৪৮৭২ কোটি নিয়ে বিমা কোম্পানির ‘ছিনিমিনি’!
গ্রাহকের কষ্টার্জিত চার হাজার ৮৭২ কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে দেশের ৮০টি বিমা কোম্পানি। বিধবা নারী, রিকশাচালক কিংবা দিনমজুরের মতো মানুষের বিমাদাবির অর্থ লোপাটে ব্যস্ত এসব কোম্পানির কর্মকর্তারা! বছরের পর বছর কষ্টের জমানো টাকা উদ্ধারে কোম্পানির পেছনে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। তবুও মিলছে না পাওনা টাকা। উল্টো কোম্পানির কাছে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক।
নানা হয়রানির কথা তুলে ধরে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে অভিযোগ দেন কয়েক হাজার গ্রাহক। এ ছাড়া গ্রাহক হয়রানি, বিমাদাবি পরিশোধ এবং বিমা খাতের অবস্থা জানতে চেয়ে গত মাসের শেষ নাগাদ আইডিআরএ’র কাছে চিঠি পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় আইডিআরএ।
২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ও বায়রা লাইফ ছাড়া গ্রাহকদের মোট দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬২৯ কোটি ৭০ লাখ এক হাজার পাঁচ টাকা। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিমা কোম্পানি বিদায়ী বছরে মোট ছয় হাজার ৭৫৭ কোটি ৬১ লাখ ৯৭ হাজার ১৬৬ টাকার বিমা দাবি ও ম্যাচিউরিটির অর্থ গ্রাহকদের পরিশোধ করেছে। কিন্তু এ সময়ে চার হাজার ৮৭২ কোটি আট লাখ তিন হাজার ৮৩৯ টাকা পরিশোধ করেনি ৮০টি কোম্পানি
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহক হয়রানি ও বিমার অর্থ পরিশোধে কোম্পানিগুলোর অনীহার কারণে এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা দিনদিন কমছে। তার প্রভাব পড়েছে বিমা কোম্পানির ব্যবসায়ও।
আরওপড়ুন >> সিইও হওয়ার আগেই ক্ষমতা দেখাচ্ছেন খালেক মিয়া
খাত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকের ডিপোজিটের মতো মেয়াদ পূর্তির পর গ্রাহকের বিমার টাকা ফেরত দেওয়া কোম্পানির দায়িত্ব। কিন্তু এ অর্থ পেতে পাঁচ ধরনের হয়রানি শিকার হন গ্রাহকরা। সেগুলো হলো- প্রথমত, পাকা রসিদের ফাঁদ। দ্বিতীয়ত, পাকা রসিদ নিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করে কোম্পানির শাখা অফিসে জমা দেওয়ার পর কর্মকর্তাদের পেছনে শুরু হয় তদবির (শাখা অফিস থেকে জেলা অফিস, জেলা অফিস থেকে জোনাল অফিস, জোনাল অফিস থেকে বিভাগীয় অফিস, সেখান থেকে প্রধান অফিস)।
তৃতীয়ত, নানা তদবিরের পর কিছু কোম্পানি মেয়াদ পূর্তির টাকা দেয় গ্রাহকদের। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয় নতুন করে কোম্পানিতে পলিসি করতে হবে। এ পলিসির নামে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ আবারও রেখে দেয় কোম্পানি।
চতুর্থত, অনেক ঘোরাঘুরির পর গ্রাহকদের চেক দেয় কিন্তু ব্যাংক গিয়ে দেখা যায় অ্যাকাউন্টে সমপরিমাণ টাকা নেই। অর্থাৎ চেক ডিজ-অনার হয়।
পঞ্চমত, চেক দেওয়া হয় কিন্তু বলা হয় ছয় মাস, নয় মাস কিংবা এক বছর পর চেক দিয়ে টাকা তুলবেন। এক বছর পর ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায়, চেক ডিজ-অনার হয়েছে। আবার কোম্পানির পেছনে ঘুরে ঘুরে নতুন চেক আনা হয়। অথবা নগদ টাকা আনা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আইডিআরএ’র প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ও বায়রা লাইফ ছাড়া গ্রাহকদের মোট দাবির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬২৯ কোটি ৭০ লাখ এক হাজার পাঁচ টাকা। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিমা কোম্পানি বিদায়ী বছরে মোট ছয় হাজার ৭৫৭ কোটি ৬১ লাখ ৯৭ হাজার ১৬৬ টাকার বিমা দাবি ও ম্যাচিউরিটির অর্থ গ্রাহকদের পরিশোধ করেছে। কিন্তু এ সময়ে চার হাজার ৮৭২ কোটি আট লাখ তিন হাজার ৮৩৯ টাকা পরিশোধ করেনি ৮০টি কোম্পানি। পরিশোধ না হওয়া অর্থের মধ্যে এক শতাংশ অর্থ হচ্ছে মৃত্যু বিমাদাবি আর ৯৯ শতাংশ হচ্ছে মেয়াদ পূর্তির।
আরওপড়ুন >> মিটিং প্রতি ২ লাখ টাকা ঘুষ চানআইডিআরএর সদস্য কামরুল
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সরকারি দুই কোম্পানি সাধারণ বিমা ও জীবন বিমা কর্পোরেশন দাবি পরিশোধ করেছে ৫৫২ কোটি ৭১ লাখ ৪৭ হাজার ১১১ টাকা। বেসরকারি কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের পরিশোধ করেছে ছয় হাজার ২১৪ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার ৫৫ টাকা।
আগের বছরে গ্রাহকদের পাওনা ছিল দুই হাজার ৪৫৩ কোটি ৮৮ লাখ ৩৭৬ টাকা। এর মধ্যে সরকারি দুই প্রতিষ্ঠান জীবন ও সাধারণ বিমা কর্পোরেশনের কাছে রয়েছে ৯৪৭ কোটি ৮৩ লাখ ৪৪ হাজার ৯১৪ টাকা। ৭৮ বেসরকারি কোম্পানির কাছে বছরে পর বছর ধরে গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে এক হাজার ৫০৬ কোটি ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৪৬২ টাকা।
ওই অর্থের সঙ্গে ২০২৩ সালে নতুন করে বিমাদাবি যোগ হয়েছে দুই হাজার ২২৯ কোটি ৪৫ লাখ দুই হাজার ৬৩ টাকা। সরকারি দুই বিমা কোম্পানি পরিশোধ করেনি ২০ কোটি ৯৭ লাখ ২২ হাজার ৩৫২ টাকা। বেসরকারি ৭৭ প্রতিষ্ঠানের যোগ হয়েছে দুই হাজার ২০৮ কোটি ৪৭ লাখ ৭৯ হাজার ৯১১ টাকা। এ ছাড়া রয়েছে নিয়মিত বিমাদাবি।
এ তিন ক্যাটাগরিতে সরকারি-বেসরকারি (লাইফ-ননলাইফ) জীবন ও সাধারণ ৮০টি কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের দাবি ছিল ১১ হাজার ৬২৯ কোটি ৭০ লাখ এক হাজার পাঁচ টাকা। এর মধ্যে ছয় হাজার ৭৫৭ কোটি ৬১ লাখ ৯৭ হাজার ১৬৬ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এখনও গ্রাহকদের বিমাদাবি বাকি রয়েছে চার হাজার ৮৭২ কোটি আট লাখ তিন হাজার ৮৩৯ টাকা।
দুই সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের পাওনা এক হাজার ১১৭ কোটি ৫৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকা। বেসরকারি ৭৮টি কোম্পানির কাছে পাওনা তিন হাজার ৭১৪ কোটি ৫২ লাখ ৩৫ হাজার ১৭৩ টাকা।
আরওপড়ুন >> ১৫৩৭ কোটি টাকার বিমা দাবি নিষ্পত্তি করেছে মেটলাইফ
গ্রাহকদের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাওনার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বিমা কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ), বিমা কোম্পানির এমডিদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ) ও বিমা কোম্পানির কর্মকর্তারাও।
এ বিষয়ে বিআইএ’র সভাপতি শেখ কবির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দেশের বেশির ভাগ বিমা কোম্পানি ভালো। তারা গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধ করে। কিন্তু হাতে গোনা কিছু কোম্পানির কারণে বিমা খাতের বদনাম হচ্ছে। এটি হতে দেওয়া যাবে না।
বিমা কোম্পানির নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট বি এম ইউসুফ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমা খাতের প্রধান সমস্যা হচ্ছে গ্রাহকের পাওনা টাকা পরিশোধে গড়িমসি করা। এ কারণে এখন পর্যন্ত জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান ১ শতাংশের নিচে। বিমা কোম্পানির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াতে হলে যথাসময়ে বিমাদাবি পরিশোধ করতে হবে।
জীবন বিমা খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি মেটলাইফ বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলা আহমদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমাদাবি বা মেয়াদ পূর্তির টাকা সময় মতো পাওয়া গ্রাহকদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, বিমা করাই হয় ভবিষ্যতের নানা প্রয়োজন মেটানো বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবিলার জন্য। বিমার টাকা পাওয়ার অভিজ্ঞতা যত ভালো হবে বিমা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ ও আস্থা তত বাড়বে।
‘বিমার টাকা দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য বিমা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। মেটলাইফের আর্থিক সক্ষমতা বজায় রাখতে আমাদের ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ তহবিল রয়েছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে আমরা তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সব বিমাদাবি পরিশোধ করতে পারছি। নিরাপদ বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে আমরা বিমাদাবি পরিশোধে গ্রাহক সন্তুষ্টি বজায় রাখতে পেরেছি। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে আমাদের বিমাদাবি নিষ্পত্তির পরিমাণ এক হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা এবং ২০২২ সালের এর পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা।’
আরওপড়ুন >> এজেন্টেই বিমার সর্বনাশ
চতুর্থ প্রজন্মের বিমা কোম্পানি জেনিথ ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের সিইও এস এম নুরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু কোম্পানি বিমার টাকা পরিশোধ না করার কারণে বিমা খাতের ওপর মানুষের ধারণা নেতিবাচক। বিমা কোম্পানিগুলোর উচিত টাকা না থাকলে সম্পদ বিক্রি করে হলেও সময় মতো গ্রাহকের আমানত পরিশোধ করা।
‘বকেয়া বিমার অর্থের মধ্যে ৯৯ শতাংশই হচ্ছে মেয়াদ পূর্তির। জেনিথ লাইফ বিমার মেয়াদ পূর্তির সাত দিনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করছে। গ্রাহকদের সুবিধার্থে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি বিকাশ, নগদ ও রকেটসহ অনলাইন সেবার মাধ্যমে পাওনা পরিশোধ করছে।’
তিনি বলেন, ডিজিটাল যুগেও মৃত্যুদাবি এবং মেয়াদ পূর্তি বিমার পাওনা অর্থ পেতে প্রথমে পাকা রসিদের নামে হয়রানির শিকার হন গ্রাহকরা। মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, বিমার অর্থ দেওয়ার সময় কৌশলে নতুন পলিসি করিয়ে ৫০ শতাংশ টাকা রেখে দেয়, যা সম্পূর্ণ অন্যায় ও প্রতারণা। এ ছাড়া, যেসব কোম্পানি চেক দেয় তার বেশির ভাগই ডিজ-অনার হয়। এ কারণে আবারও কোম্পানির পেছনে দৌড়াতে হয়।
যা বলছে আইডিআরএ
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স, সানলাইফ ইনস্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার ইনস্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স ও প্রাইম ইসলামী লাইফসহ বেশকিছু বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে বিমার টাকা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে বেশকিছু কোম্পানির মালিক ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। আইডিআরএ এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে শুনানি করে দ্রুত বিমার অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে।
আরওপড়ুন >> মুনাফা কমলো চার বিমা কোম্পানির
এ বিষয়ে আইডিআরএ পরিচালক (উপ-সচিব) জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের টাকা নিয়ে আর দিতে চায় না। আমরা এসব কোম্পানির তালিকা তৈরি করছি। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশকিছু কোম্পানির বিরুদ্ধে বিমার অর্থ দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আমরা প্রথমে এসব কোম্পানির এমডি-চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদকে ডেকে কারণ জানতে চেয়েছি। তারপর সময় দিয়ে অর্থ পরিশোধের জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। বিমা খাতের আস্থা ও শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছি।
এমআই/এসকেডি/এমএআর/