‘অপরাধীরা’ লেখকের ঘনিষ্ঠ!
ছাত্রলীগকে ‘শুদ্ধ’ সংগঠন হিসেবে দেখতে মাদকের বিরুদ্ধে বরাবরই কঠোর নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। কিন্তু মাদক, বিবাহিত ও নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতারাই নাকি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন! যদিও উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেনসিডিলসহ ছাত্রলীগের তিন কেন্দ্রীয় নেতা আটক হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তারা হলেন- ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি জিয়াসমিন শান্তা, এম সাজ্জাদ হোসেন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর জব্বার রাজ। তারা সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের অনুসারী। লেখকের সব প্রোগ্রামে তারা উপস্থিত থাকেন।
মাদকদ্রব্যসহ তিন নেতার আটকের খবরে আলোড়ন তৈরি হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও। এ নিয়ে সংগঠনের ভেতরে চলছে সমালোচনা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও।
নাসিরনগর উপজেলা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ। তবে সহ-সভাপতি জিয়াসমিন শান্তা, এম সাজ্জাদ হোসেন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর জব্বার রাজ নাসিরনগর না গিয়ে প্রাইভেটকারে বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরায় যান। চান্দুরা সড়কের তেলের পাম্পের সামনে থেকে তাদের ২০ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক করে বিজয়নগর থানা পুলিশ
জানা যায়, নাসিরনগর উপজেলা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ। তবে সহ-সভাপতি জিয়াসমিন শান্তা, এম সাজ্জাদ হোসেন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর জব্বার রাজ নাসিরনগর না গিয়ে প্রাইভেটকারে বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরায় যান। চান্দুরা সড়কের তেলের পাম্পের সামনে থেকে তাদের ২০ বোতল ফেনসিডিলসহ আটক করে বিজয়নগর থানা পুলিশ। তাদের ছাড়িয়ে নিতে থানায় ছুটে যান জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত শোভন ও বিজয়নগর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম মাহবুব হোসেন।
থানায় উপস্থিত হয়ে বিজয়নগর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম মাহবুব হোসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের ছাড়তে পুলিশের ওপর চাপ দেন। পরে গাড়িচালক মো. রমজানকে থানায় রেখে বাকি তিন নেতাকে ছাড়িয়ে আনা হয়। আটক গাড়িচালক রমজানের বিরুদ্ধে পরে মামলা দেয় পুলিশ।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন জায়গায় সম্মেলন, জাতীয় কর্মসূচি, বিভিন্ন ইউনিটে শীর্ষ নেতৃত্বের সফর, মধুর ক্যান্টিনের রাজনীতি, লেখকের বাসার সামনে আড্ডাসহ বিভিন্ন জায়গায় ওই তিন কেন্দ্রীয় নেতা সাধারণ সম্পাদক লেখকের সঙ্গী হিসেবে উপস্থিত থাকেন।
শুধু তারা নন; কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সুব্রত হালদার বাপ্পী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজীর হোসেন নিশি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক সম্পাদক আল আমিন রহমানও লেখক ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত। যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মাদক সেবন, মারধর, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সুব্রত হালদার বাপ্পী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসেন নিশি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক সম্পাদক আল আমিন রহমানও লেখক ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত। যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মাদক সেবন, মারধর, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে এসেছে
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতি-ছিনতাই করা সংঘবদ্ধ চক্রের মূলহোতা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সুব্রত হালদার বাপ্পী। যাত্রাবাড়ী থানায় দিনদুপুরে র্যাব পরিচয়ে ছিনতাই করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বাপ্পীর বিরুদ্ধে এমন তথ্য পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ব্যক্তিজীবনে বিবাহিত ও সন্তানের জনক তিনি। তার কোনো ছাত্রত্ব নেই। তারপরও তাকে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পদে পদায়ন করেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। কারণ, বাপ্পী লেখকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তার এলাকায় (যশোর) বাড়ি। বর্তমানে এ নেতা ছাত্রলীগের পদ ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। লেখকের বন্ধু ও এলাকার নেতা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
আবদুর জব্বার রাজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন জায়গায় কমিটিকে কেন্দ্র করে আর্থিক লেনদেন ও অন্যান্য সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সম্মেলনে যাওয়ার পথে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসাইন শোভনের কাছ থেকে মাদকের উপঢৌকন নিতে গিয়ে পুলিশের কাছে আটক হন তিনি। এর আগে অমর একুশে হল ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালীন আনন্দবাজার এলাকায় বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদাবাজির খবর প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও ব্যবসার অভিযোগ পাওয়া যায়। শোভন-রাব্বানীর কমিটিতে তিনি উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক পদ পান। লেখক ভট্টাচার্য সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তাকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে পদায়ন করা হয়।
২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী দাস তন্বীকে মারধর করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজীর হোসেন নিশি। তার সঙ্গে ছিলেন সহ-সভাপতি জিয়াসমিন শান্তা। ওই ঘটনায় হত্যাচেষ্টা মামলা করেন তন্বী। পরে আদালত নিশি ও শান্তাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এছাড়া, চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এহসানুল হক ইয়াসিরের মাথা ফাটিয়ে দেন বেনজির হোসেন নিশি। এ ঘটনায় নিশির বিরুদ্ধে আরও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়।
লেখকের আরেক ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক সম্পাদক আল আমিন রহমান। তার বিরুদ্ধে সাত কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্তি বাতিলের আন্দোলনে ছাত্রী উত্ত্যক্ত ও যৌন নিপীড়ন এবং ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের বৈশাখী কনসার্টে হামলার অভিযোগ রয়েছে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে ভালোবাসা দিবসের কনসার্টে লাখ টাকার চাঁদা দাবি করে কনসার্ট বন্ধ করে দেওয়ারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে তিনি জাসদ ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার গবেষণা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
অভিযোগ ওঠা ছাত্রলীগ নেতৃত্বের সবাই লেখক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ। এ কারণে ওই ঘটনার কোনোটিতে কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব— অভিযোগ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যারা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ কারণে বারবার এমন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধীরা যেহেতু সংগঠনের নেতা, সেহেতু এক্ষেত্রে জয়-লেখকের দায়বদ্ধতাও রয়েছে। অপরাধীদের কারণ দর্শানো নোটিশ বা অপরাধ বেশি হলে শাস্তি দেওয়া উচিত। যদি এসবের কোনোটাই না করা হয় তবে তারা আরও বেপরোয়া হবে। অবশ্যই তাদের (জয়-লেখক) এ দায় নিতে হবে।’
২০ বোতল ফেনসিডিলসহ আটকের বিষয়ে জিয়াসমিন শান্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টি মিথ্যা। আমি কোনোভাবেই ওই ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলাম না।’ ছাত্রলীগের জুনিয়র নেত্রীকে মারধরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মারধরের সময় আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। পরে ঝামেলা মিটাতে গিয়ে বিপদে পড়ি। এখন যেহেতু বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, আদালতই সিদ্ধান্ত নেবেন আমি দোষী নাকি নির্দোষ।’
নিজ সংগঠনের নেতাদের মারধরের অভিযোগে হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি বেনজির হোসেন নিশির সঙ্গেও যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। তার দাবি, ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করা হয়েছে।’ এ সময় তিনি নিজেকে ‘ব্যস্ত বলে’ পরে যোগাযোগ করবেন বলে জানান।
অভিযুক্ত সহ-সভাপতি এম সাজ্জাদ হোসেন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর জব্বার রাজের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাদের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
নিজ অনুসারীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লেখক ভট্টাচার্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বেনজির হোসেন নিশি ও জিয়াসমিন শান্তার বিরুদ্ধে যে মামলা রয়েছে সেটি আদালতের রায়ের ওপর নির্ভর করবে। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলো মিথ্যা।’
অপরাধ করেও কেন পার পেয়ে যাচ্ছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ— জানতে চাওয়া হলে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন কখনওই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেইনি। তিনি কার ঘনিষ্ঠ, কার রাজনীতি করেন— সেটা দেখার বিষয় নয়। অন্যায়কে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই।
‘একজনের বিরুদ্ধে টানা দুইটা মামলা হলো, তাও নিজ সংগঠনের নেতাদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগে— এটা তো দুঃখজনক। তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা উচিত ছিল, আমি থাকলে সেটাই করতাম। যে দুষ্কৃতিকারী, তার তো কোনো পরিচয় থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, যেহেতু বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে; তারপরও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিষয়গুলো ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র নেতাদের জানানো উচিত। অথচ, গত কমিটিতে যারা কোনো অন্যায় করেনি তাদের অনেককে বলির পাঠা বানানো হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক।
এইচআর/এমএআর/