তারেক মাসুদ : যার জীবনই সিনেমা, সিনেমাই জীবন
সিনেমা ঘোর। সিনেমা নেশা। স্বপ্ন হলেও সিনেমা বাস্তবতার অধিক বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার নেশায় যিনি ডোবেন, তার জীবন হয়ে যায় সিনেমা আর সিনেমাই হয়ে যায় জীবন। এমন ধ্যানমগ্ন চলচ্চিত্রকার বাংলাদেশ খুব বেশি পায়নি। হাতে গোনা দু-চারজন যাদের পেয়েছে, তাদের অন্যতম তারেক মাসুদ।
মাদরাসার সাবেক ছাত্রটি ভাবলেন বিদেশে পড়তে যাবেন। পড়বেন সিনেমায়। তারপর ক্যামেরায় তুলে আনবেন জীবন। সিনেমা হবে তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার। সত্য ও সুন্দরের পক্ষে সিনেমা হবে তার কণ্ঠস্বর। টাকা-পয়সা জোগাড় করে ফেললেন কষ্টে-সৃষ্টে। বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, তখন এক সন্ধ্যায় তিনি বাসায় ফিরতে বাসে উঠেছেন। বাস ছুটতে শুরু করেছে। ছুটে চলেছে তার ভাবনার মেইল ট্রেন। তিনি ভাবলেন, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, বিদেশে যাবেন না। যাবেন নড়াইলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বদ্ধ ক্লাসে না বসে বরং ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পরা যাক। বানাতে বানাতে হাতে-কলমে শেখা যাক সিনেমা বানানো। বানাবেন বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র।
যেই ভাবনা সেই কাজ। যুবক চলতে শুরু করলেন। সঙ্গী হলেন বন্ধু মিশুক মুনীর। মিশুক তরুণ সিনেমাটোগ্রাফার। রাইজিং। সেভাবে কাজের অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু ভালোবাসা আছে, উদ্যম আছে, আছে স্বপ্ন। দুই বন্ধু ঢাকা থেকে ক্যামেরা হাতে ছুটে গেইলে সুলতানের কাছে। প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে, জীবনের কাছে। বলা ভালো, সুলতান নামের এক ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের’ কাছেই। আর শুরু করলেন ‘আদম সুরত’র চিত্র ধারণ।
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের শুরুটা এভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে যিনি সেই টাকায় সিনেমা বানাতে বানাতে শিখতে চেয়েছিলেন সিনেমা নির্মাণ। বিদেশে না গিয়ে বাংলার এক গ্রামে যাওয়া যে-তরুণ একদিন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করেছিলেন আমাদের দেশ-জাতি-ভাষা-সংস্কৃতি আর চলচ্চিত্রের।
তারেক মাসুদের বন্ধু বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক ড. সাজেদুল আওয়াল। তিনি একবার বলেছিলেন, তারেকের সাথে আমাদের অন্য বন্ধু বা আমার পার্থক্যটা হচ্ছে, আমরা ভেবেছিলাম অনেক জেনে-বুঝে-শিখে তবেই সিনেমা বানাব। আর তারেক ভেবেছিলেন বানাতে বানাতেই একদিন শিখে যাবেন। ফলে তারেক আসলেই একদিন নির্মাতা হয়ে গেলেন। বিশ্ব দরবারে তুলে ধরলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে। আর আমরা এখনও শিখছি আর ভাবছি। তবু সিনেমাটা বানাতে পারিনি। তারেক আজ চলচ্চিত্রকার। আর আমরা তার সমালোচক।
সাজেদুল আওয়াল বলেন, তাই তরুণদের বলব, তারেকের মতো নেমে পড়ুন ক্যামেরা হাতে। যদি আপনার কিছু বলার থাকে। যদি চান সিনেমা হয়ে উঠুক আপনার কণ্ঠস্বর।
তারেকের আসলেই অনেক কিছু বলার ছিল। সিনেমাকে মাধ্যম করে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন চিত্রের মোড়কে, গল্পের আদলে বলে যাবেন জীবন-ফুলের গল্প, মানবিকতার কথা। সত্য ও সুন্দরের কথা বলবেন। প্রতিবাদ জানাবেন অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে। সারাটা জীবন তিনি এ কাজই করে গেছেন। করতে গিয়ে ভীষণ রকম অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ভুগেছেন। মাসের পর মাস বাসা ভাড়া দিতে পারেননি। ছবির মতো ঝাঁ চকচকে জীবন দূরে থাক, মৌলিক চাহিদা পূরণ করে ভদ্রস্থ জীবন যাপনই কঠিন হয়ে উঠেছে সময়ে সময়ে। কিন্তু তিনি দমে যাননি। পিছু হটেননি। চলচ্চিত্রের ঘোরে কষ্টে দিন কাটিয়েছেন বন্ধু, সহযোদ্ধা, স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদকে নিয়ে। মৌলিক চাহিদার সাথে আপস করেছেন। আপস করেননি মূল্যবোধের সাথে, সিনেমা সৃষ্টিতে।
তিনি যে-সিনেমায় বিশ্বাস করেন, সে সিনেমাই বানিয়ে গেছেন। তার সিনেমা প্রথাগত পরিবেশকদের দরজায় দাঁড়াতে পারেনি। পায়নি প্রেক্ষাগৃহ। এত পরিশ্রমের সিনেমা যখন দর্শকের কাছে না পৌঁছায় তখন হতাশার চূড়ান্তে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি হতাশ হবেন না। পিছিয়ে পড়বেন না। বরং বিকল্প পথ খুঁজে নেবেন, এমন ধারারই মানুষ তিনি। তাই কাঁধে তুলে নিলেন প্রোজেক্টর। দর্শকের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে হাজির হলেন নিজের সিনেমা নিয়ে।
এই হচ্ছেন তারেক মাসুদ। এক অনন্য স্বপ্নবাজ। আপসহীন সৈনিক। নিজের স্বপ্নের কাছে সৎ আর প্রজ্ঞার কাছে দায়বদ্ধ। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের মহীরুহ। এই সময়ের সিনেমা-যাত্রীরা কঠিন মরুপথে চলতে চলতে যে-মহীরুহের দিয়ে তাকিয়ে শীতল ছায়া অনুভব করেন। যে-মহীরুহের ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হন আর হয়ে ওঠেন সবুজাভ।
তাই তারেক মাসুদ শুধুই চলচ্চিত্রকারের নাম নয়। তিনি এক স্বতন্ত্র স্বপ্নবাজ। অনস্বীকার্য কণ্ঠস্বর। এক অপরাজিত অনুপ্রেরণা।
বিশ্ববরেণ্য এই চলচ্চিত্রকার ১৯৫৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’ (২০০২) কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডিরেক্টর ফোর্টনাইট’ পুরস্কারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করে। ২০১০ সালে মুক্তি পায় তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’। তার গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র ‘অন্তর্যাত্রা’ নির্মিত হয় ২০০৬ সালে।
‘মুক্তির গান’ ও ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নির্মাতার উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘ইন দ্য নেইম অব সেফটি’, ‘আ কাইন্ড অব চাইল্ডহুড’, ‘ভয়েসেস অব চিলড্রেন’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তার বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- ‘সোনার বেড়ী’ (১৯৮৫), সে (১৯৯৩), নরসুন্দর (২০০৯), শিশু কথা (১৯৯৭), নিরাপত্তার নামে (১৯৯৯), ইউনিসন (অ্যানিমেশন)।
তারেক মাসুদের স্বপ্নের চলচ্চিত্রটির নাম ছিল ‘কাগজের ফুল’। কাগজের ফুল ফোটাতে তিনি দিনের পর দিন পুরো টিম নিয়ে পরিশ্রম করছিলেন। সব প্রস্তুতি যখন শেষ হওয়ার পথে, তখন একদিন পথে নেমে এলো কালো ছায়া। এদেশের পথে পথে ওঁত পেতে থাকা কালো সেই ছায়া গ্রাস করে নিলো বাংলা চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে।
কাগজের ফুলের লোকেশন দেখে মানিকগঞ্জ থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিমিষেই ব্ল্যাক আউট! কেবল গাঢ় কালো অন্ধকার, কেবলই শোকের কালো ছায়া বাংলা চলচ্চিত্রের পর্দা জুড়ে, গাঢ় বিষাদ এ পৃথিবীর সিনে-উঠোন জুড়ে।
২০১১ সালের ১৩ আগস্টের এই কালো দিনে তারেক মাসুদের সাথে ঝরে যায় মিশুক মুনীরসহ আরও তিন প্রাণ। ঝরে যায় কাগজের ফুলটা!
কিন্তু স্বপ্ন ঝরে যায় না। স্বপ্নের রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই। তাই তারেক মাসুদ আজ এদেশের চলচ্চিত্র যোদ্ধাদের জন্য এক সবুজাভ বটবৃক্ষ। তারা ক্লান্ত হলে, বিষণ্ণ হলেই ‘তারেক-তমালের’ ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেন। বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে চাঙা করেন স্বপ্নকে। বাধা এলেই তারেকের দিকে তাকিয়ে অনুপ্রাণিত হন বিকল্প পথ খুঁজে চলার গতি বাড়ানোর।
এইচকে