাইয়ের প্যারিস হোটেল, রয়্যাল টোন হোটেল, ক্ল্যারিস হোটেল এবং আবুধাবির মিনা হোটেলে মুজরা অনুষ্ঠিত হয়
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বাংলাদেশি লতিফ, সুরেশ ও পাভেল তরুণীদের নিয়ে দুবাই এবং শফি ইউএই’র রাসেল-কিমা নামের একটি শহরে মুজরাসহ নানা অপকর্ম চালান। এছাড়া সৈত্য নামে এক ভারতীয় আছেন। তিনিও বাংলাদেশি তরুণীদের নিয়ে বার চালান।
বাংলাদেশিদের বারে গ্রাহক যারা
পরিচয় গোপন রেখে বাংলাদেশি মালিকানাধীন বারগুলোতে আগতদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, এখানে আসা অধিকাংশই শারজাহ’র স্পেয়ার পার্টস ব্যবসায়ী, আবির ভেজিটেবল অ্যান্ড ফ্রুটস মার্কেটের ব্যবসায়ী, চায়না মার্কেটের ব্যবসায়ী, ডেরা দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী, অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং দুবাইয়ের সরকারি দফতরে নানা পদে কর্মরত চাকরিজীবীরা।
সেনা সদস্যের গৃহকর্মীরও ভুয়া ভিসা
দুবাইয়ে বাংলাদেশি তরুণীদের পাচারের দ্বিতীয় কৌশল হচ্ছে ভুয়া গৃহকর্মী ভিসা। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে তরুণীদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগের সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এ সুযোগে কিছু দালাল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণীদের ‘গৃহকর্মী ভিসা’ দেওয়ার কথা বলে দুবাই নিয়ে আসেন। অথচ ‘গৃহকর্মী’ নামে পাঠানো ভিসাগুলো ট্যুরিস্ট বা ভিজিট ভিসা, যা এয়ারপোর্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
আছে বিউটিশিয়ান ভিসা
দুবাইয়ে বাংলাদেশি তরুণীদের পাচারের তৃতীয় কৌশল হচ্ছে বিউটিশিয়ান ভিসা। এক্ষেত্রেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বাছাই করা হয়। ‘উপজাতি’ মেয়েরা এ কাজে বেশি যান। দেশের অধিকাংশ বিউটি পার্লারে উপজাতি মেয়েরা বেশি চাকরি করেন। সেখান থেকে ‘বেশি অর্থ রোজগারের’ প্রলোভন দেখিয়ে তাদের টার্গেট করা হয়।
চেহারা ও শারীরিক গঠন প্রায় একই হওয়ায় চীনা ও কোরিয়ান পর্যটকরা এসব মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। দুবাই নিয়ে তাদের প্রথমে বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের পার্লারের ঠিক পেছনে আলো-আঁধারের ম্যাসাজ সেন্টারে পাঠানো হয়। জোরপূর্বক তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন মালিকরা। দুবাইয়ের অধিকাংশ ম্যাসাজ পার্লারের মালিক বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা
বাংলাদেশি দালাল
এমন একজন দালাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চেহারা ও শারীরিক গঠন প্রায় একই হওয়ায় চীনা ও কোরিয়ান পর্যটকরা এসব মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। দুবাই নিয়ে তাদের প্রথমে বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের পার্লারের ঠিক পেছনে আলো-আঁধারের ম্যাসাজ সেন্টারে পাঠানো হয়। জোরপূর্বক তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন মালিকরা। দুবাইয়ের অধিকাংশ ম্যাসাজ পার্লারের মালিক বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা।
সরেজমিনে দুবাইয়ের সোনাপুর লেবার ক্যাম্পের মোহসিনা-টু এলাকায় এমন প্রায় ১০-১২টি ম্যাসাজ পার্লারের সন্ধান মেলে। এগুলোতে কাজ করেন বাংলাদেশি, ভারতীয় ও ইন্দোনেশিয়ান মেয়েরা। বাইরে থেকে সাদা কাচে ঘেরা প্রতিটি পার্লার খালি দেখা যায়। তবে পার্লারের পাশেই একটি করে কেঁচি গেট আছে। প্রতিটি গেটের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য মেয়ে।
কেঁচি গেটের বাইরে তিন-চারজন দালাল থাকেন। ওই স্থান দিয়ে কেউ গেলেই তারা জিজ্ঞাসা করেন, ভেতরে প্রবেশ করতে চান কি না। প্রতিবেদক ভেতরে যাওয়ার আগ্রহ দেখালে বাংলাদেশি এক দালাল বলেন, ‘বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, ইন্দোনেশিয়ান তরুণী আছে। বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর। ৩০ মিনিটের জন্য ৫০ দিরহাম লাগবে (১২৫০ টাকা)।
এসব ম্যাসাজ পার্লার সম্পর্কে জানতে চাইলে দীর্ঘ আট বছর দুবাইয়ের সোনাপুরে ব্যবসা করা এক বাংলাদেশি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে বাংলাদেশি মেয়েদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। আমি ভেতরে কয়েকবার গিয়েছি। ভেতরে ঢুকতেই ৮-১০ জন মেয়ে দাঁড়িয়ে যায়, কাছেও আসে। একজনকে বেছে নেওয়ার পর তার সঙ্গে ৩০ মিনিট সময় কাটানো যায়। তবে ২০ মিনিট পার হলেই ব্রোকাররা (দালাল) বাইরে থেকে দরজা খট খট করতে থাকেন।’
এখানে বাংলাদেশি মেয়েদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। আমি ভেতরে কয়েকবার গিয়েছি। ভেতরে ঢুকতেই ৮-১০ জন মেয়ে দাঁড়িয়ে যায়, কাছেও আসে। একজনকে বেছে নেওয়ার পর তার সঙ্গে ৩০ মিনিট সময় কাটানো যায়। তবে ২০ মিনিট পার হলেই ব্রোকাররা (দালাল) বাইরে থেকে দরজা খট খট করতে থাকেন
প্রবাসী বাংলাদেশি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি এক ব্রোকার বলেন, এসব মেয়ে ডাউনটাউন দুবাই এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে থাকেন। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তাদের রাখা হয়। সিকিউরিটি গার্ডও থাকে। প্রতিদিন সকাল ১০-১১টার দিকে কয়েকটি মাইক্রোবাসে করে তাদের এসব পার্লারে আনা হয়। রাত ১১টার দিকে মালিকরা নিজেদের মাইক্রোবাসে করে তাদের ফ্ল্যাটে রেখে আসেন।
বারে মেয়ে সরবরাহে কত পান দালালরা
দুবাইয়ে একাধিক দালালের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, মেয়ে আনার জন্য তারা নির্দিষ্ট অঙ্কের কোনো টাকা পান না। তাদের চুক্তিই থাকে, বছরে এতগুলো মেয়ে আনতে হবে। নির্দিষ্ট সংখ্যক মেয়ের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা। তবে গড় হিসাবে একটি মেয়েকে দেশ থেকে দুবাইয়ের বারে আনতে পারলে এক লাখ টাকা পান তারা।
ঘরে আটকে রেখেও বাণিজ্য
দীর্ঘ অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দুবাইয়ে আসা অধিকাংশ তরুণীই তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত বিরক্ত। কেউ কেউ নির্যাতনের পরও বারে কাজ করতে অনাগ্রহ দেখান। একপর্যায়ে তাদের ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে থেকে বিগো লাইভের মতো বিভিন্ন ভিডিও চ্যাটিং অ্যাপে মধ্যবিত্ত প্রবাসীদের মনোরঞ্জনে বাধ্য করা হয়। এর মাধ্যমেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন মালিকরা।
তাদের সবাই দুবাইয়ের ডেরা এলাকায় থাকেন। সেখানে তাদের থাকার জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করা আছে। সেখানে একটি হল রুমের মধ্যে ১৫-২০ জন থাকেন। দুপুরে মালিকের মাইক্রোবাসে করে তাদের বারে নেওয়া হয়। যারা পুরুষদের সঙ্গে রাত কাটান তাদের সরাসরি হোটেল থেকে বারে নেওয়া হয়। প্রতিটি গাড়িতে থাকেন চালক, আর মালিকের দুজন প্রতিনিধি
নিরুপায় মেয়েরা অভিযোগও জানাতে পারেন না
ড্যান্স বার বা ওয়েটার বারে কাজে লাগানো মেয়েদের কঠোর নজরদারিতে রাখেন মালিকরা। গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া তাদের ফোন বা মোবাইল ব্যবহার নিষেধ। কেউ যাতে দূতাবাস বা বাইরের কারও কাছে সাহায্য চাইতে না পারেন সেজন্য এ ব্যবস্থা। তবে সপ্তাহে এক বা দুদিন মালিকের পক্ষ থেকে মেয়েদের দেশে ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয়। ওই সময় তাদের বলতে বাধ্য করা হয় যে, তারা এখানে ভালো আছেন। মালিক অথবা মালিকের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত থাকেন।
ভুক্তভোগী মেয়েরা ঢাকা পোস্টকে জানান, তাদের সবাই দুবাইয়ের ডেরা এলাকায় থাকেন। সেখানে তাদের থাকার জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া করা আছে। সেখানে একটি হল রুমের মধ্যে ১৫-২০ জন থাকেন। দুপুরে মালিকের মাইক্রোবাসে করে তাদের বারে নেওয়া হয়। যারা পুরুষদের সঙ্গে রাত কাটান তাদের সরাসরি হোটেল থেকে বারে নেওয়া হয়। প্রতিটি গাড়িতে থাকেন চালক, আর মালিকের দুজন প্রতিনিধি।
এমন তিন তরুণীর সঙ্গে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের সরাসরি কথা হয়। তারা যে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে থাকেন, সে প্রমাণও মেলে। দুবাইয়ের ডেরা এলাকার অস্টার ক্লিনিকের বেজমেন্টে করোনা টেস্টিং সেন্টারে কথা হয় তাদের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তারা জানান, দুবাইয়ের বারে কাজ করেন। করোনার উপসর্গ থাকায় টেস্ট করাতে এসেছেন। তাদের সঙ্গে এসেছেন বারের মালিকের দুজন প্রতিনিধি। সবসময় নজরদারিতে রেখেছে। কিন্তু করোনা টেস্টের রুমের ভেতরে ঢুকতে না পারায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। টেস্ট করানোর পর তাদের একটি মাইক্রোবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরে দেখছি, বাংলাদেশি মেয়েদের বিউটিশিয়ান ভিসা দিয়ে পার্লারে আনা হয়। পার্লারের পাশাপাশি তাদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ, এমনকি পতিতাবৃত্তিও করানো হয়। এমন মেয়ে দুবাইয়ের বার্থ বে, সাফকা বাস স্টেশন, তারা হোটেল, চোর বাজার এলাকায় পাওয়া যায়। ৩০ থেকে ৫০ দিরহাম খরচ করে তাদের সান্নিধ্য পাওয়া যায়
পাকিস্তানি হোটেল সার্ভিস বয়
পাকিস্তানি হোটেল সার্ভিস বয়ের ভাষ্য
দুবাইয়ে ২৩ বছর ধরে আছেন পাকিস্তানি আমজাদ (ছদ্মনাম)। ডেরা এলাকার একটি হোটেলে সার্ভিস বয় হিসেবে কর্মরত। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দেখছি, বাংলাদেশি মেয়েদের বিউটিশিয়ান ভিসা দিয়ে পার্লারে আনা হয়। পার্লারের পাশাপাশি তাদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ, এমনকি পতিতাবৃত্তিও করানো হয়। এমন মেয়ে দুবাইয়ের বার্থ বে, সাফকা বাস স্টেশন, তারা হোটেল, চোর বাজার এলাকায় পাওয়া যায়। ৩০ থেকে ৫০ দিরহাম খরচ করে তাদের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। এসব মেয়ের সঙ্গে কথা বলার আগে তাদের দালালদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করতে হয়।
দূতাবাস যা বলছে
দেশ থেকে আনা মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করানোর বিষয়ে কথা হয় দুবাই ও উত্তর আমিরাতের কনসাল জেনারেল ইকবাল হোসাইন খানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা চাই না কেউ এখানে এসে নির্যাতনের শিকার হোক। আমাদের এখানে কোনো মেয়ে অভিযোগ নিয়ে আসলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বক্তব্য শুনে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এমন অনেক মেয়েকে আমরা দেশে পাঠিয়েছি।’
আমরা চাই না কেউ এখানে এসে নির্যাতনের শিকার হোক। আমাদের এখানে কোনো মেয়ে অভিযোগ নিয়ে আসলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বক্তব্য শুনে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এমন অনেক মেয়েকে আমরা দেশে পাঠিয়েছি
জেনারেল ইকবাল হোসাইন খান, কনসাল জেনারেল, দুবাই ও উত্তর আমিরাত
তিনি আরও বলেন, ‘এমন অনেক মেয়ের সঙ্গে আমি সরাসরি কথা বলেছি। তারা নাচের জন্য স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে দুবাই আসেন। তবে অনেকে অভিযোগ করেন, কিছু কিছু মালিক মেয়েদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করান। না করলে নির্যাতন চালানো হয়। আমাদের কাছে আসলে তাদের সাহায্য করি।’
পুলিশ সদর দফতর যা বলছে
ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দফতরে জানতে চাওয়া হয়, ‘বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মেয়ে বিমানবন্দর দিয়ে পাচার হয়ে দুবাই যাচ্ছেন। তাদের সেখানে ড্যান্স বারে নাচতে বাধ্য করা হয়। এসব পাচার রোধে পুলিশের কোনো তৎপরতা আছে কি না?’
সেসব দেশে গিয়ে ভুক্তভোগীদের অবৈধ ও অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে জড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্রকে শনাক্ত করে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে
মো. সোহেল রানা, এআইজি, মিডিয়া অ্যান্ড পিআর
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা বলেন, ‘অনেকেই বৈধ পাসপোর্টে ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে দেশত্যাগ করছেন। অনেক সময় দেশত্যাগ করে দালালের সহযোগিতায় দ্বিতীয় কোনো দেশ হয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে সেসব দেশে গিয়ে ভুক্তভোগীদের অবৈধ ও অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে জড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্রকে শনাক্ত করে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আমরা প্রায়ই অভিযোগ পাই, কাজের কথা বলে বিদেশে নিয়ে নিপীড়ন করা হচ্ছে। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আগে ভারতে বেশি পাচার হতো। এখন দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হচ্ছে। আমরা চাই, নারীপাচারের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক
শরিফুল হাসান, ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম
অভিবাসীদের অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশে কাজ করছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম। এর প্রধান শরিফুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানবপাচারের ঘটনায় দেশে এখন পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী ২১ শতাংশ নারী এবং ১১ শতাংশ শিশু।
‘বাংলাদেশ থেকে কাজের কথা বলে এখন অনেককেই বিদেশে নেওয়া হচ্ছে। আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও শহরে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা মূলত পাচারের শিকার। এসব ঘটনা উদ্বেগজনক। আমরা প্রায়ই অভিযোগ পাই, কাজের কথা বলে বিদেশে নিয়ে নিপীড়ন করা হচ্ছে। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আগে ভারতে বেশি পাচার হতো। এখন দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হচ্ছে। আমরা চাই, নারীপাচারের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’
একাধিক চক্রকে শনাক্ত সিআইডির
বাংলাদেশি সহস্রাধিক নারীকে কাজ দেওয়ার নামে বিদেশে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করায় আন্তর্জাতিক নারীপাচারকারী একটি চক্রের হোতা আজম খানকে গত বছর জুলাই মাসে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দুবাইতে চার তারকাযুক্ত তিনটি ও তিন তারকাবিশিষ্ট একটি হোটেলের মালিক তিনি। হোটেলগুলো হলো- ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ার।
সিআইডি জানায়, আজম খান একজন গডফাদার। সারাদেশ থেকে দালালের মাধ্যমে নারীদের সংগ্রহ করে ‘হোটেলে কাজ দেওয়ার কথা বলে’ জোর করে যৌনকর্মে বাধ্য করা হতো। এ কাজে আজম খানকে সহযোগিতা করত একাধিক ট্রাভেল এজেন্সি। ভুক্তভোগী বেশকিছু নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে এ ঘটনায় মামলাও দায়ের হয়।
ওই সময় সিআইডি'র অর্গানাইজড ক্রাইমের ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছিলেন, ইতোমধ্যে এ চক্রের মূলহোতা আজম খান ছাড়াও বেশ কয়েকজনের নাম আমরা জেনেছি। তদন্তের স্বার্থে এখন নামগুলো বলা যাচ্ছে না। তাদের অনেকের অবস্থানও আমরা নিশ্চিত করেছি। আন্তর্জাতিক এই পাচারকারী চক্রের সঙ্গে ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকরাও জড়িত। তারা সবাই এখন দুবাই অবস্থান করছেন। তাদের সম্পর্কে তথ্য বের করাটা বেশ কঠিন। দুবাইয়ে যে হোটেলগুলোতে বাংলাদেশিদের রাখা হয়, সেগুলোর পরিচালনায় আছেন আজমের দুই ভাই এরশাদ ও নাজিমউদ্দিন। তারা সেখানেই অবস্থান করছেন।
পাচারের সঙ্গে যুক্ত জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ইভানও
‘আর্টিস্ট’ বলে তরুণীদের বিদেশে পাচারের অভিযোগে ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগকে। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথাবার্তার পর সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মৃণাল কান্তি সাহা গত বছর ২ জুলাই লালবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইভানসহ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে নির্মল, আজম, আলামিন ও ইয়ামিন আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।
বর্তমানে মামলাটির তদন্তে তদারকি করছেন সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তার হোসেন। তিনি জানান, ঘটনার সঙ্গে অনেকে জড়িত। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। গ্রেফতার চারজন ইতোমধ্যে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। শিগগিরই এ মামলার প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
এআর/এমএআর/এমএমজে