মন্ত্রীর একান্ত সচিবের ব্যাংক হিসাবেই ৮ কোটি টাকা!
ড. মো. আবুল কালাম আজাদ; ছিলেন সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের একান্ত সচিব (পিএস)। বর্তমানে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত। হজ-ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির অভিযোগের সূত্র ধরে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে সম্পদের বড় ধরনের গরমিলের তথ্য মেলে। স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে সোয়া আট কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পায় দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
দুদক সূত্রে জানা যায়, শুধুমাত্র সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে জমা ও নগদ মিলিয়ে আবুল কালাম আজাদের কাছে রক্ষিত আট কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। আয়কর বিবরণীতে এসব অর্থের ঘোষণা থাকলেও আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি তিনি। অর্থাৎ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে এসব টাকা আয় করা হয়েছে— মনে করছে দুদক। এছাড়া তার স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ধানমন্ডিতে দুই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, কল্যাণপুরে বাড়ি ও পল্লবীতে প্লট।
শুধুমাত্র সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে জমা ও নগদ মিলিয়ে আবুল কালাম আজাদের আট কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। আয়কর বিবরণীতে এসব অর্থের ঘোষণা থাকলেও আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি তিনি
এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যদিও দুদকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন >> বিমানের বকেয়া ৩০৯২ কোটি, আদায়ে দুদকের তোড়জোড়
দুদকে দেওয়া আবুল কালাম আজাদের লিখিত বক্তব্য
আবুল কালাম আজাদ দুদকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, তিনি ১৯৮৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সিবা গেইগী’র মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পরবর্তীতে বিসিএস (আনসার) ক্যাডারে ১৯৯৩ সালর ৩১ মার্চ পর্যন্ত চাকরি করেন। ১৯৯৩ সালে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘ ২৬ বছরের চাকরি-জীবনে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মতিউর রহমানের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে চার বছর সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক।
অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, তিনি তার নিজের স্থায়ী ঠিকানা দিনাজপুর কর অফিসে নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। তার স্ত্রী ‘সিনিয়র সমন্বয় কর্মকর্তা’ হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে কর্মরত।
আয়কর বিবরণীতে যা আছে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, আবুল কালাম আজাদের নামে স্থাবর ও অস্থাবরসহ মোট ১০ কোটি ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। স্থাবর সম্পদের বিবরণের মধ্যে রয়েছে- দিনাজপুর সদর থানার কয়েকটি মৌজায় মোট ১.৮৩৪৪ একর জমি, একই মৌজায় ২২ শতাংশ জমি, ধানমন্ডিতে ২০০৯ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট, আউলিয়াপুর মৌজায় ১৮ শতাংশ জমি, রাজধানীর পল্লবী থানায় বাউনিয়া মৌজায় .০১২১০ অযুতাংশ জমি ও কল্যাণপুরে ৪.৯৫ শতাংশ জমিসহ বাড়ি।
স্থাবর সম্পদের বিবরণের মধ্যে রয়েছে- দিনাজপুর সদর থানার কয়েকটি মৌজায় মোট ১.৮৩৪৪ একর জমি, একই মৌজায় ২২ শতাংশ জমি, ধানমন্ডিতে ২০০৯ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট, আউলিয়াপুর মৌজায় ১৮ শতাংশ জমি, রাজধানীর পল্লবী থানায় বাউনিয়া মৌজায় .০১২১০ অযুতাংশ জমি ও কল্যাণপুরে ৪.৯৫ শতাংশ জমিসহ বাড়ি
আয়কর নথি অনুসারে তার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ৬০ হাজার টাকার শেয়ার, অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ পাঁচ লাখ ২৬ হাজার টাকা, ৩২ লাখ টাকার গাড়ি (ঢাকা মেট্রো গ-৩৪-২২১১) এবং ব্যাংকে জমা ও নগদসহ আট কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৪৪৩ টাকাসহ মোট আট কোটি ৭১ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন >> পি কে হালদারকে দেশে আনলে ধরা পড়বে রাঘববোয়ালরাও
যা বলছে দুদকের অনুসন্ধান
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আবুল কালাম আজাদের নামে এক কোটি ৫৩ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকার স্থাবর এবং আট কোটি ৭১ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। অনুসন্ধানকালে তার দেওয়া তথ্য এবং বিভিন্ন উৎস থেকে তার মোট আয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে দুই কোটি ৪৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকার।
অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ ৫০ লাখ টাকার হিসাব পাওয়া গেছে। যা বাদ দিলে নিট আয় থাকে এক কোটি ৯৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে, তার স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ১০ কোটি ২৪ লাখ ২৯ হাজার ২০৩ টাকা মূল্যমানের সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। সেখান থেকে তার ব্যক্তিজীবনের নিট আয় এক কোটি ৯৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা বাদ দিলে আট কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার হিসাব পাওয়া যায়। অর্থাৎ দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে যা জ্ঞাত আয়ের উৎস-বহির্ভূত সম্পদ বলে মনে হয়েছে।
যদিও অনুসন্ধানকালে আয়ের একটি উৎস হিসেবে আবুল কালাম আজাদ জমি বিক্রিবাবদ এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। ওই আয়ের পক্ষে রেকর্ডপত্র কিংবা প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি। দুদকের কাছে ওই সোয়া আট কোটি টাকা ‘অবৈধভাবে’ ও ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত’ বলেই মনে হয়েছে। এ কারণে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৬ (১) ধারায় সম্পদবিবরণী নোটিশ জারির সুপারিশ করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা সংস্থাটির উপপরিচালক রেজাউল করিম। যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের অনুমোদন নিয়ে সম্পদবিবরণী নোটিশ জারি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানকালে আয়ের একটি উৎস হিসেবে আবুল কালাম আজাদ জমি বিক্রিবাবদ এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা দেখিয়েছেন। ওই আয়ের পক্ষে রেকর্ডপত্র কিংবা প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি। দুদকের কাছে ওই সোয়া আট কোটি টাকা ‘অবৈধভাবে’ ও ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত’ বলেই মনে হয়েছে
আরও পড়ুন >> রোগী মারা যাওয়া পর্যন্ত কমিশন ঢোকে তাদের পকেটে
সম্পদবিবরণী নোটিশে যা আছে
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. আবুল কালাম আজাদের সম্পদের হিসাব চেয়ে গত ২৬ জুলাই দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। দুদক পরিচালক মো. আকতার হোসেন আজাদ স্বাক্ষরিত নোটিশে তাকে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ওই নোটিশে বলা হয়, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান করে কমিশনের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, তিনি জ্ঞাত আয় বহির্ভূত স্বনামে/বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ/সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তাই নোটিশ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তার নিজের, নির্ভরশীল ব্যক্তিবর্গের যাবতীয় স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি, দায়-দেনা, আয়ের উৎস এবং তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ নির্ধারিত ফরমে দাখিল করতে অনুরোধ করা গেল।
এর আগে হজ-ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি সাবেক ধর্মমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) আবুল কালাম আজাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। ওই দিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন অভিযোগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও তৎকালীন তৎকালীন সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমান। জিজ্ঞাসাবাদে তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন আবুল কালাম আজাদ।
আরএম/এমএআর/