খেলাপিতে ধুঁকছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান
মালিকপক্ষের বিভিন্ন অনিয়ম-জালিয়াতি আর অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যাচাই-বাছাই ছাড়াই নিয়মবহির্ভূত বিতরণ করা ঋণ অনেকেই আদায় করতে পারছে না। ফলে করোনা মহামারির সময় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পরও এ খাতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তারল্য সংকটে প্রতিনিয়ত দুর্বল হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। অনেকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এ অবস্থায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ছয় হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৯ শতাংশ।
এ হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে (২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৬১২ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৩৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। সেই হিসাবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৬৬ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ছিল ছয় হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৯ শতাংশ
আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে খারাপ করছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। তাদের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এছাড়া করোনার কারণে ঋণ আদায় ব্যাপক কমেছে। বিভিন্ন অনিয়মের খবরে সাধারণ গ্রাহকরা আমানত তুলে নিচ্ছেন। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে পড়েছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে ১০টি প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের সময়মতো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। তারল্য সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিলও চেয়েছে।
এদিকে অনিয়মের পরও দৃশ্যমান শাস্তি না হওয়ায় এ খাতে তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে অর্থ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে অবসায়কও (লিকুইডেটর) নিয়োগ হয়। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন হয়নি। জড়িত কেউ এখনও শাস্তি পায়নি। যারা লুটপাট করেছেন তারা বেশ আয়েশে আছেন। অন্যদিকে, আমানতকারীরা পাওনা টাকা ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
দেশের বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের ‘খলনায়ক’ প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। তাকে সমর্থন ও সহায়তা করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। তার (পি কে হালদার) থাবায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল), এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) এখন খাদের কিনারায়। এসব প্রতিষ্ঠান দখলের পর নামে-বেনামে টাকা বের করেন তিনি। শুধু ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে পি কে হালদার প্রভাব খাটিয়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। এখন এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।
আইএলএফএসএল সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী মন্দ ঋণের তালিকায় থাকা শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এক হাজার ৫৪৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বেশি পাওনা। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে, আবার কারও বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এন আই খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঋণের টাকার বড় অংশ পি কে হালদারের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানে পড়ে আছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ তার মাধ্যমে বিক্রি করে অর্থ আদায় করা। কিন্তু এখন তিনি দেশ থেকে পালিয়েছেন। অর্থ ফেরত পাওয়া এখন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়।
পি কে হালদারের কারণে অনেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হয়ে সুযোগ নিচ্ছেন— এমন মন্তব্য করে আইএলএফএসএলের চেয়ারম্যান বলেন, পি কে হালদার ছাড়াও প্রায় ২২০০ কোটি টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে পড়ে আছে। অনেকে ঋণ নিয়ে ভালো ব্যবসাও করছেন। কিন্তু ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। ওই টাকাগুলো পেলে কিছু আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়া যেত। কিন্তু এখন তারা সুযোগ নিচ্ছেন। ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন টালবাহানা করছেন। ঋণের অর্থ ফেরত চাইতে গেলে অনেকে ভালো ব্যবহারও করছেন না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ, ভিত্তি দুর্বল; তাদের ভালো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা দরকার। কারণ, আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারলে ওই প্রতিষ্ঠান রেখে লাভ কী? এরা আর্থিক খাতের পরিবেশ নষ্ট করছে। তাদের নতুনত্ব বলতে কিছুই নেই। অনিয়ম করে নিজেরাই অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছে। এটি বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ অবস্থায় চলে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ খাতে নজর কম। যে কারণে এখানে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনায় প্রচুর ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে আর্থিক খাত গভীর সংকটে পড়বে। তাই যেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করছে বা হয়েছে; যারা জড়িত, তাদের এখনই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ছাড় দিলে অন্যরা সুযোগ নেবে। একইসঙ্গে এ খাতে পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে।
দেশে প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালে আইপিডিসি ফাইন্যান্সের হাত ধরে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স দিয়ে থাকে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৪- এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর মতোই ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও রেগুলেটরি বডি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশে বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এছাড়া গত বছর স্ট্র্যাটেজি ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট নামে নতুন আরও একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এসআই/জেডএস/এমএআর