সাজানো অভিযানে ভুয়া সাক্ষী, জড়িত ডিবির পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্তারা!
জাল টাকা উদ্ধার অভিযানের ‘ভুয়া’ গল্প সাজানো হয়। সেই ভুয়া গল্প বাস্তবে রূপ দিতে ‘ভুয়া’ সাক্ষী সংগ্রহ করা হয়। তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ‘ভুয়া’ জবানবন্দি। খোদ পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে জাল টাকা উদ্ধার অভিযানের নামে ‘ডিবি পুলিশের অসৎ উদ্দেশ্য পরিষ্কার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা গেছে, অভিযানে অংশ নেওয়া ডিবি পুলিশের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা ‘ভালো কাজের স্বীকৃতি’ হিসেবে ৩৬৮টি পুরস্কার পেয়েছে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তের পর ভুয়া অভিযান সাজানো এসব কর্মকর্তার পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ভুয়া অভিযান সাজানোর অভিযোগ ওঠা ডিবি পুলিশের ওই কর্মকর্তা ও সদস্যরা হলেন- পুলিশ ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) তপন কুমার ঢালি (৭৬টি বিভাগীয় পুরস্কার), এসআই দেওয়ান উজ্জ্বল হোসেন (ছয়টি বিভাগীয় পুরস্কার), এসআই সোহেল মাহমুদ (৬৭টি বিভাগীয় পুরস্কার), এএসআই মমিনুল হক (২৫টি বিভাগীয় পুরস্কার), এএসআই নাজমুল হক (২৭টি বিভাগীয় পুরস্কার), এএসআই আবুল বাশার মিয়া (২৮টি বিভাগীয় পুরস্কার), এএসআই জিয়াউর রহমান (৬১টি বিভাগীয় পুরস্কার), কনস্টেবল মো. গোলাম সারোয়ার (২৫টি বিভাগীয় পুরস্কার) ও কনস্টেবল নয়ন কুমার দাস (৩৩টি বিভাগীয় পুরস্কার)। যদিও নয়ন কুমার দাস ছাড়া বাকিরা নানা অপরাধে পুলিশের শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন।
যে ভুয়া অভিযানের গল্প সাজান তারা
নয় কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য, জবানবন্দি ও মামলা অনুযায়ী ঘটনাটি ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের। সেদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি-পূর্ব) পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, মতিঝিল থানা এলাকার ফকিরাপুল মাছবাজারের পশ্চিম পাশের একটি গলিতে দুজন জাল টাকা ক্রয়-বিক্রয় করছেন। তারা হলেন- হাসান মজুমদার ও সোহেল রানা। পুলিশ দেখে তারা পালানোর চেষ্টা করেন। পরে তাদের আটক করে তল্লাশি চালানো হয়। হাসানের কাছে থাকা একটি হাতব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার মোট ২০টি বান্ডিল অর্থাৎ ২০ লাখ জাল টাকা উদ্ধার করা হয়। আর সোহেল রানার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার হয়।
অভিযান শেষে তাদের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে জাল টাকার মামলা করেন অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া ইন্সপেক্টর তপন কুমার ঢালী।
বিভাগীয় তদন্তে যা পেল পুলিশ
জাল টাকা উদ্ধার অভিযানের বিষয়ে অভিযোগ আনেন ভুক্তভোগী হাসান মজুমদার। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে পুলিশের গুলশান বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি, প্রশাসন ও ক্যান্টনমেন্ট জোন) মো. সাহেদ মিয়া প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ঢাকা মেট্রো বিশেষ ট্রাইব্যুনাল- ১৫ এর সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ তেহসিন ইফতেখারের কাছে জমা দেন।
তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় মৌখিকভাবে ৩২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের লিখিত জবানবন্দি নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে অভিযান পরিচালনাকারী নয় কর্মকর্তাও ছিলেন। এছাড়া গোপন অনুসন্ধান এবং দালিলিক কিছু কাগজপত্র পর্যালোচনাও করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনের অনুসন্ধান ও সাক্ষ্য পর্যালোচনা অংশে বলা হয়, ডিবি পুলিশ প্রথমে হোটেল বন্ধু আবাসিকের বাবুর্চি মো. সোহেল রানাকে আটক করে। তাকে নিয়ে হোটেল বন্ধুর কাউন্টারে (রিসিপশন) যায়। হোটেলে অবস্থানরত ম্যানেজার হাসান মজুমদারকে কোনো রূপ জিজ্ঞাসাবাদ বা তল্লাশি না করেই হাতকড়া পরানো হয়। যা হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়। সিসিটিভি ফুটেজে আরও দেখা যায়, ডিবি পুলিশ হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধের তৎপরতা চালান। এমন তৎপরতায় তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের বিষয়টি পরিষ্কার হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে চার্জশিট দেয় পুলিশ।
তবে, মামলার চার্জশিটে উল্লিখিত অভিযোগকারী গ্রেফতারের ঘটনাস্থল এবং সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে হাসানকে হোটেল কাউন্টার থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাকে তল্লাশি করে কোনো জাল টাকা উদ্ধারের দৃশ্য পাওয়া যায়নি সিসিটিভি ফুটেজে।
তদন্তে স্পষ্টভাবে আরও বলা হয়েছে, হাসান মজুমদারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার বিষয়ে এফআইআরে (এজাহার) ঘটনাস্থল এবং জাল টাকা উদ্ধারের বিষয়ে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। জাল টাকা উদ্ধারের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়নি।
চার্জশিটে সাক্ষীদের জবানবন্দির হুবহু মিল
ওই ঘটনায় আদালতে জমা দেওয়া মামলার চার্জশিটে সাক্ষী হিসেবে ফকিরাপুলের মিন্টু, রাজু, শরিফুল ইসলাম আকাশ ও কামরুজ্জামান রুচির জবানবন্দি সংযুক্ত করা হয়। তাদের জবানবন্দির সঙ্গে এজাহারের ঘটনার হুবহু মিল পাওয়া যায়। এমনকি দাড়ি-কমারও কোনো পরিবর্তন নেই সেখানে। শুধু তাদের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা ছিল ভিন্ন।
চার্জশিটে বর্ণিত অন্য সাক্ষীদের জবানবন্দির মধ্যে ডিবি পূর্বের এএসআই জিয়াউর রহমান, এএসআই সোহেল মাহমুদ, এএসআই মোমিনুল হক, এএসআই নাজমুল হক প্রধান, এএসআই আবুল বাশার, কনস্টেবল নয়ন কুমার, কনস্টেবল গোলাম সারোয়ারও আদালতের কাছে হুবহু জবানবন্দি দেন। সেখানেও (সাতজনের জবানবন্দি) বিন্দুমাত্র এদিক-সেদিক নেই।
পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে সাক্ষী বললেন ভিন্ন কথা
জাল টাকা উদ্ধার অভিযানের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি নেওয়া হয়। তার নাম মো. মিন্টু। তিনি ফকিরাপুল বাজারে মাছ বিক্রি করেন। ‘ঘটনা দেখেছেন’ মর্মে আদালতে সাক্ষী দেন তিনি। পুলিশের বিভাগীয় তদন্তে ডাকা হয় সেই মিন্টুকে। বলেন, “সেদিন সেখানে অনেক লোক ছিল। উপস্থিত লোকজনের সামনে ডিবি পুলিশ এসে বলে ‘এগুলো জাল টাকা, আপনাদের সাক্ষী দিতে হবে।’ এরপর ডিবি পুলিশ আসামিদের (কথিত) নিয়ে চলে যায়।”
মন্তব্য নেই পুলিশের
ডিবি পুলিশের এমন সাজানো অভিযানের বিষয়ে ডিএমপি মিডিয়া ও পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি যিনি আদালতে পাঠিয়েছেন তার সঙ্গে কথা বলুন।’
ঘটনাটি নিয়ে পুলিশের গুলশান বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি, প্রশাসন ও ক্যান্টনমেন্ট জোন) মো. সাহেদ মিয়া তদন্ত করেন। তবে, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। আদালতের চাহিদা অনুযায়ী তার প্রতিবেদনের একটি ফটোকপি সরবরাহ করেন বর্তমান ক্যান্টনমেন্ট জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইফতেখারুল ইসলাম।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের কাছে আদালতের একটা জিজ্ঞাসা ছিল। তারা (আদালত) তদন্ত প্রতিবেদনের কাগজ খুঁজে পাচ্ছিল না। আদালত জানতে চেয়েছিল, প্রতিবেদনটি আমাদের কাছে আছে কি না। এটি (তদন্ত প্রতিবেদন) যেহেতু সাহেদ স্যার (এডিসি সাহেদ মিয়া) সম্পন্ন করে গেছেন, আমি শুধু এর ফটোকপি করে আদালতে পাঠিয়েছি।’
‘এটি আমার প্রতিবেদন না। প্রতিবেদন তো আমি তৈরি করিনি, তদন্তেও সংযুক্ত ছিলাম না। এ কারণে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না’— বলেন ওই কর্মকর্তা।
ডিবি পুলিশের সাজানো ওই অভিযানের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি দেখেছি, সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে ডিবি পুলিশের মামলার কোনো মিল নেই। ডিবি পুলিশ তো সাধারণ পুলিশের চেয়েও অ্যাডভান্স। সাধারণ মানুষকে নীরবে-নিভৃতে সহযোগিতা করার কথা ডিবির। অথচ, তাদের কারণে ছয় বছর ধরে হাসান আদালতে ঘুরতে ঘুরতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, পুলিশ নিজেই যদি আইন হাতে তুলে নেয়, তারা যদি চাঁদাবাজি করে, তাহলে এ সমাজকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। ডিবি পুলিশের এমন অপরাধের বিষয়ে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
এআর/এমএআর/