ক্ষতি পোষাতে ‘পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই’ শিক্ষায়
করোনার কারণে ১৫ মাস বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অনলাইন, টেলিভিশন, রেডিওসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো তেমন কার্যকর হয়নি। এ কারণে শিক্ষা খাতের সার্বিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেটে সে ধরনের কোনো প্রতিফলন চোখে পড়েনি। স্বাভাবিকভাবে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে ‘হতাশ’ এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছর শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এবার সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসা সহায়ক হলেও এটি শিক্ষার সহায়ক নয়। করোনায় শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থ দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি বলেও মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজেট দেখে মনে হয়নি যে করোনায় শিক্ষার কোনো ক্ষতি হয়েছে। অন্য খাতের ক্ষতি দেখা গেলেও শিক্ষার ক্ষতি দেখা যাচ্ছে না। নীতিনির্ধারকরা বাজেটে শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দেয়নি বলে মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যবিত্তরা পড়ালেখা করেন। সেখানে ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। বেসরকারি ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিচ্ছে আর বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর আরোপ করা হচ্ছে— এটি অন্যায় বলে বিবেচিত হচ্ছে।
‘বাজেটে মেয়েদের কথা ভাবা হয়নি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা নিয়মিত কর দেন তাদের কর বাড়ানো হচ্ছে আর যারা ফাঁকি দেন তাদের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে।
‘দেশের মানুষের শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, অথচ শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তেমন কোনো পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে না পারলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া না হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুববে। সার্বিক বিষয় দেখে মনে হচ্ছে, বিদেশ থেকে মানুষ এনে দেশের উন্নয়ন করতে হবে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ২০ শতাংশ বরাদ্দের (বাজেট) প্রস্তাবনাটি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যেটি বাড়ানো হয়েছে সেটি অত্যন্ত সামান্য। আমরা আশা করেছিলাম বাজেটে এ খাতে বরাদ্দের একটা উল্লম্ফন ঘটবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। এটি দুর্ভাগ্যজনক।
‘বঙ্গবন্ধু সেই কবে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ চান। তার সময়ে তৈরি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বলছে, শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ৫ থেকে ৭ শতাংশ বরাদ্দ দরকার। বঙ্গবন্ধুর দলটি এখন ক্ষমতায়, কিন্তু তারা শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২ শতাংশের বেশি কিছুতেই বরাদ্দ দিচ্ছে না।’
‘এ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাত’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যদি সত্যিকার অর্থে এ ক্ষতি আমরা মোকাবিলা করতে চাই এবং অনলাইন-অফলাইন শিক্ষাকে সক্ষমতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে সেখানে তো কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া উচিত।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাজেটে শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা অপর্যাপ্ত। শিক্ষায় যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কলকারখানা বন্ধ হলে এবং শ্রমিকরা বিদেশে যেতে না পারলে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাচ্ছে না। সে বিষয়ে মনে হয় কেউ উদ্বিগ্ন নন। এ উদাহরণ থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শিক্ষায় যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।’
২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষা খাতের দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য ৭১ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বৃহস্পতিবার (৩ জুন) বিকেলে জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
একই সঙ্গে এটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘাটতির বাজেট হতে যাচ্ছে। ৫০তম এ বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। অনুদান বাদ দিলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
তবে, ঘাটতি পূরণের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এজন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। বৈদেশিক খাত থেকে নেওয়া হবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার এক কোটি টাকা।
এনএম/এমএআর