২ কোটি ২০ লাখ টাকা সাদা করেন সরকারি এই কর্মকর্তা!
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম। ২০১১ সালে দশম গ্রেডে এ পদে যোগ দেন তিনি। বর্তমান কর্মস্থল বরিশালের সওজ অফিস। সামান্য একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন। টাকার পরিমাণও কম নয়, দুই কোটি ২০ লাখ!
আয়কর আইনের ১৯-এর এএএএএ ধারার বিশেষ সুযোগ নিয়ে ২০২০ সালে নগদ টাকা সাদা করেছেন তিনি। ওই ধারায় একজন করদাতা নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা টাকার ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ পান।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সন্দেহ, সমুদয় টাকা ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমের অর্জন করেছেন ওই কর্মকর্তা। এর আগে ২৭ অক্টোবর অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় স্ত্রী ও ভাইসহ আসামি হন নজরুল ইসলাম।
ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ২১ কোটি টাকা অর্জনের অভিযোগে প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন ও ভাই তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় বাদী হন সংস্থাটির উপপরিচালক এদিপ বিল্লাহ। দুদকের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন।
মামলার এজাহারে নজরুল ইসলাম, তার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন ও ভাই মো. তরিকুল ইসলামের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের নামীয় হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ২১ কোটি এক লাখ টাকা জমা ও উত্তোলনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি বলা হয়। ওই অর্থ ব্যাংকে জমা না থাকলেও এর বৈধ কোনো উৎস পাওয়া যায়নি।
এজাহারে বলা হয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। হিসাব খোলা থেকে ২০২০ সালের ৫ জুলাই পর্যন্ত তিন বছরে চার কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা জমা করার পর তা তোলেন। এভাবে তার হিসাবে মোট নয় কোটি ৮৯ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নজরুল ইসলামের ভাই মো. তরিকুল ইসলামের নামেও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় আরও একটি হিসাব খোলা হয়। সেখানেও ২০২০ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত ছয় কোটি এক লাখ টাকার লেনদেন হয়।
একই প্রক্রিয়ায় নজরুল ইসলামের স্ত্রী (গৃহিণী) শাহনাজ পারভীনের হিসাবেও ৭৫ লাখ টাকার এফডিআরসহ আরও অর্থ লেনদেন হয়। এভাবে নজরুল ইসলামসহ তাদের ব্যাংক হিসাবে মোট ২১ কোটি এক লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
এছাড়া বরিশাল সদরের দক্ষিণ আলেকান্দায় নিজের নামে ৮.৫০ শতাংশ জমির ওপর চারতলা বাড়ি নির্মাণেরও তথ্য পায় দুদক।
এ বিষয়ে দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, অবৈধভাবে অর্জিত ওই অর্থ বৈধ করতে স্ত্রী ও তার ভাইয়ের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেন নজরুল ইসলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) চোখে তাদের লেনদেনের অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়ে। ওই সূত্র ধরেই শুরু হয় অনুসন্ধান।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছরের মার্চ মাসে নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর ব্যাংকের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যসহ একটি প্রতিবেদন দুদকের হাতে আসে। এরপরই দুদক উপপরিচালক মাজেদুল ইসলাম ও উপপরিচালক এদিপ বিল্লাহর নেতৃত্বে একটি টিম গঠনের পর মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অনুসন্ধান পর্যায়ে দুই দফায় নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তিনি হাজির হয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। বরিশাল থেকে ডাকযোগে লিখিত বক্তব্য পাঠান। যেখানে অভিযোগের বিষয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি নজরুল ইসলাম।
অভিযোগের বিষয়ে নজরুল ইসলাম যা বলেন
নজরুল ইসলাম দুদকে পাঠানো লিখিত বক্তব্যে দাবি করেন, লেনদেন ২১ কোটি টাকা হলেও প্রকৃত অর্থ ছিল ছয় কোটি টাকা। ওই টাকা উত্তোলন ও জমার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ ১০ বছরে লেনদেনের পরিমাণ এত বেশি দেখাচ্ছে।
তিনি আরও দাবি করেন, তার যত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে তা তিনি আয়কর বিবরণীতে দেখিয়েছেন। নগদ অর্থের মধ্যে বন্ধুর থেকে পাওয়া ও ব্যাংকের ঋণ রয়েছে। ‘টাকা বৈধ করার সুযোগ সরকার দিয়েছেন, সে জন্য আইন অনুযায়ী সরকারের কোষাগারে যথাযথ কর দিয়েই বৈধ করেছেন। এটা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না’ বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম।
নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
দুদক ও বিআইএফইউ’র প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নজরুল ইসলাম ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন (হিসাব নং-১১৩৭১২১২১৯৬০০০৮)। ২০২০ সালের ৫ জুলাই পর্যন্ত তিন বছরে সেখানে চার কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা জমা হয়। এর মধ্যে তিনি চার কোটি ৯৪ লাখ নয় হাজার টাকা তোলেন। হিসাবটিতে মোট নয় কোটি ৮৯ লাখ টাকা লেনদেন হয়।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নজরুল ইসলামের ভাই মো. তরিকুল ইসলামের নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় আরও একটি হিসাব (সঞ্চয়ী হিসাব নং-১১৩৭১২১২৭২০০০১৩) খোলা হয়। সেখানেও ২০২০ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত ছয় কোটি এক লাখ টাকা লেনদেন হয়। এছাড়া নজরুল ইসলামের ওই একই ব্যাংকের বরিশাল শাখায় এফডিআর হিসাবে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা তোলার প্রমাণ পাওয়া যায়।
নজরুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ পারভীনের নামে ২০১৯ সালের ৩০ মে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বরিশাল শাখায় এক বছর মেয়াদি ৭৫ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। যা ২০২০ সালের মে মাসে তোলা হয়। এছাড়া ওই ব্যাংকে শাহনাজ পারভীনের নামে পাঁচটি এফডিআর ও এসবিডিএস হিসাব পাওয়া গেছে।
সূত্র আরও জানায়, বরিশালের পূবালী ব্যাংক শাখায় ২০১৮ সালে নজরুল ইসলাম আরও একটি হিসাব (সঞ্চয়ী হিসাব নং- ০৩৭৪১০১১৯৪৮৬৪) খোলেন। সেখানে ১০ লাখ টাকা জমা করে তার ভাইয়ের মাধ্যমে তোলেন। এছাড়া আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডে নজরুল ইসলামের নামে ছয়টি এফডিআর এবং ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ বছর মেয়াদি ৮৬ লাখ টাকার ঋণ নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। যা তিনি পরিশোধ করে দেন।
এছাড়া বরিশাল সদরের দক্ষিণ আলেকান্দায় নজরুল ইসলামের নামে চার তলা একটি বাড়ি এবং স্ত্রীর নামে বরিশাল সদরে ৮.৩৫ শতাংশ জমির তথ্য-প্রমাণ মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন- ২০১২ এর ৪ (২) ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় মামলা দায়ের হয়।
আরএম/এমএআর