সড়ক বিভাজকের ১১০০ লোহার দণ্ড গেল কোথায়?
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর রোড ডিভাইডারের (সড়ক-বিভাজক) প্রায় ১১০০ লোহার পাত বা দণ্ড লাপাত্তা হয়েছে। ফলে উন্মুক্ত বিভাজকের মধ্য দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন সড়ক পার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
নিউ মার্কেটের মিরপুর রোডের নূরজাহান মার্কেটের সামনে থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত অসংখ্য সড়ক-বিভাজকের খাড়া পাত বা দণ্ডগুলো কেটে ফেলা অথবা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনে থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে প্রায় ১০০টির মতো বিভাজকের কোনো লোহার দণ্ড দেখা যায়নি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লোহার মোটা পাত বা দণ্ড দিয়ে তৈরি এসব বিভাজকের প্রতিটিতে ১১টি করে দণ্ড রয়েছে। সে হিসাবে প্রায় ১১০০টি দণ্ড লাপাত্তা হয়েছে। এসব দণ্ড কারা নিয়েছে— এ প্রশ্নের উত্তর নেই কারও কাছে।
গত ১৯ এপ্রিল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সময় চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনে অবস্থান নেওয়া অনেকের হাতে লোহার এসব দণ্ড দেখা যায়। সংবাদ সংগ্রহে আসা সাংবাদিকদের ওপর এসব দণ্ড দিয়ে হামলাও চালানো হয়।
ব্যবসায়ীদের হামলায় আহত হন দীপ্ত টিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আসিফ জামান সুমিত ও প্রতিষ্ঠানটির ক্যামেরাপারসন ইমরান লিপু। হামলার সময় তোলা ছবিতে দেখা যায়, সড়ক-বিভাজকের মোটা সাতটি দণ্ড ও একটি লোহার পাইপ দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করা হয় সাংবাদিক সুমিত ও ক্যামেরাপারসন লিপুকে।
তবে নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও দোকানিদের দাবি, আগে থেকেই এ অংশের সড়ক-বিভাজকের মধ্যে লোহার অনেক দণ্ড ছিল না। সংঘর্ষের সময়ে সেগুলো কাটা বা ভাঙা হয়েছে কি না, সেটিও তাদের জানা নেই।
সাংবাদিক আসিফ জামান সুমিত ঢাকা পোস্টের কাছে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাওয়ার পরপরই ব্যবসায়ীরা লোহার দণ্ড ও লাঠি দিয়ে হামলা শুরু করেন। আমার মাথায় চারটি সেলাই দিতে হয়েছে। লোহার দণ্ডের আঘাতে আমার সঙ্গে থাকা ক্যামেরাপারসন লিপুও গুরুতর আহত হন।
এছাড়া ওই দিন রোগীভর্তি একটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করা হয়। হামলাকারীদের হাতেও সড়ক-বিভাজকের দণ্ড দেখা যায়— বলেন আসিফ জামান সুমিত।
এ বিষয়ে নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেদিনের ঘটনায় সড়কে অবস্থান নেওয়া কেউই ব্যবসায়ী ছিলেন না। তারা তৃতীয় পক্ষের লোক ছিলেন।
তার ভাষায়, ‘১৯ এপ্রিল রাতের ঘটনার পর সকাল ৬টায় পুলিশ প্রশাসন থেকে আমাকে বলা হয় নিউ মার্কেট ও আশপাশের মার্কেটগুলো বন্ধ রাখার জন্য। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের পর যেন দোকানপাট খোলা হয়। সে অনুযায়ী আমরা মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ রাখি। এখন রাস্তায় কারা মারামারি করেছে বা ডিভাইডারের রড (সড়ক-বিভাজকের দণ্ড) কারা খুলেছে, সেটা তো আমরা বলতে পারব না। তাদের আমরা চিনি না। ঢাকা কলেজের ছেলেরাও পরবর্তীতে আলোচনায় বলেছেন, হেলমেট পরে যারা ছিলেন, তারা তাদের চেনেন না। সমষ্টিগতভাবে জিনিসটাকে আমরা তৃতীয় পক্ষ বলছি।’
‘এছাড়া বিভিন্ন লোক সেখানে উস্কানি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এরাই সমষ্টিগতভাবে তৃতীয় পক্ষ। তবে, এখন তৃতীয় পক্ষের চেয়ে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে হেলমেট পরে যারা ছিলেন, তারা অনেকেই শিক্ষার্থী। তদন্তে বের হয়ে আসবে প্রকৃত দোষী কারা। সিটি করপোরেশনকেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ (সড়ক-বিভাজক) পুনরায় মেরামতের জন্য বলেছি। আশা করছি দ্রুতই সব ঠিক হয়ে যাবে’— বলেন নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির এ নেতা।
এদিকে, ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার ও ভাঙা দণ্ডগুলোর বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আ স ম ফেরদৌস আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এগুলো পুনঃস্থাপনের চেষ্টা চলছে। সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে কোথায় কী প্রয়োজন, তার রিপোর্ট তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
‘আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ অংশের (নূরজাহান মার্কেটের সামনে থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত) ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-বিভাজকগুলো প্রতিস্থাপন করা হবে’— এমনটি জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অঞ্চল- ১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মিঠুন চন্দ্র শীল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘অনেক স্থানে সড়ক বিভাজকের মধ্যকার রড ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত আমদের যে এরিয়া (এলাকা) রয়েছে সেখানে সড়ক-বিভাজকের মাঝের লোহার রড বা পাত বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কলাবাগান মাঠ পর্যন্ত কাজ হয়েছে।’
‘নিউ মার্কেটেও কাজ শুরু হয়েছে। শুরুতে ক্ষতিগ্রস্ত ফুটওভার ব্রিজের মেরামত হচ্ছে। এরপর রোড ডিভাইডারের কাজ হবে’— বলেন ডিএসসিসির ওই কর্মকর্তা।
সংঘর্ষের সময় লোহার দণ্ড খুলে নেওয়ায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে— সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ওখানে আগে থেকেই অনেকগুলো পোস্ট (থাম/দণ্ড) মিসিং (অনুপস্থিত) ছিল। তারপরও ওরা (হামলায় অংশগ্রহণকারীরা) অনেকগুলো পোস্ট নিয়ে গেছে। আসলে ওখানে ক্ষতি নিরূপণের চেয়ে নতুন করে পোস্ট স্থাপনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংঘর্ষের সময় কয়টা পোস্ট তারা নিয়ে গেছে, সেটি আমরা স্পট থেকে শুনিনি। আশা করছি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই রোড ডিভাইডারের মধ্যে নতুন দণ্ড স্থাপন করতে পারব।
এদিকে, ধ্বংসাত্মক কাজের সঙ্গে যারাই জড়িত, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে— জানান নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স ম কাইয়ুম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এখানে তৃতীয় পক্ষ বলে আমরা কিছু মনে করি না। যে বা যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চলছে। অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরের ঘটনায় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অপরাধী শনাক্তের চেষ্টা চলছে।’
আরএইচটি/এমএআর