সিআইডি এখন ডাম্পিং-পোস্টিং স্টেশন নয়
সিআইডি এখন ডাম্পিং-পোস্টিং স্টেশন নয়, সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলাসহ নানা কাজে সিআইডি এখন বেশ পারদর্শী। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে দেশের টাকা বাইরে পাচার হচ্ছে। এটি বন্ধে কাজ করছি আমরা। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে, ভাবা হচ্ছে নতুন আইনের বিষয়েও। একটি চক্র ডলারের মূল্য ১৩০ টাকায় উন্নীত করার চেষ্টা চালিয়েছে; চক্রান্ত এখনো চলছে। এটি সহনশীল পর্যায়ে রাখতে চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে— পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া।
ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষ শাখা। এটি পুলিশের অন্যতম প্রাচীন ও বিশেষায়িত সংস্থা। সংস্থাটির বর্তমান প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়ার দাবি, সিআইডি এখন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের শেষ আশ্রয়স্থল। মানুষ এখন মনে করে, সিআইডির ওপর তদন্তভার ন্যস্ত হলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে পুলিশের বিশেষ এ শাখার কর্মতৎপরতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন তিনি। সংস্থার ফরেনসিক ল্যাবের আধুনিকায়ন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলার অগ্রগতি এবং মানবপাচার রোধে সিআইডির তৎপরতাসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন।
ঢাকা পোস্ট : সম্প্রতি দেশে ডলারের মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। খুচরা বাজারে ১১২/১১৩ টাকায় কিনতে হচ্ছে ডলার। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাইরে দেশীয় কোনো কারসাজি এতে আছে কি না?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : ডলার যখন ৮৫ থেকে ৯৫ টাকায় উন্নীত হয় তখনই কাজ করার প্রয়োজন ছিল। আমি আসার পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারি একটি সিন্ডিকেট বা চক্র ডলারের দর ১৩০ টাকায় উন্নীত করার চেষ্টা করছে। এটি জানতে পেরে আমরা কাজ শুরু করি। ইতোমধ্যে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া ডলার ১১০/১১২ টাকায় নেমে এসেছে।
আরও পড়ুন >> হুন্ডির মাধ্যমে এক বছরে ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার : সিআইডি
ঢাকা পোস্ট : সেই সিন্ডিকেট শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে কি না?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : এরা বিজনেস কমিউনিটি পিপল...; শেয়ারবাজারে যখন অস্থিরতা তৈরি হয়, দ্রব্যমূল্যে যখন ঊর্ধ্বগতি তখন একটি অসাধু চক্র ডলারের দামের উল্লম্ফন-কে দায়ী করার চেষ্টা করেন। আমরা দেখেছি রিকশাচালকও ডলার কিনছেন। ডলার কিনে রিকশাচালক কী করবেন? ডলার তিনি কিনবেন যার পাসপোর্ট ও ভিসা আছে। মানি মার্কেটের (অর্থবাজার) জন্য এটি খুবই দুঃখজনক। দেশের অর্থনীতি যখন চাঙ্গা অবস্থা, তখন এটি মানা যায় না।
পুঁজিবাজারে একটি কলমের দাম যদি ১০ টাকা হয় সেটি কীভাবে ১২০/১৩০ টাকায় কেনে মানুষ? এটি আসলে জানার সীমাবদ্ধতা। সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ এটি করবেন না। এটি স্বাভাবিক নয়, যদিও পুঁজিবাজারের বাস্তবতা এমনই।
ঢাকা পোস্ট : ‘বিজনেস কমিউনিটি পিপল’ বলতে পুঁজিবাজার-কেন্দ্রিক লোকজনকে বোঝাচ্ছেন আপনি?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : হ্যাঁ, পুঁজিবাজার-কেন্দ্রিক লোকজন। আমরা ইনফরমেশন (তথ্য) সংগ্রহ করছি। অবশ্যই এর বিহিত করা হবে। আমরা ইতোমধ্যে মানি এক্সচেঞ্জ (অর্থ-বিনিময়) নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সঙ্গে বসেছি। ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ বৈধ, বাকিগুলো অবৈধ। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, তারা হাইকোর্টে রিট করে অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছে। যারা অবৈধ তারা কেন ব্যবসা করবে? আমরা এটি নিয়ে যৌথভাবে কাজ করছি।
আরও পড়ুন >> সাকিবকে দেখে বেটউইনারে জুয়াড়ির সংখ্যা বাড়ে ১০ গুণ
ঢাকা পোস্ট : বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলা মামলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা সিআইডি তদন্ত করেছে। অভিযোগ আছে, সিআইডিতে এখন তেমন মামলা আসে না। তাহলে কি সিআইডি’র আগের অবস্থান এখন আর নেই?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : না, সিআইডি আগের জায়গাতেই আছে। বরং অনেক উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি কিন্তু ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (আন্তর্জাতিক অপরাধ)। এটির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠির জবাব না আসলে তো আমরা এগোতে পারি না। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এবং তাদের নির্দেশিত পথে রিজার্ভ পাচার হয়েছে।
অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক আইনি সহায়তা (এমএলএটি) চুক্তি আছে। এটির বলেই আমরা চিঠি দিয়েছি। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এরপর সেই দেশে চিঠি পাঠাই। সেটি আবার পররাষ্ট্র, এরপর সেই দেশের হোম মিনিস্ট্রিতে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) যায়। এরপর একই প্রক্রিয়ায় রিপ্লাই (জবাব) আসে। যা খুবই লং প্রসেস (দীর্ঘ প্রক্রিয়া)। এরপরও আমরা করছি, বাংলাদেশের বৃহৎ স্বার্থে।
ঢাকা পোস্ট : দেশে অনলাইন জুয়া এখন ওপেন সিক্রেট। এর মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। অনলাইন জুয়া বন্ধে কোন বিষয়টির ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অনেকে অনেক সুযোগ নিচ্ছেন। তবে, জুয়ার কোনো বৈধতা বাংলাদেশে নেই। যদিও এটি অন্য অনেক দেশে বৈধ। বিদেশিদের সহায়তায় দেশীয় কিছু স্বার্থান্বেষী এ দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করার জন্য ভার্চ্যুয়াল ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন করছে। যাকে বলা হয় ভার্চ্যুয়াল ডায়মন্ড। এ ডায়মন্ড ভাঙালে মাসে ১৫/২০ হাজার টাকা আসে। একজন উঠতি বয়সী ছেলে যখন দেখে একটু শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, অ্যাকটিভিটিজ (কার্যক্রম)-এর মাধ্যমে মাসে ২০ হাজার টাকা আয় হয়, তখন সে উৎসাহ বোধ করে। এটি আসলে নৈতিকতার অবক্ষয়ের ব্যাপার। তারা এক ধরনের বেহায়াপনায় জড়িয়ে পড়ে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। বেশকিছু সাইট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।
আরও পড়ুন >> অনলাইন জুয়ার লেনদেন, নজরদারিতে আসছে বিকাশ-রকেট-নগদ
তবে সমস্যা হচ্ছে, বিটিআরসি-কে (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) অনুরোধ করে সাইটগুলো বন্ধ করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো ভিপিএন (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহারের মাধ্যমে পুনরায় চালু করা হচ্ছে। ফেসবুকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
ঢাকা পোস্ট : অনলাইন জুয়া বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। প্রচলিত আইনে এটি বন্ধ করা সম্ভব কি না, আইনি পদক্ষেপ কী হতে পারে?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : অনলাইন বেটিং বা জুয়া বন্ধে আমরা আলাদা আইন করতে যাচ্ছি। এটি মানি লন্ডারিংও (অর্থপাচার) বটে। কারণ, জুয়ার আয়ের টাকা দেশে থাকছে না। বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি নতুন আইন করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
ঢাকা পোস্ট : অনলাইন জুয়ার পেমেন্ট হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সিআইডি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর নজরদারি, প্রয়োজন হলে অভিযান পরিচালনা করবে কি না?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসটি বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং (দেখভাল) করে। কোথায়, কত টাকা ট্রানজেকশন (লেনদেন) হচ্ছে তা তাদের ড্যাশবোর্ডে দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের জানালে তখন অভিযান চালাই। মনিটরিংয়ের সুযোগ আমাদের নেই। থাকলে আমরা নিয়মিত মনিটরিং করতাম। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সাড়ে তিন লাখ মোবাইল অপারেটর আছেন, যারা আর্থিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশের সার্বিক অর্থনীতি আরও চাঙা হতো।
আরও পড়ুন >> কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিদের ‘সাইবার দাস’ বানাচ্ছে বাংলাদেশিরাই!
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় (আরও ৩০ কার্যদিবস) আবারও বাড়ানো হয়েছে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় এখন পর্যন্ত ৫৯ বার পেছানো হলো। তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে সিআইডি এখানে ব্যর্থ কি না? নিকট ভবিষ্যতে প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে আমরা চিঠি দিয়েছি। তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। জবাব আসলে ভালো একটি ফল আসবে। জড়িত কারা, তারা রাঘববোয়াল কি না— এসব সম্পর্কে জানতে চাইবেন না। এটি ম্যাটার অব ইনভেস্টিগেশন (তদন্তের বিষয়)। সময় হলে জানতে পারবেন। আমি আশাবাদী।
ঢাকা পোস্ট : সম্প্রতি মানবপাচারের ঘটনা বেড়েছে। এটি বন্ধে র্যাব, পুলিশসহ অনেক সংস্থা কাজ করছে। সিআইডিও কাজ করছে। মানবপাচার বন্ধে নতুন কোনো উদ্যোগ আপনারা নেবেন কি না?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : প্রথমে আমরা শনাক্ত করছি কারা বৈধ এবং কারা অবৈধভাবে মানবপাচার করছে। কাজটা শেষ হলে আমরা বুঝতে পারব কারা অবৈধভাবে করছে। দেশে দুই হাজারের মতো ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু রয়েছে সম্পূর্ণ অবৈধ।
আরও পড়ুন >> ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট ‘ভারত হয়ে উজবেকিস্তান’
আমার প্রশ্ন সাধারণ মানুষের কাছে। একজন বলল আমেরিকা বা কানাডা পাঠাব। টেকনিক্যাল নলেজ (প্রযুক্তিগত জ্ঞান) ছাড়া মুখের কথায় বিশ্বাস করে ১০ বা ১৫ লাখ টাকা তুলে দেব কেন? দেশের মানুষের যে সরলতা, এর সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। যাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের মামলা হয়েছে, যারা লোকজন পাঠাচ্ছে তাদের বিষয়ে সিআইডি ও এসবি যৌথভাবে কাজ করছে। আমার বিশ্বাস, মানুষ সচেতন হচ্ছে। এমন ভুল পথে মানুষ আর পা দেবে না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বাইরে নিয়ে কিডন্যাপ (অপহরণ) করে দেশে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দূতাবাসগুলো আমাদের সহায়তা করছে। আমরাও কাজ করছি। কতটুকু করতে পারব, এখন তা বলছি না। তবে, একটি সহনশীল ও ভালো ফল আসবে। যারা দেশে ফিরছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটির সঙ্গে জড়িত কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), ইমিগ্রেশন (অভিবাসন) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সবাই যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করে তাহলে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে সম্ভব নয়।
ঢাকা পোস্ট : মানবপাচার নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে সিআইডি। কিন্তু ইমিগ্রেশন পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে লোক ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : কেউ যদি বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক তথ্য দিতে পারে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। জাল-জালিয়াতির চেইনে যারা কাজ করে তাদের হাত অনেক লম্বা। আমি এ চেইন (ধারা) ভেঙে চুরমার করে দিতে চাই। কারণ, এখানে সতর্কতা অবলম্বন করলে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ। এজন্য সব প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরও পড়ুন >> ‘জেনে, না বুঝে’ সাইবার অপরাধে কিশোর-তরুণরা
ঢাকা পোস্ট : ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। সেগুলোর অগ্রগতি কী? ইভ্যালিকে সরকার একটি সুযোগ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ওপর নজরদারি রাখা হবে কি না?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : বাংলাদেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার ধরন অ্যামাজন বা আলিবাবার মতো জায়ান্ট (অতিকায়) নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কৌশলই হচ্ছে সাধারণ ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করা। তদন্ত সংস্থা হিসেবে আমাদের তো নজরদারি থাকবেই। তবে শুধু সিআইডি নয়, সব গোয়েন্দা সংস্থার উচিত মনিটরিং করা। শুধু ইভ্যালি নয়, অনলাইন বেইজড সব প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি রাখা উচিত। পাশাপাশি আমরা ই-কমার্স সংক্রান্ত মামলাগুলো পর্যালোচনা করছি।
ঢাকা পোস্ট : হুন্ডির মাধ্যমে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বেড়েছে। গত সপ্তাহেও ঢাকা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযোগ, তারা যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া থেকে টাকা সংগ্রহ করে জঙ্গিবাদে ব্যবহার করছিল। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের সময় জঙ্গি তৎপরতা বাড়ার আশঙ্কা করেছেন ডিএমপি কমিশনার। এক্ষেত্রে সিআইডি কী ভূমিকা রাখছে?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : দেশের ৬৪ জেলা থেকে অনেক যুবক নিখোঁজ হয়েছেন। অনেকে ফিরে আসছেন আবার অনেকের খোঁজ মিলছে না। তারা কোথায় যাচ্ছেন? আমরা এসব খতিয়ে দেখছি। জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়গুলো সার্ভিল্যান্সের (নজরদারি) মধ্যে রেখেছি। আমাদের সোর্স বাংলাদেশ ব্যাংক। কে, কোথায় এবং কীভাবে অস্বাভাবিক লেনদেন করছেন তা জানার চেষ্টা করছি। টার্গেট পিপল (নির্ধারিত ব্যক্তি) নজরদারিতে আছেন।
আরও পড়ুন >> সিআইডির সেই এএসপির সম্পদের খোঁজে দুদক
ঢাকা পোস্ট : অভিযোগ আছে, সিআইডিতে মামলার জট লেগেই আছে। তদন্ত শেষ করতে সময়ও বেশি নিচ্ছে। এটিকে ব্যর্থতা, নাকি জনবল সংকট বলবেন?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : আমি যোগ দেওয়ার পরই কর্মকর্তাদের পাঁচ বছর, তিন বছর, দুই বছর ধরে পেন্ডিং (অমীমাংসিত) মামলাগুলোর তালিকা দিতে বলেছি। সেসব নিয়ে বসেছি। কারণ শনাক্ত করছি। কিছু মামলার পেন্ডিং আদালতের নির্দেশনার কারণে। আমিসহ সারাদেশে সিআইডি’র জনবল তিন হাজার। আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তা আসলেই কম। যেসব মামলা আমরা তদন্ত করি, তার গভীরে গিয়েই করতে হয়। অনেক সময় তদন্তের স্বার্থে ছদ্মবেশও ধরতে হয়। আমরা মামলার জট কাটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
মামলার চেয়েও আরেকটি চাপ হচ্ছে অনুসন্ধান। আদালত অনুসন্ধান করার নির্দেশনা দিয়ে আদেশ দেয় সিআইডিকে। তখন অনুসন্ধানগুলো আগে করতে হয়। আমি দায়িত্বে এসে নির্দেশ দিয়েছি, তদন্ত চলবে, অনুসন্ধানও চলবে।
আরও পড়ুন >> ৬০ ই-কমার্সের তালিকা সিআইডির হাতে
ঢাকা পোস্ট : হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশ থেকে টাকা আসছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি প্রণোদনা থেকে। এ বিষয়ে আপনাদের করণীয় কী?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : এক কোটির ওপর প্রবাসী এখন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। মাসে যদি তারা এক হাজার ডলারও পাঠান তাহলে ১০০০ কোটি ডলার হয়। কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলে সেই পরিমাণ টাকা আসছে না। এখানে আমরা কাজ করছি। আমরা চাচ্ছি প্রবাসে যারা আছেন, তারা যেন যথাযথ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠান। এতে পরিবারও ভালো থাকবে, দেশেরও উন্নতি হবে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হলে আইনের ব্যত্যয় তো ঘটেই, ডলার আসে না দেশে। তখন সহযোগী অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবেন তিনি। ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে বরং সরকার কর্তৃক ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) পাবেন। সিআইডির উচিত ছিল আরও আগে এ জায়গায় কাজ করা।
ঢাকা পোস্ট : সিআইডিতে মামলা মানে এটি হিমাগারে চলে গেছে— এমনটি প্রায়ই শোনা যায়। আবার অনেক কর্মকর্তা ঢাকায় থাকার জন্য সিআইডিতে পোস্টিং নিচ্ছেন। বিষয়গুলোর মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : এটি সত্য নয় যে মামলাগুলো হিমাগারে যাবে। বর্তমানে অনেক অনেক উন্নত সিআইডি। একটি মামলাও পাবেন না যেটি ডিপ ফ্রিজে আছে। ১০ বা ১২ বছরের পুরোনো কোনো মামলা নেই সিআইডিতে। সর্বোচ্চ ১৪৭টি মামলা আছে পাঁচ বছরের। যা আদালতের নির্দেশনার কারণে ঝুলে আছে। সিআইডিতে যত জিআর (জেনারেল রেজিস্টার) মামলা আছে, তার চেয়ে বেশি সিআর (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার) মামলা। সিআর মামলা আদালত থেকে আসে। আসে ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে নতুন করে তদন্তের জন্য। থানা বা অন্য কোনো সংস্থা যেসব মামলার প্রতিবেদন দেয় সেখানে অনেক তথ্য-উপাত্ত থাকে না। সিম্বলিক (প্রতীকী) ও ফরেনসিক অনেক কিছুই তারা উপস্থাপন করতে পারে না বা তাদের ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) নেই। সিআইডি এক্ষেত্রে এগিয়ে।
আরও পড়ুন >> রাসেলের মুক্তিতেই ঝুলছে ইভ্যালির গ্রাহকদের ভাগ্য
একসময় সিআইডি ডাম্পিং-পোস্টিং স্টেশন ছিল। এখন আর নেই। কারণ, আগে ডিজিটাল অফেন্স (অপরাধ) কম ছিল। তখন সিডিউল (তফসিল) বা ট্র্যাডিশনাল (চিরাচরিত) কিছু মামলা হতো। ডিজিটাল মামলা শুরুর পর এক্ষেত্রে বেশি সফলতা দেখিয়েছে সিআইডি। সিআইডিতে এখন যারা কাজ করেন, তারা এটিকে ডাম্পিং-পোস্টিং স্টেশন মনে করেন না। ইচ্ছা মতো তদন্ত বা কাজ করলে করলাম— এমন সুযোগ সিআইডিতে আর নেই। কে, কোথায় এবং কী করছে তার তথ্য আমাদের কাছে আছে। সবার তদন্তের অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করা হচ্ছে। তবে, এটিও ঠিক অনেকে পরিবার বা অসুস্থতাজনিত কারণে ঢাকায় থাকতে চান। কিন্তু সিআইডি আর ঢাকাকেন্দ্রিক নয়। ৬৪ জেলাতেই এখন আমাদের অফিস ও কার্যক্রম চলমান। জনবলও সক্রিয়।
ঢাকা পোস্ট : যতটুকু জানা যায়, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে অনেক চাপ। আলোচিত ঘটনা ছাড়া ভিসেরা (আন্তরয়ন্ত্র) প্রতিবেদন সময় মতো পাওয়াই যায় না। চাপ কীভাবে সামলাচ্ছে সিআইডি?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : আমাদের ফরেনসিক ল্যাবটি বড় ও আধুনিক। শতভাগ ডিজিটালাইজড। সিআইডি এখানে পারদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা এর কাজের পরিধি আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছি। বিশেষ করে বড় বড় শহরে ল্যাব স্থাপনের চিন্তা আছে। এটি করতে পারলে চাপও কমে যাবে।
যৌন হয়রানি বা নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার স্যাম্পল (নমুনা) অনেক সময় আমাদের কাছে আসে না, আসলেও অনেক দেরিতে আসে। ল্যাবগুলো জেলায় জেলায় করা গেলে এক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে।
আরও পড়ুন >> লাইকি-বিগোতে মাসে পাচার শত কোটি টাকা
ফরেনসিক ল্যাবে একসময় বেশ চাপ ছিল। আমি এসে চমৎকার একটি সিস্টেম চালু করেছি। কে কয়টা কাজ করেছে, সেটির আপডেট জানার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছি। সেখানে সবাই দিনের আপডেট দেন। জেলার কনসার্ন অফিসার জানতে পারছেন তার স্যাম্পলের পরীক্ষা হয়েছে কি না। রিপোর্টের কপিও সেখানে পেয়ে যাচ্ছেন। তদবিরে আর কিছু হচ্ছে না। তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও আসতে হচ্ছে না। এখন আর আগের মতো বছরের পর বছর রিপোর্ট না পাওয়ার অভিযোগ নেই।
ঢাকা পোস্ট : প্রত্যেক সংস্থাতেই দুষ্টু চক্র অর্থাৎ বিপথগামী কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকেন। যারা অসৎ উদ্দেশ্যে অবৈধ আর্থিক লেনদেন ও অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাদের ক্ষেত্রে কঠোর কোনো নির্দেশনা আছে কি না?
মোহাম্মদ আলী মিয়া : আমি প্রথম দিনেই বলেছি, এখন আর সিআইডি চিফের নির্দেশনা ছাড়া মন চাইলে অপারেশনে যেতে পারবেন না। জুনিয়ররা এটা পছন্দ করেছে, হাততালিও দিয়েছে। এটা ঠিক যে অপারেশনাল (প্রয়োগগত) কাজে জড়িত কর্মকর্তাদের দুই নম্বরি করার সুযোগ থাকে। এ জায়গায় আমার জিরো টলারেন্স। কাউকে অন্যায়ভাবে আটক বা জুলুম করা যাবে না। করলে অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
একনজরে মোহাম্মদ আলী মিয়া
মোহাম্মদ আলী মিয়া সিআইডি প্রধান হিসেবে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট যোগ দেন। এর আগে তিনি ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
মোহাম্মদ আলী মিয়া ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর ১৫তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। পুলিশ সুপার হিসেবে নরসিংদী, হবিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলায় দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত ডিআইজি, সিটিএসবি; অতিরিক্ত ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ এবং ডিআইজি, সিটিএসবি হিসেবেও তিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক।
জেইউ/এমএআর/