অবৈধ উৎস বন্ধ না হলে অর্থপাচার চলতেই থাকবে
অবৈধ আয়ের উৎসগুলো বন্ধ করতে না পারলে এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে পাচার চলতেই থাকবে। এমনটি মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের মূল কৌশল হচ্ছে আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং। অর্থাৎ অধিকাংশ অর্থপাচার বাণিজ্যভিত্তিক হয়ে থাকে বলে মনে করেন ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক এ উপদেষ্টা। অর্থপাচার রোধে করণীয় সম্পর্কে কথা বলেন ঢাকা পোস্ট-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এফ এম আবদুর রহমান মাসুম।
বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ট্রেড মিস-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ বাইরে চলে গেছে এমন প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। একইভাবে ওই প্রতিবেদনে ট্রেড মিস-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ দেশে প্রবেশ করেছে এমন প্রথম ৫০টি দেশের তালিকায়ও রয়েছে বাংলাদেশের নাম
ঢাকা পোস্ট : দেশ থেকে কীভাবে অর্থপাচার হচ্ছে? এটি রোধে করণীয় কী?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : অর্থপাচার প্রতিরোধে প্রথমেই দেখতে হবে এর সূত্রগুলো কী কী, কীভাবে দেশ থেকে অর্থপাচার হচ্ছে? গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)- এর তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে যে অর্থপাচার হচ্ছে তার সিংহভাগই হয় বাণিজ্যের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিতে ওভার-ইনভয়েসিং (আমদানিতে বেশি মূল্য দেখানো) এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (আমদানিতে কম মূল্য দেখানো) মাধ্যমে মূলত অর্থপাচার বেশি হয়ে থাকে।
অর্থাৎ অধিকাংশ অর্থপাচার হয় বাণিজ্যভিত্তিক। এক্ষেত্রে এনবিআরের কাস্টমস, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাজ করা উচিত। ভবিষ্যতে যাতে অর্থপাচার বন্ধ হয় সে ব্যবস্থাই আমাদের করতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : কারা টাকা বিদেশে পাঠাচ্ছেন এবং কেন পাঠাচ্ছেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : অবৈধভাবে যারা অর্থ আয় করেন, তা চোরাচালানের মাধ্যমে হোক কিংবা অন্যকোনো অবৈধ উপায়ে হোক, টাকা আয় করে দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেন না তারা। বিদেশে পাঠিয়ে দেন। এসব টাকা কোথায়, কোন দেশে যাচ্ছে তা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে বের করা দরকার। বের করতে পারলে ওই দেশের আইনি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এটা যদি করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে অর্থপাচার বন্ধ হবে। তা না হলে চলতেই থাকবে।
এসব টাকা কোথায়, কোন দেশে যাচ্ছে তা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে বের করা দরকার। বের করতে পারলে ওই দেশের আইনি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এটা যদি করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে অর্থপাচার বন্ধ হবে। তা না হলে চলতেই থাকবে
ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ
ঢাকা পোস্ট : হুন্ডির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এটা আদৌ শনাক্ত করা সম্ভব কি-না?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশ থেকে পাচার হলে সেটা ফেরত আনা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বের করতে হবে অবৈধ অর্থের উৎসগুলো কী? সেটা বন্ধ করতে পারলে অর্থপাচার বন্ধ করা সম্ভব। আর একটি বিষয় হচ্ছে, যেসব টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে, সেটা ফেরত আনতে কূটনৈতিক ও লিগ্যাল যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে সেসব অনুসরণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাণিজ্যের আড়ালে বছরে পাচার ৬৪ হাজার কোটি টাকা : জিএফআই
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। জিএফআই’র সর্বশেষ প্রতিবেদন (২০২০ সালের মার্চে) অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ট্রেড মিস-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ বাইরে চলে গেছে এমন প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। একইভাবে ওই প্রতিবেদনে ট্রেড মিস-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ দেশে প্রবেশ করেছে এমন প্রথম ৫০টি দেশের তালিকায়ও রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
যেসব টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে, সেটা ফেরত আনতে কূটনৈতিক ও লিগ্যাল যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে সেসব অনুসরণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে
ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়নি। সেখানে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে এভাবে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ এক হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে। ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। এছাড়া ২০০৯ সালে ৪৯০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৭০৯ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮০০ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭১২ কোটি ডলার ও ২০১৩ সালে ৮৮২ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।
বিএফআইইউ যা বলছে
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পাচার হওয়া অর্থের ৮০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)- এর তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং- এর মাধ্যমে অর্থপাচারের হার সবচেয়ে বেশি। আমদানিযোগ্য পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করে বিশেষত যেসব পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কম, যেমন- মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কম্পিউটার সামগ্রী ইত্যাদি বা যেসব পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণ কঠিন, সেসব পণ্য বা সেবা আমদানির মাধ্যমে অর্থপাচার হয়।
প্রচলিত আইনে যা আছে
অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয় ২০১২ সালে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এ আইন সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার ‘মানিলন্ডারিং অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দেশের বাইরে সম্পত্তি বা অর্থ প্রেরণ বা রক্ষণ বা দেশের বাইরের যে অর্থ-সম্পত্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে এবং যা বাংলাদেশে আনয়নযোগ্য ছিল, কিন্তু তা আনা হতে বিরত থাকা বা বিদেশ হতে প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা বা বিদেশে প্রকৃত দেনার অতিরিক্ত পরিশোধ করা ইত্যাদি।’
মানিলন্ডারিং অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন চার বছর ও সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণ ও সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডও করা হতে পারে।
পাচার হওয়া অর্থ কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব
মানিলন্ডারিং আইন অনুযায়ী, অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচটি সংস্থা। যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এছাড়া বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করছে ১০টি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়া আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স। সর্বশেষ গেল বছর ৩০ ডিসেম্বর টাস্কফোর্সে বৈঠকে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ দমনে ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করে আইন সংশোধনের উদ্যোগের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে থাকে। বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা তদন্ত করে এনবিআর। হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থপাচার হলে তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি তদন্ত করে থাকে।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার নজিরও রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ফেরত আনতে সক্ষম হয় দুদক।
অর্থ কেন পাচার হয়
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের বড় মাধ্যম হুন্ডি। সবধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের অর্থ পরিশোধের জন্য হুন্ডির ব্যবহারই বেশি। দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে। তারা মনে করেন, ভবিষ্যৎ সেখানেই, বাংলাদেশে নয়। এ কারণেও অর্থ অন্য দেশে চলে যায়। কানাডার ‘বেগম পাড়া’ এর বড় উদাহরণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে, দেশে বিনিয়োগের ভালো ক্ষেত্র না থাকা। সুশাসনের অভাবেই মূলত একটি দেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে থাকে।
আরএম/এমএআর/