এমডি পাচ্ছে না অনেক ব্যাংক!
প্রধান কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। আবার কারও মেয়াদ শেষ হয়েছে। এমন অবস্থায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ছাড়াই চলছে অনেক ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও অফার দেওয়ার পরও অনেক প্রতিষ্ঠান এমডি পাচ্ছে না। আবার অনেকে যোগ্য লোকও খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে ফাঁকা পড়ে থাকছে পদগুলো।
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই দেশের সরকারি-বেসরকারি চার বাণিজ্যিক ব্যাংকে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক। এমডি না থাকায় ট্রাস্ট ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই দেশের সরকারি-বেসরকারি চার বাণিজ্যিক ব্যাংকে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক। এমডি না থাকায় ট্রাস্ট ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করছেন
এছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এমডি ছাড়াই চলছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড (আইএলএফএসএল), বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি), ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স।
আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের সীমাহীন অনিয়মের কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আবার ঋণের অর্থ আদায় করতে গিয়ে বিভিন্নজনের হুমকির মুখে পড়েন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডি আবদুল খালেক খান। এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। এখন এমডি ছাড়াই চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
পত্রপত্রিকায় প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমনকি চেয়ারম্যানকে নিয়ে যে নেতিবাচক খবর প্রকাশ হয়েছে তা দেখে কেউ এমডি হতে রাজি হচ্ছেন না। চেষ্টা চলছে, দেখা যাক কী হয়
নজরুল ইসলাম খান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দায়িত্ব নেওয়া চেয়ারম্যান
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বোর্ডের কাজ পলিসি তৈরি করা। আর বাস্তবায়নের দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টের। ফলে এমডি না থাকায় কাজ করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।
এমডি নিয়োগে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে— জানতে চাইলে আদালতের নির্দেশে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দায়িত্ব নেওয়া চেয়ারম্যান জানান, এমডি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আমরা বিজ্ঞাপন দিয়েছি। অনেককে এমডি হওয়ার জন্য ডেকেছি কিন্তু কেউ আসতে চাচ্ছেন না। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংককেও বিষয়টি জানিয়েছি। পাশাপাশি তাদের অনুরোধ করেছি যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক অথবা বর্তমান কোনো কর্মকর্তা থাকলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে এমডি হিসেবে দিতে পারেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। আমি নিজেও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু পত্রপত্রিকায় প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমনকি চেয়ারম্যানকে নিয়ে যে নেতিবাচক খবর প্রকাশ হয়েছে তা দেখে কেউ এমডি হতে রাজি হচ্ছেন না। চেষ্টা চলছে, দেখা যাক কী হয়?
আমাদের ব্যাংকের অবস্থা ভালো। অনেকে এমডি পদে আসতে চাচ্ছেন। বেশ কয়েকজনের ইন্টারভিউও নেওয়া হয়েছে। এখন খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যাকে সবচেয়ে যোগ্য মনে হবে পর্ষদ তাকেই নিয়োগ দেবে
মনজুরুর রহমান, চেয়ারম্যান, পূবালী ব্যাংক
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এখন এমডি ছাড়া চলছে বেসরকারি পূবালী ব্যাংক। এমডি নিয়োগের বিষয়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান জানান, আমাদের ব্যাংকের অবস্থা ভালো। অনেকে এমডি পদে আসতে চাচ্ছেন। বেশ কয়েকজনের ইন্টারভিউও নেওয়া হয়েছে। এখন খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যাকে সবচেয়ে যোগ্য মনে হবে পর্ষদ তাকেই নিয়োগ দেবে।
প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংকেও নেই পূর্ণাঙ্গ এমডি। কোম্পানির সচিব এ এস এম বুলবুল ব্যাংকটির এমডির চলতি দায়িত্বে আছেন।
এমডি পদ শূন্য রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে সাবেক এমডি মো. রফিকুল আলমের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এখন পদটি ফাঁকা। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দায়িত্ব পালন করছেন ব্যাংকটির মহাব্যবস্থাপক আহম্মদ হোসেন। নতুন এমডি নিয়োগের বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনাপর্ষদের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল হাসেমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কথা বলেননি।
তবে অগ্রণী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. আনিসুর রহমানকে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ঢালাওভাবে ব্যাংক অনুমোদন দিচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ লোক তৈরি হচ্ছে না। আবার অনেক ব্যাংকের বোর্ডপরিচালকরা তাদের পছন্দের লোক খোঁজেন। যাকে দিয়ে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। এটি বুঝে অনেকে আসতে চাচ্ছেন না
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
বেসরকারি ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ফারুক মঈনউদ্দীনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন করে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে এএমডি হুমায়রা আজম ব্যাংকটির এমডি ও সিইও’র চলতি দায়িত্বে আছেন।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) এমডি নিয়োগ দেয়া হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির এমডির চলতি দায়িত্বে আছেন এ কে এম আশফাকুর রহমান চৌধুরী। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের এমডি ও সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মো. তুহিন রেজা। পদ শূন্য হওয়ার পর মেরিডিয়ান ফিন্যান্সে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কাজী নিজাম আহমেদ বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও সিইও’র চলতি দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী আরিফ খান ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। এখনও প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে এমডি ও প্রধান নির্বাহীর পদে আরিফ খানের নাম আছে।
অনিয়ম বন্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। ব্যবস্থাপনায় বোর্ডের হস্তক্ষেপ কমাতে হবে। দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি ছোট ছোট যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা ভালো না, আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না— এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করে চালানো যেতে পারে
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) মেয়াদ শেষ হবে আবার নতুন নিয়োগ হবে— এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান এমডি পাচ্ছে না, এরও কয়েকটি কারণ আছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঢালাওভাবে ব্যাংক অনুমোদন দিচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ লোক তৈরি হচ্ছে না। আবার অনেক ব্যাংকের বোর্ডপরিচালকরা তাদের পছন্দের লোক খোঁজেন। যাকে দিয়ে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। এটি বুঝে অনেকে আসতে চাচ্ছেন না।’
‘এছাড়া অনিয়মের কারণে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই খারাপ। এসব প্রতিষ্ঠানে এসে কেউ দুর্নীতির দায় নিজের ঘাড়ে নিতে চাচ্ছেন না।’
এ বিষয়ে পরামর্শ কী— জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজুল বলেন, ‘অনিয়ম বন্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। ব্যবস্থাপনায় বোর্ডের হস্তক্ষেপ কমাতে হবে। দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি ছোট ছোট যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা ভালো না, আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না— এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করে চালানো যেতে পারে।’
এসআই/এমএআর/