সংকটের মধ্যেও কাগজ শিল্পের ব্যবসা রমরমা
• বসুন্ধরা পেপারের ৯ মাসে প্রকৃত বিক্রি হাজার কোটি টাকা
• কাঁচামালের দাম কমলেও বেড়েছে কাগজের দাম
করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এ মন্দার কারণে দেশ-বিদেশের শিল্প-কারখানাগুলো যখন সংকট অবস্থা পার করছে, ঠিক সেই সময়ে দেশের কাগজ শিল্পে চলছে রমরমা ব্যবসা। চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মুনাফা বেড়েছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের।
শুধু তৃতীয় প্রান্তিকেই নয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে মুনাফা বেড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। দেশের পুঁজিবাজারে কাগজ ও মুদ্রণ খাতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ভালো হয়েছে। প্রথমত, করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ডলার সংকট তৈরি হয়েছে; এ কারণে কাগজ ও মুদ্রণ জাতীয় পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তখন বাংলাদেশের এসব পণ্যের বাজারে দাম ইচ্ছা মতো বাড়ানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, করোনার প্রভাব কমার পর চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে দেশের স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। ফলে খাতা ও কাগজের চাহিদা বেড়েছে, বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির পরিমাণও। অপরদিকে, বিশ্ববাজারে কাগজের কাঁচামালের দাম কমেছে কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দাম কমেনি। কোম্পানিগুলো আগের দামেই কাগজ বিক্রি করছে।
তৃতীয়ত, প্রতিকূল পরিবেশেও গ্রাহকদের চাহিদা অনুসারে কাগজের ধরন পাল্টেছে। পাশাপাশি নতুন পণ্য যেমন নানা ধরনের টিস্যু, এয়ার ফ্রেশনার এবং প্রসাধন পণ্যেও বৈচিত্র্য এসেছে। এসব কারণে ব্যবসা রমরমা এবং মুনাফাও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
দেশে কাগজ ও মুদ্রণ খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। তারই পথে হাঁটছে মাগুরা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মনোসপুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ও পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড।
এদিকে, প্রাণঘাতী করোনার কারণে লোকসানে নিমজ্জিত থাকা হাক্কানি পাল্প কোম্পানি ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে লোকসান কমিয়ে এনেছে। ব্যবসা ভালো হওয়ার সুবাদে এখন মুনাফার আলো দেখতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
কর্তৃপক্ষরা জানাচ্ছেন, কাগজের দাম বাড়ার পাশাপাশি নতুন পণ্য যেমন নানা ধরনের টিস্যু, এয়ার ফ্রেশনার ও প্রসাধন পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। এ অর্থ মুনাফায় যোগ হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বেড়েছে। মুনাফা বাড়ায় সরকার এ খাত থেকে রাজস্ব বেশি পাচ্ছে। বছর শেষে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশ বেশি পাবেন।
দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে কাগজ ও মুদ্রণ খাতে ছয়টি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত রয়েছ। নিয়ম অনুসরণ করে এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা হলো- বসুন্ধরা পেপার মিলস, বাংলাদেশ মনোসপুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও হাক্কানি পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলিস লিমিটেড।
এছাড়া আরও দুটি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত রয়েছে। তারা হলো- খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড। এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সোনালী পেপার ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন (অক্টোবর ২০২২ থেকে ৩১ মার্চ ২০২৩, ছয় মাস সময়ের) প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে, খুলনা পেপার তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
বসুন্ধরা পেপার
২০১৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরার পেপারের তৃতীয় প্রান্তিকে পণ্য বিক্রি হয়েছে ১০০৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার। এর মধ্যে দেশীয় বাজারে বিক্রি হয়েছে ৯৬৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকার পণ্য। ১০৭ কোটি ৪ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশের বাজারে বিক্রি বেড়েছে ২৮ শতাংশ, দেশি বাজারে বিক্রি বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
হাজার কোটি টাকার বিক্রির মধ্যে বসুন্ধরা পেপার শুধু কাগজ পণ্য বিক্রি করেছে ৩৯০ কোটি ৮১ লাখ টাকার। টিস্যু পণ্য বিক্রি করেছে ৪২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকার। এ দুই ধরনের পণ্যে ১৮ ও ৩২ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে।
এছাড়া ডায়াপ্যান্ট, ডায়াপার, ন্যাপকিন, বেবি ওয়াইপ, ওয়েট টিস্যু, ফেস মাস্ক ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ওয়াইপসের মতো স্বাস্থ্যকর পণ্য বিক্রি ১৮ শতাংশ কমে ১৩৪ কোটি ৭৩ লাখ হয়েছে। তবে, এবার এয়ার ফ্রেশনার ও টয়লেট্রিজ পণ্য বিক্রি হয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি।
জুলাই ২০২২ থেকে ৩১ মার্চ ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট নয় মাসে কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৩৯ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৬৫৬ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মুনাফা বেড়েছে ৫১ শতাংশ। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে মুনাফা ছিল ২৫ কোটি ৮৯ লাখ ৪৯ হাজার ২৪৯ টাকা।
এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৩, তৃতীয় প্রান্তিকে মুনাফা বেড়েছে আট কোটি ৮৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৩৪ টাকা। যা ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল সাত কোটি ৮২ লাখ ৬ হাজার ১৪৮ টাকা।
ব্যবসা বাড়লেও ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্য খাতের খরচ বাড়ায় নিট আয় কমেছে প্রতিষ্ঠানটির। এ বিষয়ে বসুন্ধরা পেপার মিলসের মহাব্যবস্থাপক এম মাজেদুল ইসলাম বলেন, করোনার সময় বিক্রি কম হয়েছে। তবে করোনার পর চাহিদা ও বিক্রি বেড়েছে।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছর পণ্যের দাম বাড়ানো হয়, যা রাজস্বে প্রতিফলিত হয়। এছাড়া এ সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি বেড়েছে।’
‘এ-ফোর/এ-থ্রি, ব্যায়াম বই ও প্যাকেজিং পেপারের মতো পণ্য বিক্রি থেকে মুনাফা আসত, কিন্তু ২০২০ সালে করোনায় টিস্যু ও স্বাস্থ্যকর পণ্য বিক্রি বেড়েছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চলতি বছর ফেসিয়াল, পেপার ন্যাপকিন, ওয়ালেট টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, কিচেন টাওয়েল ও হ্যান্ড টাওয়েলের মতো টিস্যু পণ্য বিক্রি বাবদ গত বছরের চেয়ে আয় অনেক বেশি হয়েছে।’
বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি
তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় বা মুনাফা হয়েছে এক টাকা ৬৫ পয়সা। যা ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ছিল এক টাকা ৫৭ পয়সা। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে আট পয়সা করে।
চলতি অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে চার টাকা ৭৯ পয়সা। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল দুই টাকা ৭২ পয়সা। অর্থাৎ ৭৭ শতাংশ মুনাফা বেড়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
একই গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে এক টাকা ২৫ পয়সা করে। যা ২০২২ সালের একই সময়ে ছিল ৮৬ পয়সা।
অর্থাৎ ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের একই সময়ে মুনাফা বেড়েছে ৩৯ পয়সা করে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে তিন টাকা চার পয়সা। যা এর আগের বছর ছিল দুই টাকা ৯৭ পয়সা। অর্থাৎ নয় মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে সাত পয়সা।
চলতি অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে হাক্কানি পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলসের ব্যবসা বেড়েছে ১৩৫ শতাংশ। ফলে তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৩ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি ২০ পয়সা লোকসান থেকে আয় ১২ পয়সা, অর্থাৎ মুনাফায় ফিরেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির তিন প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ৭০ পয়সা। সেখানে আগের বছর একই সময়ে ছিল এক টাকা ছয় পয়সা।
এদিকে, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং এর তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন ৯ মে পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। প্রতিষ্ঠানটির ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ছয় পয়সা। এর আগের বছর শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল এক টাকা ৯৬ পয়সা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা ভালো হওয়ায় শেয়ারপ্রতি এক টাকা ৯০ পয়সা করে লোকসান কমিয়ে এখন মুনাফার অপেক্ষায় রয়েছে।
খুলনা প্রিন্টিং-এর মতো অপর প্রতিষ্ঠান সোনালী পেপার ৩১ এপ্রিলের মধ্যে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, একটি তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তার ত্রৈমাসিক আর্থিক বিবরণী ঘোষণা করার জন্য এক মাস সময় পায়। প্রতিষ্ঠানটি চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকেরও আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
তবে, সোনালী পেপার চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিক প্রকাশ করেছে। তাতে দেখানো হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় করেছে তিন টাকা চার পয়সা। যা এর আগের বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ১৯ পয়সা।
এমআই/এফকে/ওএফ