যে চার কারণে এইচএসসিতে খারাপ ফল
# করোনার প্রভাব
# ইংরেজিতে দুর্বলতা
# অনলাইন ক্লাস
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। গত বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৭.৩১ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৩ হাজার ৯১৭টি। অন্যান্য কিছু সূচকেও নেতিবাচক ফল হয়েছে এবার। ফলাফলের এ অবনমনের কারণ খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিকভাবে চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে শিক্ষাবোর্ডগুলো।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রভাব থাকার পরও এইচএসসিতে সবগুলো বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা, ইংরেজিতে ব্যাপক দুর্বলতা, যশোর শিক্ষাবোর্ড বিশেষভাবে খারাপ করা এবং করোনার সময়ের স্টাডি গ্যাপ এবার ফলাফলে ফেলেছে। এছাড়া, এ ব্যাচটি প্রায় এক বছর ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করেছে। এর প্রভাবও পড়তে পারে ফলাফলে।
অবশ্য শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, এই ফলাফল স্বাভাবিকই আছে, খারাপ নয়। করোনার আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে পাসের হার সাধারণত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের ঘরেই ছিল। মাঝে ২০২১ ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার বেড়ে ৯০ শতাংশের বেশি হয়েছিল। এর কারণ ছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া। এ বছর আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষায় ফেরায় ফলাফল ৮০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।
আরও পড়ুন
শিক্ষাবোর্ডগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার যারা এইচএসসি পরীক্ষায় বসেছিল তারা ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছিল। করোনার সময় এই ব্যাচটির সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় ওই বছর পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। একাদশ শ্রেণির শুরুতে ২০২১ সালে তারা স্বাভাবিক ক্লাস করতে পারেনি, অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। যদিও ২০২২ সালে পুরো এক বছর তারা ক্লাস করেছে। তারপরও এক বছর করোনার কারণে যে সমস্যা হয়েছিল তার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে।
এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবারের ফলাফল গত দুই শিক্ষাবর্ষের (২০২১ ও ২০২২) ফলাফলের চেয়ে বিশেষ। কারণ ওই দুই বছর বিশেষ ব্যবস্থায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় স্বাভাবিক ফলাফল হয়েছে। গত দুই বছরের ফলাফলের চিত্র মূলত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের। এছাড়া, সাধারণ নয়টি শিক্ষাবোর্ডে ইংরেজি পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে।
করোনার সময়ের প্রভাব এখন পড়েছে
কারোনা মহামারির আগের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে গড় পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে ওই বছর কোনো পরীক্ষা হয়নি। সেবার অটোপাস দেওয়ায় শতভাগ পাস ছিল। ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২২ সালে পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ ভাগ। এবার পাসের হার ৮০ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
এবারের এইচএসসিতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ এর এ চিত্র বলছে, করোনার আগে আর পরের বছরগুলোর ফলাফলের চিত্র কাছাকাছি।
পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমার ব্যাখ্যায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, করোনার আগের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখবেন পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটি এমনই ছিল। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালের পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হয়েছিল, তাই শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সুবিধা পেয়েছিল। যেটা এবার ছিল না।
পূর্ণ নম্বরের পরীক্ষার প্রভাব
করোনা মহামারির কারণে ২০২১ এবং ২০২২ সালে পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়নি। ওই দুই বছর ৫০ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে ৭৫ শতাংশ সিলেবাসে পরীক্ষা হয়েছে। সে কারণে ওই দুই বছর ফলাফল ছিল যথাক্রমে ৯৫ দশমিক ২৬ ও ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এবারে সব বিষয়ে এবং পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। এ জন্য গতবারের চেয়ে এবার পাসের ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যখন বিষয় কম, কম সময়ে পরীক্ষা হয়েছে তখন সবার প্রস্তুতি অনেক ভালো। আর এবার সব বিষয়ে হয়েছে, পূর্ণ সময়ে হয়েছে। জিপিএ-৫ এর ক্ষেত্রে একটা ফারাক হতেই পারে। এটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়।
তিনি বলেন, আসলে এবারের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করতে হবে করোনা পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে। সেই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে আগের চেয়ে ফলাফল আসলে একটু ভালো হয়েছে।
যশোর শিক্ষাবোর্ডে খারাপ ফল
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার যশোর শিক্ষাবোর্ডের ফল অস্বাভাবিক খারাপ হয়েছে। এই শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এই শিক্ষাবোর্ডে খারাপ ফলের কারণে সার্বিক ফলাফল নেতিবাচক দেখাচ্ছে।
আন্তঃশিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার বলেন, যশোর শিক্ষাবোর্ডের খারাপ ফল হওয়ার কারণে সব বিভাগের ফলাফলে প্রভাব পড়েছে এবং গড় পাসের হার কমেছে।
ইংরেজিতে খারাপ ফল
বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব বিভাগের কমন আটটি বিষয়— বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি, পৌরনীতি এবং হিসাব বিজ্ঞানে গড় পাসের হার ৯০ শতাংশের বেশি। বিপরীতে সাধারণ নয়টি শিক্ষাবোর্ডে ইংরেজিতে গড় পাস করেছে মাত্র ৮২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এটাও সার্বিক ফলাফল খারাপের একটি কারণ। এছাড়া, দিনাজপুর বোর্ডে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে খারাপ ফল হয়েছে। এই বোর্ডে হিসাব বিজ্ঞানে পাস করেছে ৬৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
জানতে চাইলে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আহসান হাবীব ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বোর্ডে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীরা অস্বাভাবিক খারাপ ফল করার কারণে বোর্ডে গড় পাসের হার কমেছে। এছাড়া, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরাও বেশি ফেল করেছে। যার প্রভাব সার্বিক ফলাফলে পড়েছে।
সার্বিক ফলাফল খারাপ হওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, গতবার দুই বিষয়ে পরীক্ষা ছিল, এবার সব বিষয়ে হয়েছে। এছাড়া, এবার যারা পাস করেছে, তারা যখন করোনার সময়ে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ত, অনলাইনে সে সময়ে ক্লাসের কারণে অনেকেই ভিত্তি একটু দুর্বল ছিল। তবে নটরডেম কলেজে শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি আশা করেন, সবাই প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে।
এনএম/কেএ