সিএসই’র সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দিনের কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ ও তার তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি ও দুবাইয়ে অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল।
বিজ্ঞাপন
এরই মধ্যে ফাঁকিকৃত অর্থ আদায়ে তাদের ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তাদের ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব ফ্রিজ হওয়ার পর উচ্চ আদালতে আপিল করা হলেও শুধুমাত্র একটি হিসাব খুলে দেওয়ার আদেশ হলেও অন্যান্য হিসাব ফ্রিজ রয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
ফাঁকি দেওয়া করের মধ্যে পাথর ও কয়লা আমদানির বিপরীতে সার চার্জ ও জরিমানা বাবদ ৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৬ টাকা ও বিভিন্ন সম্পদের তথ্য গোপনের বিপরীতে ৮ কোটি ২৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৩ টাকার আয়কর ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
‘ফখর উদ্দিন ব্রাদার্স’ নামের একটি গ্রুপের যৌথ মালিক হচ্ছেন চার ভাই। বর্তমানে ফখর উদ্দিন আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যান্য ভাই ফালাহ উদ্দিন আলী আহমেদ, ফয়েজ হাসান ফেরদৌস ও সালাহ উদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে ফখর উদ্দিন আলী আহমেদের ছেলে ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান প্রতিষ্ঠানের পরিচালক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
কর ফাঁকি ও দুবাইয়ে বিনিয়োগের বিষয়ে
অভিযোগের বিষয় জানতে ফখর উদ্দিন আলী আহমেদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও জবাব পাওয়া যায়নি। তবে তার ছেলে ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়াই সিআইসি আমাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে। এটা অন্যায়। এতো বছর ধরে শতশত কোটি টাকা সরকারকে কর দিয়ে আসলাম কিন্তু এনবিআরের এই সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হলে কি কর পাওয়া যাবে? এনবিআর আমাদের দোষী প্রমাণ করতে পারে নাই। আমাদের কিছু ভুল রয়েছে, সেটা স্বীকার করেছি। তবে তারা যে দাবি করেছে,সেটা হবে না। সর্বোচ্চ ৫-৬ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। তারা যেহেতু ডিমান্ড ইস্যু করে নাই, তাই বিস্তারিত আমরাও বলতে পারছি না।
দুবাইয়ে বিনিয়োগে বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, তাদের এটা প্রমাণ করতে হবে। সেখানে কোনো বিনিয়োগ নেই বা বাংলাদেশ থেকে কোনো টাকা যায়নি। বিনিয়োগ হলে মানিট্রেন থাকার কথা, কিন্তু এনবিআর কি প্রমাণ করতে পারবে আমি বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়েছি? যেহেতু দুবাইয়ে নিয়মিত যাওয়া আসা করতাম। সে কারণে আমার রেসিডেন্সি ভিসা রয়েছে। সেটা করতে খুব বেশি টাকা দরকার হয় না। ঘটনা হচ্ছে আমার এক বন্ধুর বাবার সঙ্গে স্যাফায়ার-৩২ প্রকল্পে সেল অ্যাগ্রিমেন্ট রয়েছে। অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করতে পারলে ১৩ শতাংশ ভাগ শেয়ার পাওয়া যাবে। এটা তো পারিশ্রমিক। আমি এখন পর্যন্ত কোনো টাকা পাইনি। তাহলে কীভাবে বিদেশে বিনিয়োগ করলাম।
৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি
এনবিআর বলছে ফখর উদ্দিন ব্রাদার্স প্রকৃত বিনিয়োগ গোপনের মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়েছেন। তাদের মালিকদের নামে পাথর ও কয়লা আমদানি করে তা তাদের অংশীদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফখর উদ্দিন আলী আহমেদের আয়কর নথিতে ২০১৭-১৮ করবর্ষ হতে প্রদর্শনের মাধ্যমে শুধুমাত্র সারচার্জ ও জরিমানা বাবদ ৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮৬ টাকার আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন।
ওই করদাতারা আবার নিজ নামে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জমি ক্রয় ও উক্ত জমিতে স্পোর্টস কমপ্লেক্স হতে ভাড়ার মাধ্যমে আয় গোপন করেছেন। গুলশানে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় এবং দামী গাড়ি ক্রয়েও বিনিয়োগ গোপন করেছেন।এছাড়াও করদাতা গুলশানের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ লিমিটেড নামের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কমার্শিয়াল স্পেস ক্রয় করলেও তা গোপন করেছেন। এসব খাতে বড় অঙ্কের আয়কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এখানে আয়কর এবং জরিমানা বাবদ ৮ কোটি ২৬ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৩ টাকার আয়কর ফাঁকি হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে আরও জানা যায়, তারা মেসার্স ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ, মেসার্স হোটেল স্টার প্যাসিফিক, মেসার্স ক্যাসাব্লাঙ্কা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট ও সিলেট কমিউনিকেশন্স সিস্টেমস লিমিটেড এবং করদাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের অংশীদার ও পরিচালক। তারা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর ফাঁকির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। ফাঁকিকৃত রাজস্ব দ্রুত আদায়ের স্বার্থে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের মাধ্যমে আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ২২৩ অনুযায়ী আলোচ্য করদাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সকল ব্যাংক হিসাব হতে অর্থ স্থানান্তর বা অবরুদ্ধকরণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
দুবাইয়ে বিনিয়োগ ও কর ফাঁকি
ফখরুদ্দিন আলি এবং ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান দুবায়ের ৩২ জেভিসি ডিস্ট্রিক্টে ১২ এর আল বারষায় ৩৩ তলা বিশিষ্ট টাওয়ার এ বিনিয়োগ করেছেন। স্যাফায়ার-৩২ নামের প্রকল্পটিতে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, ১ বেডরুম, ২ বেডরুম এবং ৩ বেডরুম অ্যাপার্টমেন্ট মিলে মোট ২২৪টা অ্যাপার্টমেন্ট প্রস্তুত করা হচ্ছে। সেখানে স্পেস, জীম, সুইমিং পুলসহ অনেক প্রকার কমন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ এবং ফখরুস সালেহীন নাহিয়ানের ট্যাক্স ফাইল এ আলোচ্য প্রকল্পে তাদের বিনিয়োগ প্রদর্শিত নেই। আয়কর আইন, ২০২৩ এর বিধান অনযায়ী একজন নিবাসী করদাতার বিদেশে অবস্থিত সম্পত্তি বা বিনিয়োগ তার ট্যাক্স ফাইল এ প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিদেশস্থ সম্পত্তির বাজার মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা আদায়ের বিধান রয়েছে। ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ এবং ফখরুস সালেহীন নাহিয়ান কর স্যাফায়ার-৩২ প্রকল্পে মোট বিনিয়োগের ওপর কর ও জরিমানা আদায়ের জন্যই তাদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ বা ফ্রিজ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আরএম/এআইএস